আকাশে ভাসমান ড্রোন চালায় দূরে বসা মানুষ৷ ভবিষ্যতে বিশাল মালবাহী জাহাজও সেভাবে কনট্রোল রুমে বসে চালানো সম্ভব করতে চান জার্মান বিজ্ঞানীরা৷ বিশেষ সফটওয়্যার কাজে লাগিয়ে আজই তার আভাস পাওয়া যাচ্ছে৷
বিজ্ঞাপন
নাবিক ছাড়াই চলবে জাহাজ
04:20
ভবিষ্যতের জাহাজ হয়তো শীঘ্র একেবারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মহাসাগর পাড়ি দেবে৷ শুধু বন্দরের মধ্যে এলে কয়েকজন নাবিক সেটি চালনা করবেন৷ তারপর সমুদ্রে গিয়ে পড়লে ন্যাভিগেশন ও লোকালাইজেশন প্রযুক্তির নেটওয়ার্ক জাহাজটিকে গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাবে৷
ফ্রাউনহোফার সিএমএল-এর কার্লোস ইয়ান বলেন, ‘‘প্রথমত, কর্মীর প্রয়োজন না থাকায় অর্থ বাঁচছে৷ অর্থাৎ অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে৷ আরেকটি সুবিধা হলো, সেন্সর প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে সমুদ্রে জাহাজকে আরও নিরাপদ করে তোলা যাবে৷ ভুললে চলবে না, মানুষের ভুলের কারণেই সবচেয়ে বেশি জাহাজ দুর্ঘটনা ঘটে৷ তাছাড়া ধীর গতিতে চলা স্বয়ংক্রিয় জাহাজ পরিবেশ দূষণ কামতেও সাহায্য করবে৷ কার্বন নির্গমন ও জ্বালানির ব্যবহার কমবে৷''
ইতিহাস গড়া কাঠের জাহাজ
‘ফ্রাম’ নামে ওক গাছের কাঠ দিয়ে তৈরি একটি জাহাজকে ‘বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী কাঠের জাহাজ’ বলা হয়৷ কারণ এটা দিয়ে উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর সবচেয়ে দূরবর্তী স্থানে যাওয়া সম্ভব হয়েছে৷ কাঠের তৈরি অন্য কোনো বাহন দিয়ে যেটা সম্ভব হয়নি৷
ছবি: DW/ M. Z. Haque
‘ফ্রাম’ বা ফরোয়ার্ড
ওক কাঠ দিয়ে তৈরি জাহাজটির নাম ‘ফ্রাম’ – যার অর্থ ফরোয়ার্ড বা অগ্রসর৷ ৩৯ মিটার দীর্ঘ ও ১১ মিটার প্রস্থের এই জাহাজকে ‘বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী কাঠের জাহাজ’ বলা হয়৷ কারণ এটা দিয়ে উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর সবচেয়ে দূরবর্তী স্থানে যাওয়া সম্ভব হয়েছে৷
ছবি: DW/M. Z. Haque
পেছনের কারিগর
ফ্রিটইওফ নানজেন নামের ছবির এই মানুষটিই ছিলেন ‘ফ্রাম’ তৈরির মূল উদ্যোক্তা৷ তাঁর ইচ্ছা ছিল এমন একটি জাহাজ তৈরির যেটা দিয়ে উত্তর মেরুর অনেক দূর যাওয়া যায় যে পর্যন্ত আগে কেউ যেতে পারেনি৷ নরওয়ের নাগরিক নানজেনের উদ্যোগে জাহাজটি তৈরি করেছিলেন কলিন আর্চার৷ নরওয়ের সরকারও এতে কিছু আর্থিক সহায়তা দিয়েছিল৷
ছবি: DW/ M. Z. Haque
উত্তর মেরু অভিযান (১৮৯৩-১৮৯৬)
১৮৯৩ সালের ২৪ জুন থেকে ১৮৯৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর – এই তিন বছর উত্তর মেরুতে অভিযান করে ফ্রাম৷ এ সময় জাহাজটি উত্তর মেরুর ৮৫°৫৭' পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছিল, যেখানে আগে কোনো কাঠের জাহাজ যেতে পারেনি৷ তাই ফ্রাম যখন অভিযান শেষে ফিরে আসে তখন নরওয়ের রাজা অভিযাত্রীদের অভ্যর্থনা জানান৷ ছবিটি অভিযান শুরুর সময়কার৷ নানজেন ছাড়াও অভিযাত্রী ছিলেন ১২ জন৷
ছবি: DW/ M. Z. Haque
দক্ষিণ মেরু অভিযান (১৯১০-১৯১২)
নরওয়ের আরেক অভিযাত্রী রোয়াল্ড আমুন্ডসেন হলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি দক্ষিণ মেরুতে পৌঁছেছিলেন৷ তিনি তাঁর অভিযানেও ব্যবহার করেছিলেন ফ্রামকে৷ সেসময় ফ্রাম দক্ষিণ মেরুর ৭৮°৪১' পর্যন্ত যেতে পেরেছিল৷ এটাও কাঠের তৈরি জাহাজের জন্য একটা রেকর্ড৷
