ইইউ বলেছে, অ্যালেক্সি নাভালনির মৃত্যুর জন্য রাশিয়া দায়ী। তাই আরো কঠিন নিষেধাজ্ঞা জারির প্রস্তুতি শুরু হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
ইইউ-র পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ক প্রধান জোসেপ বরেল বলেছেন, " পুটিনের আমলে রাশিয়ার জেলে তাকে তিলে তিলে হত্যা করা হলো।"
সোমবার ব্রাসেলসে ইইউ-র মন্ত্রীরা অ্যালেক্সি নাভালনির স্ত্রী ইউলিয়া নাভালনির সঙ্গে কথা বলেছেন এবং তাকে সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ইউলিয়া বলেছেন, ''রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুটিনই জেলে বন্দি থাকা অবস্থায় নাভালনির মৃত্যুর জন্য দায়ী।''
ইইউ একটি বিবৃতি জারি করে বলেছে, ''নাভালনির অপ্রত্যাশিত মৃত্যু রাশিয়ার পরিকল্পিত দমননীতির আরেকটি উদাহরণ। রাশিয়ার রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও কর্তৃপক্ষকে যাতে এর মূল্য দিতে হয়, সেজন্য ইইউ সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করবে। কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হবে।"
কবে এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হবে তা বরেল জানাননি। তবে এই নিষেধাজ্ঞার মধ্যে সম্পত্তি ফ্রিজ করে দেয়া, এর সঙ্গে জড়িতদের ইইউ-তে প্রবেশ করতে না দেয়ার মতো ব্যবস্থা থাকবে।
পুতিনের প্রতিদ্বন্দ্বী নাভালনি!
পুতিন বিরোধী আন্দোলনে রাশিয়ার অন্যতম আলোচিত চরিত্র বিরোধী নেতা আলেক্সি নাভালনি৷ ২০১৮ সালে দেশটির প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে পুতিনের বিরোধিতা করতে বাধা দেয়া হয় তাঁকে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/navalny.com
রাজনীতিবিদের মুখ
ছিলেন আইনজীবী৷ হয়েছেন সক্রিয় রাজনীতিক৷ চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন ভ্লাদিমির পুতিনকে৷ ২০০৮ সালের কথা৷ রাশিয়ার রাজনীতি আর রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর অপকর্ম নিয়ে ব্লগ লিখে রাতারাতি আলোচনায় আসেন নাভালনি৷ তাঁর লেখা ব্লগের কারণে অনেকেই পদত্যাগ পর্যন্ত করতে বাধ্য হন৷ যা ছিল রাশিয়ার রাজনীতির বিরল দিক৷
ছবি: picture-alliance/dpa/TASS/V. Sharifulin
বিতর্কিত সংসদীয় নির্বাচন
২০১১ সালে প্রথম কারাগারে গেলেন নাভালনি৷ ছিলেন ১৫ দিন৷ অভিযোগ, মস্কোর স্টেট ডুমায় সরকার বিরোধী মিছিল-সমাবেশ৷ পুতিনের ‘ইউনাইটেড রাশিয়া’ নির্বাচনে জয় পায়৷ কিন্তু ভোট কারচুপির অভিযোগ আনা হয় পুতিনের বিরুদ্ধে৷ কারাগারে রেখেও দমানো যায়নি নাভালনিকে৷ বের হয়ে এসে আবারো চাঙ্গা করেন পুতিন বিরোধী আন্দোলন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Stenin
কারাগের দ্বিতীয় সাময়িক
২০১২ সালে পুননির্বাচিত হলেন পুতিন৷ রাশিয়ার তদন্ত কমিটিকে নির্দেশ দিলেন নাভালনির অতীত খুঁজে বের করতে৷ দ্বিতীয় দফায় কারাগারে গেলেন নাভালনি৷ আত্মসাতের অভিযোগ মাথায় নিয়ে জেল খাটলেন পাঁচ বছর৷ উচ্চ আদালতে শেষ পর্যন্ত মুক্তি দেয় তাঁকে৷
ছবি: Reuters
ক্রেমলিন বিরোধী মঞ্চ
আইনি কিছু ঝামেলায় পড়েও, মস্কোর মেয়র পদে নির্বাচনে অনুমতি পান তিনি৷ ২০১৩ সালের ওই নির্বাচনে নাভালনিকে হার মানতে হয়৷ কারণ, পুতিনের মিত্র সের্গেই সোবানিয়ান বিপুল ভোটে জয় পায়৷ আর বিরোধী রাজনীতি আবারো চাপা পড়ে যায় পুতিন জোয়ারে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
রাজনীতিকের সামাজিক যোগাযোগ
