রাশিয়ার বিরুদ্ধে সরব হলেন জার্মান চ্যান্সেলর। অভিযোগ, পুটিন-বিরোধী রুশ রাজনীতিক নাভালনিকে বিষ দিয়ে হত্যার ষড়যন্ত্র হয়েছিল।
বিজ্ঞাপন
রাশিয়ার বিরুদ্ধে এ বার মুখ খুললেন জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুটিনের কাছে আলেক্সি নাভালনিকে বিষ দিয়ে হত্যার ষড়যন্ত্রের জবাবদিহি চাইল জার্মানি। বিষয়টি নিয়ে ইউরোপের কূটনৈতিক মঞ্চেও আলোচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জার্মানি।
কিছু দিন আগে রাশিয়া থেকে জার্মানিতে চিকিৎসা করাতে আসেন ভ্লাদিমির পুটিনের সব চেয়ে বড় সমালোচক এবং রাশিয়ায় বিরোধী রাজনীতির নেতা । চিকিৎসকরা তখনই অনুমান করেছিলেন, নাভালনির শরীরে বিষ রয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন, স্নায়ুর ক্ষতি হয়, এমন বিষ দেওয়া হয়েছে নাভালনিকে। সম্প্রতি জার্মান সেনার এক হাসপাতালে ফের নাভালনির শরীরে বিষের পরীক্ষা হয়। স্পষ্ট হয়, তাঁকে বিষ দিয়ে মারার চেষ্টা হয়েছিল। এর পরেই বিষয়টি নিয়ে মুখ খোলেন জার্মান চ্যান্সেলর। বৃহস্পতিবার তিনি বলেছেন, নাভালনিকে যে হত্যার চেষ্টা হয়েছে, তার স্পষ্ট প্রমাণ মিলেছে। এ বার রাশিয়াকেই এর জবাব দিতে হবে। গোটা বিশ্বকে জানাতে হবে, কেন বিরোধী বিরোধী রাজনীতির মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছিল। বস্তুত, রাশিয়াকে অত্যন্ত কড়া ভাষায় আক্রমণ করেছেন ম্যার্কেল। তাঁর বক্তব্য, কী ভাবে এই ঘটনা ঘটল, কারা ঘটালেন এই সমস্ত তথ্য বিশ্বকে জানাতে হবে। রাশিয়াকে সেই দায়িত্ব নিতে হবে।
রাজনীতির ইতিহাসে বিষ দিয়ে হত্যার যত চেষ্টা
রাজনীতির ইতিহাসে বিষ দিয়ে মারার চেষ্টা বহুবার হয়েছে – কখনো সফল, কখনো অসফল৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Sazonov
আলেক্সি নাভালনি
রাশিয়ার বিরোধীদলীয় নেতা ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিনের কট্টর সমালোচক আলেক্সি নাভালনিকে সাইবেরিয়া থেকে জার্মানিতে নেওয়া হয়েছে৷ নাভালনির শরীরে বিষপ্রয়োগ করা হয়েছে বলে ধারণা করছেন সমর্থকরা৷ ১৯ আগস্ট ৪৪ বছর বয়সি সাবেক এই আইনজীবী চা খাওয়ার পর অসুস্থ হয়ে পড়েন৷
ছবি: Getty Images/AFP/K. Kudrayavtsev
সের্গেই স্ক্রিপাল
৬৬ বছর বয়সি সাবেক রুশ গুপ্তচর সের্গেই স্ক্রিপালকে ব্রিটেনের স্যালিসবেরি শহরের একটি শপিং মলের সামনে অজ্ঞান অবস্থায় একটি বেঞ্চের উপর পাওয়া যায়৷ তিনি কোনো অজ্ঞাত বিষের শিকার হয়েছেন বলে পুলিশের ধারণা৷ রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেস্কভ এই পরিস্থিতিকে ‘দুঃখজনক’ বললেও যোগ করেছেন যে, ‘‘(ঘটনার) কারণ কী হতে পারে অথবা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কী করেছেন, সে বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa/Tass
কিম জং নাম
উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের বৈমাত্রেয় ভাই কিম জং নাম ২০১৭ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারি কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে প্রাণ হারান৷ দৃশ্যত দুই নারী তাঁর মুখে ভিএক্স নামের একটি রাসায়নিক মাখিয়ে দিয়েছিলেন৷ মালয়েশিয়ার একটি আদালতে অভিযুক্তদের বিচার চলার সময় জানা যায় যে, আক্রান্ত হওয়ার সময় কিম জং নাম-এর পিঠের ব্যাগে ভিএক্স বিষের ডজন খানেক অ্যাম্পুল ছিল৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/S. Kambayashi
আলেক্সান্ডার লিটভিনেঙ্কো
সাবেক রুশ গুপ্তচর লিটভিনেঙ্কো দেশ ছেড়ে ব্রিটেনে আশ্রয় নেবার পর সাংবাদিকতা শুরু করেন এবং রাশিয়ার ফেডারাল সিকিউরিটি সার্ভিস এফএসবি ও পুটিনের বিরুদ্ধে দু’টি বই লেখেন৷ ২০০৬ সালের ২৩শে নভেম্বর দু’জন সাবেক কেজিবি কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাতের পর লিটভিনেঙ্কো অসুস্থ হয়ে পড়েন ও পরে হাসপাতালে প্রাণত্যাগ করেন৷ সরকারি তদন্তে দেখা যায় যে, তেজস্ক্রিয় পলোনিয়াম-২১০ বিষের ক্রিয়ায় তাঁর মৃত্যু হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Kaptilkin