ছবি: picture-alliance/United Archives/TopFoto
এখন স্থান জাদুঘরে
উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে ইতিহাস সৃষ্টিকারী ফ্রাম এর এখনকার অবস্থান নরওয়ের রাজধানী অসলোর ফ্রাম মিউজিয়ামে৷
ছবি: DW/ M. Z. Haque
রান্নাঘর
এবার চলুন যাওয়া যাক সেই ঐতিহাসিক জাহাজের ভেতরে৷ এটি সেই জাহাজের রান্নাঘর৷
ঝড়, দুর্যোগ, প্রচণ্ড শীত, আইস – এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে জীবন যেন অতিষ্ট হয়ে না ওঠে সেজন্য বিনোদনেরও ব্যবস্থা ছিল ফ্রামে৷
ছবি: DW/ M. Z. Haque
8 ছবি1 | 8
প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব সিমুলেটরে গবেষকরা তাঁদের সফটওয়্যার পরীক্ষা করে দেখছেন৷ সিমুলেশনের মাধ্যমে দ্রুত বোঝা গিয়েছিল, যে নাবিক ছাড়া বন্দরের মধ্যে জাহাজ চলতে পারবে না৷ সেখানে জাহাজ চালানো অত্যন্ত জটিল কাজ৷ তাই ভবিষ্যতেও বন্দর ছেড়ে যাবার এবং সেখানে ঢোকার সময় নাবিকরাই জাহাজ চালাবেন৷ তারপর মালবাহী জাহাজ সমুদ্রে পৌঁছালে নাবিকরা ছোট নৌকা বা হেলিকপ্টারে চড়ে জাহাজ ছেড়ে চলে যাবে৷
গন্তব্যে ঠিক উলটোটা ঘটবে৷ বন্দরে ঢোকার আগে ঠিক সময়ে নাবিকরা জাহাজে পৌঁছবে৷ তারপর নিরাপদে জাহাজটি নোঙর করবে৷ সমুদ্রে চলার সময়ে সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা জাহাজের দায়িত্ব নেবে৷ সবচেয়ে বড় আশা হলো, জাহাজ চলাচল আরও নিরাপদ হবে, কারণ সেন্সর মানুষের তুলনায় অনেক বেশি দক্ষতার সঙ্গে চারিদিকে নজর রাখবে৷ ফ্রাউনহোফার ইনস্টিটিউটের হান্স-ক্রিস্টফ বুয়রমাইস্টার বলেন, ‘‘কোনো বাধা শনাক্ত করতে আগের মতোই আমরা রাডার ও অটোম্যাটিক আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম ব্যবহার করছি৷ সেইসঙ্গে জাহাজে সাধারণ ও ইনফ্রারেড ক্যামেরাও থাকছে৷ সব সিস্টেম একসঙ্গে কাজ করতে পারে৷ এক সেন্সর ফিউশন কনসেপ্টের সাহায্যে তখন অপেক্ষাকৃত ছোট বস্তুও শনাক্ত করা সহজ হবে, যা রাডারে সরাসরি ধরা পড়ে না৷ ইনটেলিজেন্ট অ্যালগোরিদম সেটা সম্ভব করবে৷''
জাহাজ যখন কফিন!
অষ্টম শতকের শেষ থেকে শুরু করে একাদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ইউরোপ ও এশিয়ায় রাজত্ব করেছিল ভাইকিংরা৷ সে সময়কার তিনটি জাহাজের গল্প নিয়ে এই ছবিঘর৷
ছবি: DW/ M. Z. Haque
ওসেব্যার্গ শিপ
৮৫০ সালের দিকে এই জাহাজে করে দুজন নারীকে দাফন করা হয়েছিল৷ যতদূর জানা যায় এর মধ্যে একজন ছিলেন রানি, অন্যজন তাঁর সেবিকা৷ তাদের ‘মৃত্যু-পরবর্তী জীবন’-এ সুখ নিশ্চিত করতে সঙ্গে দিয়ে দেয়া হয়েছিল খাবার থেকে শুরু করে জামা-কাপড়, অলংকার ও নিত্য-ব্যবহার্য জিনিস৷ ১৯০৪-০৫ সালে জাহাজটি উদ্ধার করা হয়৷
ছবি: DW/M. Z. Haque
গোকস্টাট শিপ
১৮৮০ সালে খোঁড়াখুঁড়ি করে বের করা এই জাহাজে ৫০ থেকে ৭০ বছর বয়সি একটি পুরুষের কঙ্কাল পাওয়া গেছে৷ ধারণা করা হয় ৯০০ সালের দিকে এই জাহাজ-কাম-কফিনটি ‘সমাধি টিলা’য় সমাহিত করা হয়েছিল৷
ছবি: DW/ M. Z. Haque
টুনে শিপ
১৮৬৭ সালে খুঁজে পাওয়া এই জাহাজটি গোকস্টাটের মতোই ৯০০ সালের দিকেই সমাহিত করা হয়েছিল৷ গোকস্টাটের মতোই তাতেও একজন উঁচু ব়্যাংকের পুরুষের কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছিল৷