ক্রেমিলন বিরোধী আন্দোলনের কারণে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে নিষিদ্ধ হন নাভালনি৷ ফলে, নিজের রাজনৈতিক বার্তা ছড়িয়ে দিতে বেছে নিলেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ব্লগ৷ গুছিয়ে বলতে পারা, ভাষার ব্যবহার, পুতিনকে নিয়ে হাস্যরসত্মাক কথা আর বিনয়-সবমিলিয়ে তরুণদের কাছে তিনি হয়ে যান নতুন কান্ডারি৷
ছবি: Alexei Navalny/Youtube
রাষ্ট্রপতির হওয়ার আকাঙ্ক্ষা
২০১৬ সালের ডিসেম্বরে ঘোষণা দিলেন প্রেসিডন্ট পদে লড়তে চান তিনি৷ ২০১৮ সালের মার্চকে সামনে রেখে শুরু করলেন প্রচারণা৷ এবার দুর্নীতির অভিযোগে পারলেন না কাঙ্ক্ষিত পদে দৌড়াতে৷ যদিও বলা হয়, রাজনৈতিক হয়রানি শিকার হয়েছেন তিনি৷
ছবি: Getty Images/AFP/K. Kudryavtsev
দুর্নীতির দায়
২০১৬ সাল৷ ইউরোপিয়ান মানবাধিকার আদালত এক রুলে জানায়, কিরভ মামলায় সুবিচার বঞ্চিত হয়েছে নাভালনি৷ রাশিয়ার সুপ্রিম কোর্টও নাভালনির পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বাতিল করে৷ নথি পাঠিয়ে দেয়া হয় কিরভ আদালতে৷ ২০১৭ সালে আবার তাঁর কারাদণ্ড বাতিলের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/Sputnik/A. Kudenko
অর্ধযুগে মস্কোর বড় বিক্ষোভ
২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি৷ প্রধানমন্ত্রী দিমিত্রি মেদভেদেভের বিলিয়ন-ইউরোর সাম্রাজ্য নিয়ে রিপোর্ট লিখেন নাভালনি৷ সেই ঘটনাকে ঘিরে রাশিয়ার অন্তত ১২টি শহরে শুরু হয় দুর্নীতি বিরোধী মিছিল-সমাবেশ৷ নাভালনিসহ অন্তত হাজারো রাজনৈতিক কর্মীকে সেদিন গ্রেপ্তার করা হয়৷ ২০১১ সালের পর এতো বড় বিক্ষোভ আর দেখেনি মস্কোবাসী৷ ১৫ দিন কারাবাসের পর মুক্তি পায় নাভালনি৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/Evgeny Feldman for Alexey Navalny's campaign
শারীরিক লাঞ্চনা
দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনের দুই মাস পর হাসপাতাল ঠিকানা হয় তাঁর৷ নাভালনির মুখে ছোঁড়া হয় সবুজ রঙের রাসায়নিক৷ ডান চোখের কর্নিয়া তাতে পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়৷ চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যেতে দেয়া হয়নি তাঁকে৷ কারণ তখনও দুর্নীতির অভিযোগ ঝুলছিল তাঁর গলায়৷ পরে ক্রেমলিনের মানবাধিকার কাউন্সিলের সিদ্ধান্তে চোখের অপারেশনের জন্য স্পেন যাওয়ার অনুমতি পান নাভালনি৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/E. Feldman
গ্রেপ্তার এবং গ্রেপ্তার
গেল বছরের গোড়ার দিকে এক মাস জেল খেটেছেন নাভালনি৷ তার কিছুদিন বিরতি দিয়ে আবারো গ্রেপ্তার হন তিনি৷ গেল সেপ্টেম্বরে জামিন পান৷ এ বছরের এপ্রিলে, তাঁর পক্ষে রুল জারি করে ইউরোপের মানবাধিকার কোর্ট৷ বলা হয়, কিরভ মামলায় ২০১৪ সাল থেকে এক প্রকার গৃহবন্দি রেখে নাভালনির অধিকার হরণ করেছে রাশিয়া৷
ছবি: Reuters/M. Shemetov
এবার বিষক্রিয়া
১০ দিন জেল খেটে বের হবার পর, সাতদিনও কাটেনি৷ এ বছরের জুলাইতে আবারো গ্রেপ্তার হন তিনি৷ রাশিয়ার কঠোর প্রতিবাদ আইন ভঙ্গের অভিযোগে আবারো ৩০দিনের জন্য জেলে ঢুকলেন তিনি৷ কারাগারে তাঁর শরীরে বিষ প্রয়োগের অভিযোগ তুলেছেন পুতিন বিরোধী এই রাজনীতিবিদ৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/navalny.com
11 ছবি1 | 11
বরেল বলেছেন, ''এই ঘটনার জন্য কারা দায়ী, আমরা তাদের চিহ্নিত করব। এই কাজটা সহজ নয়। আর আমাদের রাশিয়ার দেয়া তথ্যের উপরই নির্ভর করতে হবে।''
রাশিয়ায় বিরোধীদের আরো সমর্থন?