ভিক্টর কালাশনিকভ
সোভিয়েত কেজিবি গোয়েন্দা বিভাগের সাবেক কর্নেল ভিক্টর কালাশনিকভ তখন সাংবাদিক হিসেবে সস্ত্রীক বার্লিনে বসবাস করছিলেন৷ ২০১০ সালের নভেম্বর মাসে কালাশনিকভ ও তাঁর স্ত্রীকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়৷ সেখানে তাদের রক্তে যথাক্রমে ৩ দশমিক ৭ ও ৫৬ মাইক্রোগ্রাম পারদ পাওয়া যায়৷ স্বাভাবিক অবস্থায় রক্তে এক থেকে তিন মাইক্রোগ্রাম পারদ থাকা নিরাপদ৷পরে এক সাক্ষাৎকারে কালাশনিকভ বলেন, ‘‘মস্কো আমাদের বিষ দিয়েছে৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa/RIA Novosti
ভিক্টর ইউশ্চেঙ্কো
ইউক্রেনের বিরোধী নেতা ইউশ্চেঙ্কো ২০০৪ সালের নভেম্বর মাসে অসুস্থ হয়ে পড়েন ও দেখা যায় যে, একটি ভাইরাল ইনফেকশন ও সেই সঙ্গে রাসায়নিকের বিষক্রিয়ার ফলে তাঁর অ্যাকিউট প্যানক্রিয়াটিস হয়েছে৷ এর ফলে ইউশ্চেঙ্কোর জন্ডিস হয়, মুখ ফুলে যায় এবং ত্বকে এক ধরণের দাগ থেকে যায়, যা ডাইঅক্সিন বিষের প্রভাবে ঘটে থাকতে পারে বলে চিকিৎসকদের ধারণা৷ সরকারি চররা তাঁকে বিষ দিয়েছে বলে ইউশ্চেঙ্কো দাবি করেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Leodolter
খালেদ মেশাল
১৯৯৭ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর তারিখে ইসরায়েলের গুপ্তচর বিভাগ হামাস নেতা খালেদ মেশালকে হত্যা করার চেষ্টা করে৷ কথিত আছে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু স্বয়ং নাকি হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন৷ মেশাল জর্ডানের আম্মানে অবস্থিত হামাসের কার্যালয় থেকে বেরোনোর সময় দু’জন ইসরায়েলি গুপ্তচর তাঁর কানে কোনো বিষাক্ত পদার্থ স্প্রে করে৷ মেশাল অক্ষতই থাকেন এবং পরে ঐ দুজন ইসরায়েলি গুপ্তচরকে ধরাও সম্ভব হয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Sazonov
গেয়র্গি মার্কভ
১৯৭৮ সালে বুলগেরীয় সরকারবিরোধী মার্কভ বিবিসি-তে কাজ শেষ করে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন – হঠাৎ কিছু একটা তাঁর থাই ফুঁড়ে দেয়৷ ওদিকে মার্কভ দেখেন, এক পথচারী তার ছাতা মাটি থেকে তুলছে৷ ছুঁচ ফোটার জায়গাটা ফুলে উঠে চারদিনের মধ্যে মার্কভ প্রাণ হারান৷ ময়না তদন্ত বলে, একটি শূন্য দশমিক দুই মিলিগ্রাম রিসিন বিষের পেলেট থেকে মার্কভের মৃত্যু ঘটেছে৷ পথচারীর ছাতা থেকেই পেলেটটা ছোঁড়া হয়েছিল, বলে অনেকের বিশ্বাস৷
ছবি: picture-alliance/dpa/epa/Stringer
গ্রিগরি রাসপুটিন
রুশ বিপ্লবের ঠিক আগে রাসপুটিন একজন আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন গুনিন হিসেবে পরিচিত ছিলেন৷ ১৯১৬ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর তিনি সেন্ট পিটার্সবার্গের ইয়ুসুপভ প্রাসাদে আসেন প্রিন্স ফেলিক্স ইয়ুসুপভের আমন্ত্রণে৷ প্রিন্স ইয়ুসুপভ তাঁকে পটাসিয়াম সায়ানাইড বিষ মাখানো কেক খেতে দেন ও সায়ানাইড মাখানো পাত্রে সুরা পরিবেশন করেন৷ সেই বিষাক্ত কেক ও সুরা থেকে রাসপুটিনের কিছুই হয় না৷ অতঃপর রাসপুটিনকে গুলি করে হত্যা করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/ IMAGNO/Austrian Archives
9 ছবি1 | 9
রাশিয়ায় বিক্ষোভে পিটুনি-ধরপাকড়
রাশিয়ায় অবসরে যাওয়ার বয়স বাড়ানোর পরিকল্পনার বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারীদের ব্যাপক পিটুনি ও ধরপাকড় করেছে পুলিশ৷ রাজধানী মস্কোসহ ৮০টির বেশি শহরে এই বিক্ষোভ থেকে আটশ’র বেশি মানুষকে আটক করা হয় বলে একটি মানবাধিকার সংগঠন জানিয়েছে৷
ছবি: Reuters/S. Karpukhin
বয়স বৃদ্ধির প্রতিবাদ