ছবি: DW/ M. Z. Haque
‘ভাইকিং শিপ মিউজিয়াম’
এতোক্ষণ যে তিনটি জাহাজের কথা বলা হলো সেগুলো সব ভাইকিং যুগের এবং এগুলো এখন সংরক্ষিত আছে ছবির এই ভবনটিতে, যার নাম ভাইকিং শিপ মিউজিয়াম৷ অবস্থান নরওয়ের রাজধানী অসলোতে৷ ওক কাঠের তৈরি এই জাহাজগুলো শুরুতে ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজে ব্যবহৃত হতো৷
ছবি: DW/ M. Z. Haque
খাবারের ব্যবস্থা
আগেই বলা হয়েছে ‘মৃত্যু পরবর্তী জীবন’-এ মৃত ব্যক্তিদের সুখ নিশ্চিত করতে সম্ভব সব ধরনের চেষ্টাই করা হয়েছিল৷ উপরের ছবিটি তারই একটি প্রমাণ৷
ছবি: DW/ M. Z. Haque
স্বর্ণালঙ্কার
এসব অলংকার আর ঘড়িরও সন্ধান পাওয়া গেছে জাহাজগুলোতে৷ যদিও সেই যুগেও ডাকাতদের কবলে পড়ে অনেক কিছু হারিয়ে গেছে৷ ছবিতে অলংকার ছাড়াও দেখা যাচ্ছে নিত্য প্রয়োজনীয় একটি উপকরণ৷
ছবি: DW/ M. Z. Haque
মৃতের সৌন্দর্য চর্চা
দুই মৃত নারীর জন্য ওসেব্যার্গ শিপে দিয়ে দেয়া হয়েছিল চিরুনি’ও৷
ছবি: DW/ M. Z. Haque
স্লেজগাড়ি
ওসেব্যার্গ শিপের খননকাজের সময় চারটি ঘোড়ায় টানা স্লেজগাড়ি পাওয়া যায়৷ উপরের ছবিতে তারই একটি দেখা যাচ্ছে৷ পাওয়া গেছে ঘোড়ার কঙ্কালও৷
ছবি: DW/ M. Z. Haque
ঘোড়ার গাড়ি
চার চাকার এই ‘উডেন-কার্ট’-টিও পাওয়া গেছে ওসেব্যার্গ শিপের সঙ্গে৷
ছবি: DW/ M. Z. Haque
টুল ও জুতা
পাওয়া গেছে বসার টুল, সঙ্গে জুতা৷
ছবি: DW/ M. Z. Haque
10 ছবি1 | 10
অন্য কোনো জাহাজের সঙ্গে সংঘাতের উপক্রম হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা চিনতে পারা হলো প্রথম পদক্ষেপ৷ ‘স্বতন্ত্র' জাহাজ তখন নিজেই স্থির করবে, এই অবস্থায় কী করা উচিত – তার নিজের এগিয়ে যাবার অধিকার আছে, নাকি পাশ কাটিয়ে যেতে হবে? ফ্রাউনহোফার ইনস্টিটিউটের হান্স-ক্রিস্টফ বুয়রমাইস্টার বলেন, ‘‘আমরা জাহাজকে আরও বুদ্ধি দিতে চাই, যাতে সে নিজস্ব ক্ষমতায় যাত্রাপথ স্থির করতে পারে এবং নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারে – যেমন সংঘাত এড়িয়ে যাওয়া, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় নিরাপদে এগিয়ে যাওয়া ইত্যাদি৷''
তবে একেবারেই কোনো নজরদারি ছাড়া নাবিকহীন জাহাজ চলবে না৷ স্যাটেলাইটের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি সব কিছুর উপর নজর রাখবেন এবং প্রয়োজনে হস্তক্ষেপ করবেন – যেমন জাহাজের স্বয়ংক্রিয় সিস্টেম পরিস্থিতি সামলাতে না পারলে অথবা সেগুলি বিকল হয়ে গেলে৷ এমন পরিস্থিতিতে ৬টি পর্যন্ত জাহাজ দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে৷
এই যান্ত্রিক উদ্ভাবনের ফলে নাবিকের পেশার চরিত্রও বদলে যাবে৷ ফ্রাউনহোফার সিএমএল-এর প্রধান কার্লোস ইয়ান বলেন, ‘‘আমাদের ধারণা, খোলা সমুদ্রে জাহাজ স্বতন্ত্রভাবে চলবে৷ তবে সীমাবদ্ধ জলপথ বা বন্দরে সেটা সম্ভব হবে না৷ তখন জাহাজ বন্দর থেকে বার করা এবং বন্দরে নিয়ে আসা নতুন এক পেশা হয়ে উঠবে৷ অথবা কনট্রোল রুমে বসে দূরের জাহাজ নিয়ন্ত্রণ করাও নতুন কাজ হবে৷''
এই মুহূর্তে নাবিকহীন জাহাজ সমুদ্রে পাঠানো বেআইনি কাজ৷ ফলে আজই এই ব্যবস্থা যাচাই করতে এবং ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হতে সিমুলেটারই একমাত্র ভরসা৷