ইউরোপীয় পলিসি সেন্টারের রাশিয়া বিশেষজ্ঞ মারিয়া ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''ব্যক্তিগত স্তরে নিষেধাজ্ঞা জারি করে খুব একটা লাভ হবে না। এটা প্রতিরোধকের কাজও করবে না।''
তার বক্তব্য, ''রাশিয়ার বিরোধী রাজনীতিকদের পাশে দাঁড়াতে হবে ইইউকে। যে রাজনীতিকদের জীবনের ঝুঁকি আছে, তারা যাতে সপরিবারে ইইউ-র দেশে এসে থাকতে পারেন এবং স্বাধীনভাবে তাদের কাজ চালাতে পারেন, সেই অধিকার তাদের দিতে হবে। তারা দেশ ছাড়তে চাইলে ইইউকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।"
বরেল বলেছেন, ''রাশিয়ার বিক্ষুব্ধদের অনেক ইইউ-র অনেক দেশই রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছে। তবে নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের সম্পর্কে কিছু বলা হয় না।''
জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেয়ারবক বলেছেন, ''অধিকারের চেতনাকে চিরকাল চুপ করিয়ে রাখা যায় না। নাভালনি ছিলেন সেই বিরোধী নেতা, যিনি সাহসের সঙ্গে অধিকারের জন্য লড়াই করেছেন। এছাড়াও রাশিয়ার জেলে এমন অনেক বন্দি আছেন, যারা রাশিয়ায় অধিকারের জন্য লড়াই করতে গিয়ে জেলে বর্বরোচিত অত্যাচার সহ্য করছেন।''
নতুন নিষেধাজ্ঞা প্যাকেজ ২৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে?
ইউক্রেন আক্রমণের পর রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে ইইউ। সেই নিষেধাজ্ঞার মধ্যে আছে রাশিয়ার তেল, গ্যাস ও কয়লা কেনা, যাতায়াত এবং প্রায় দুই হাজার ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকের সম্পত্তি ফ্রিজ করে দেয়া।
ইউক্রেন যুদ্ধের দ্বিতীয় বার্ষিকী আসছে। ইইউ-র কূটনীতিকরা তাই আরো একগুচ্ছ নিষেধাজ্ঞা চালু করতে চলেছেন। একশরও বেশি ব্যক্তি ও সংস্থার বিরুদ্ধে তা চালু হবে। সর্বশেষ নিষেধাজ্ঞা নিয়ে হাঙ্গেরিও সবুজ সংকেত দিয়েছে। হাঙ্গেরির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সোমবার বলেছেন, তারা মস্কোর বিরুদ্ধে নতুন করে নিষেধাজ্ঞা চান না। তবে এই পরিকল্পনার বিরোধিতাও তারা করবেন না। ফলে এই সপ্তাহে নিষেধাজ্ঞার খসড়া অনুমোদিত হতে পারে।
নিষেধাজ্ঞার ফলে রাশিয়ার অর্থনীতির উপর চাপ পড়ে। তা সত্ত্বেও রাশিয়া দাবি করে, নিষেধাজ্ঞা জারি করে তাদের বিপাকে ফেলা যাবে না। মারিয়া বলেছেন, নতুন যে নিষেধাজ্ঞা জারির কথা চলছে, তাতে রাশিয়াকে সামরিক দিক থেকে চাপে ফেলা যাবে না।