অবসরে যাওয়ার বয়স পাঁচ বছর বাড়িয়ে পুরুষের জন্য ৬৫ এবং নারীদের জন্য ৬০ বছর করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার৷ এই পদক্ষেপের কারণে প্রেসিডেন্ট পুতিনের জনপ্রিয়তা ২০০৫ সালের পর সবচেয়ে কমেছে বলে জনমত জরিপে উঠে এসেছে৷ এই উদ্যোগ থেকে সরে আসার দাবিতে রোববার দেশজুড়ে বিক্ষোভের অংশ হিসেবে মস্কোয় কবি আলেক্সান্ডার পুশকিনের ভাস্কর্যের সামনে সমবেত জনতা৷
ছবি: Reuters/G. Dukor
‘চোর’
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ছবি ব্যবহার করে তৈরি পোস্টারে লেখা হয়েছে ‘চোর’৷ পেনশনের বয়স বৃদ্ধির প্রতিবাদে এই বিক্ষোভের ডাক দিয়েছিল কারাবন্দি বিরোধী নেতা আলেক্সেই নাভালনি ও তাঁর সমর্থকরা৷
ছবি: Reuters/A. Vaganov
ব্যাপক মারপিট
সারা দেশে একযোগে বিক্ষোভের অংশ হিসেবে রাজধানী মস্কোর রাস্তায় নামলে আন্দোলনকারীদের ব্যাপক পিটুনি দেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা৷ ছবিতে এক বিক্ষোভকারীকে পেটাচ্ছে দেশটির ন্যাশনাল গার্ডের সদস্যরা৷
ছবি: Reuters/S. Karpukhin
কাঁদুনে গ্যাস
মস্কোর সেন্ট পিটার্সবুর্গে বিক্ষোভ দমনে লাঠিপেটার পাশাপাশি বহু কাঁদুনে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে পুলিশ৷
ছবি: Reuters/A. Vaganov
গ্রেপ্তার
রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবুর্গে বিক্ষোভ থেকে এক যুবককে ধরে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ৷ বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পিটুনির পাশাপাশি ব্যাপক হারে আটকও করা হয়৷ এদিন মস্কোয় মোট ৩৫৪ জনকে আটক করা হয়, যাঁদের মধ্যে প্রায় ১০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয় সেন্ট পিটার্সবুর্গ থেকে৷
ছবি: Reuters/A. Vaganov
বৃদ্ধরাও ছাড় পাননি
বর্তমানে পার্লামেন্টে পাশের অপেক্ষায় থাকা অবসরের বয়স পরিবর্তনের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে প্রবীণদের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখ করার মতো৷ বিক্ষোভ দমনে ধরপাকড়ের সময় তাঁদেরও ছাড় দেওয়া হয়নি৷
ছবি: Reuters/A. Vaganov
বেকায়দায় সাধারণ মানুষ
মস্কোর সেন্ট পিটার্সবুর্গে বিক্ষোভ দমাতে রাস্তায় নামে বহু সংখ্যক পুলিশ৷ এক পর্যায়ে দুই পক্ষের সংঘর্ষে বেকায়দায় পড়েন সাধারণ পথচারী৷ উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে একটি মেয়েকে কাঁধে করে পুলিশ ব্যারিকেড পেরিয়ে আসছেন একজন৷
ছবি: Reuters/S. Karpukhin
‘আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা’
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বিক্ষোভকারীদের ওপর দমনপীড়নের সমালোচনা করলেও রুশ প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি পেশকভ বলেছেন, অননুমোদিত বিক্ষোভ দমাতে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়েছে পুলিশ৷
ছবি: Reuters/A. Vaganov
8 ছবি1 | 8
এর আগেও জার্মানি নাভালনির উপর আক্রমণের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছিল। সূত্র জানাচ্ছে, বার্লিনে অবস্থিত রাশিয়ার দূতাবাসের রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছেন জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তাঁর কাছেও বিষয়টি নিয়ে জানতে চাওয়া হবে। ন্যাটো এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নেও জার্মানি বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চাইবে বলে কূটনৈতিক সূত্রে জানানো হয়েছে। জার্মানি বিষয়টিকে সরাসরি হত্যার ষড়যন্ত্র বলে দাবি করবে আন্তর্জাতিক মঞ্চে।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, শরীরে বিষ থাকলেও নাভালনির শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল। রাশিয়ায় পুটিনের সব চেয়ে বড় সমালোচক নাভালনি। পুটিনের বিরুদ্ধে জনমতও তৈরি করতে পেরেছেন তিনি। সে কারণেই তাঁকে হত্যার চেষ্টা হয়েছিল বলে বিশেষজ্ঞ মহলের ধারণা।