ভারতের নতুন দিল্লির রিকশা চালক নারোতান সিং নারী বা মেয়েদের সমস্যা নিয়ে কখনো আগ্রহী ছিলেন না৷ অন্য লিঙ্গের সঙ্গে তার যোগাযোগ মূলত মা, স্ত্রী এবং মেয়ের সঙ্গেই সীমাবদ্ধ৷
বিজ্ঞাপন
তবে রিকশা চালাতে গিয়ে প্রতিদিনই অনেক নারীর সঙ্গে দেখা হয় নারোতানের৷ টাইট-ফিটিং জিন্স বা স্কার্ট পরা মেয়েদের দিকে তিনি আড় চোখে তাকাতেন৷ রিকশায় থাকা পেছনের দিকে দেখার আয়নায় এসব পোশাকের মেয়েদের দিকে দৃষ্টিকটুভাবে তাকানো তার কাছে ছিল নিত্যদিনের ব্যাপার৷
তবে গতমাসে এক প্রশিক্ষণে অংশ নেয়ার পর আমূল বদলে গেছেন ৩৭ বছর বয়সি রিকশা চালক নারোতান৷ ‘লিঙ্গ সংবেদনশীলতা' বিষয়ক এই প্রশিক্ষণের আয়োজক দাতা সংস্থা ‘মানাস ফাউন্ডেশন' এবং ‘দিল্লি ট্রান্সপোর্ট অথরিটি'৷ নারোতান এই বিষয়ে বলেন, ‘‘প্রশিক্ষণের আগে মনে হয়েছিল, এটা আসলে সময়ের অপচয়৷ এই সময়টা বরং রিকশা চালিয়ে কিছু উপার্জন করা যেতো৷''
কলকাতার হাতে টানা রিকশার একাল
কলকাতার কোনো কোনো জায়গায় এখনো হাতে টানা রিকশার চল রয়েছে৷ যদিও সংখ্যাটা দিনদিন কমছে৷ আর কতদিন থাকবে? চলুন জানার চেষ্টা করি এই ছবিঘরে৷
ছবি: DW/S. Bandopadhayay
যবে থেকে শুরু
হাতে টানা রিকশার উদ্ভাবন ১৬ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, জাপানে৷ ১৯ শতকে যানটি গোটা এশিয়ায় বহুল ব্যবহৃত এক গণ-বাহন হয়ে দাঁড়ায়৷ ১৮৮০ সালে ভারতে প্রথম রিকশা চালু হয় হিমাচল প্রদেশের সিমলায়৷ সেখান থেকে হাতে টানা রিকশা চলে আসে কলকাতায়৷ ১৯১৪ সাল নাগাদ কলকাতায় ভাড়াটে রিকশার চলন হয়৷ এরপর এত বছর পরেও কলকাতার কোনো কোনো অঞ্চলে টিকে আছে এই হাতে টানা রিকশা৷
ছবি: DW/S. Bandopadhayay
প্রধান সড়ক থেকে গলিতে
কলকাতার প্রধান সড়কপথগুলোতে এখন অবশ্য আর রিকশা চলাচলের অনুমতি দেয় না পুলিশ৷ তার প্রথম কারণ রিকশার মতো ধীরগতির যানের কারণে রাস্তায় যানজট তৈরি হয়৷ তবে অন্য আর একটি কারণ হলো, আজকের দিনে রিকশার সওয়ারি হওয়া নিরাপদও নয়৷ ফলে কিছুটা বাধ্য হয়েই রিকশারা আশ্রয় নিয়েছে পুরনো কলকাতার গলি-ঘুঁজিতে, যেখানে ব্যস্ত ট্রাফিকের তাড়াহুড়ো নেই৷ রিকশায় চড়ে দুলকি চালে সফর করাও উত্তর কলকাতার অনেক বাসিন্দারই এখনও পছন্দসই৷
ছবি: DW/S. Bandopadhayay
এখনো ব্যবহারের কারণ
আধুনিক কোনো যন্ত্রচালিত যানের সঙ্গে গতি বা স্বাচ্ছন্দ্যে পাল্লা দিতে পারে না আদ্যিকালের রিকশা৷ তা-ও এটি কী করে কলকাতায় থেকে গেল, তার কিছু নির্দিষ্ট কারণ আছে৷ এখনও অনেক বয়স্ক মানুষ রিকশা চড়তে পছন্দ করেন কারণ, এই যানটি তাঁদের জন্য যাকে বলে একেবারে হ্যাসল-ফ্রি৷ ঠিক একই কারণে অনেক বাড়ির বাচ্চারাও স্কুলে যাওয়ার সময় রিকশায় চড়ে যায়৷ তবে কলকাতা শহরে রিকশার সবথেকে বড় উপযোগিতা বোঝা যায় বর্ষায়৷
ছবি: DW/S. Bandopadhayay
রিকশার ওয়ার্কশপ
যেহেতু শহরের রাস্তায় এখনও রিকশা চলে, মেরামতির জন্য রিকশার নিজস্ব হাসপাতালও নেই নেই করে এখনও দু-একটি টিকে আছে৷ এগুলো বিশেষভাবে হাতে টানা রিকশার মেরামতির জন্যই৷ অন্য কোনও কাজ এখানে হয় না৷ তবে আজকাল অসুবিধে হয়, কারণ রোজগার প্রতিদিনই কমছে৷ কাজ জানা লোকেরও অভাব৷ যদিও বা লোক পাওয়া গেল, তাদের দেওয়ার মতো যথেষ্ট কাজ পাওয়া যায় না৷ দোকানের মালিক শুয়ে বসেই দিন গুজরান করেন৷
ছবি: DW/S. Bandopadhayay
কাঠ দিয়ে তৈরি চাকা
রিকশা তৈরি বা মেরামতিতে কিন্তু এখনও সেই পুরনো পদ্ধতিই বহাল৷ রিকশার চাকা যেমন এখনও কাঠ দিয়েই তৈরি হয়৷ মাঝখানের অংশটা যথারীতি লোহার, কিন্তু বাকি চাকার জন্য কারিগরদেরই জোগাড় করে আনতে হয় উঁচু মানের কাঠ যা শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা শহরের খানা-খন্দে ভরা এবড়ো খেবড়ো রাস্তা দিয়ে রিকশাকে গড়গড়িয়ে নিয়ে যাবে৷ সওয়ারিকে নিয়ে রিকশা যাতে ভেঙে না পড়ে, তার জন্য ভালো কাঠ বা লোহা যেমন দরকার, তেমনই দরকার ওস্তাদ কারিগর৷
ছবি: DW/S. Bandopadhayay
খড় দিয়ে তৈরি বসার গদি
সওয়ারিদের যাতে কষ্ট না হয়, সেজন্যও রিকশাওয়ালারা সমান যত্নবান৷ যাত্রীদের বসার গদিটি যাতে ঠিকঠাক থাকে, এর জন্য নিয়মিত তার পরিচর্যা হয়৷ কাপড় আর রঙিন প্লাস্টিকের তৈরি এই গদির খোলে কী থাকে জানেন তো? না, তুলো বা ফোম নয়, নির্ভেজাল খড়৷ প্রকৃতি-বান্ধব উপাদান ব্যবহার করার এমন নমুনা কি আর কোনো শহুরে যানের ক্ষেত্রে দেখেছেন? রিকশা দূষণ ছড়ায় না, এটাও একটা খেয়াল রাখার মতো বিষয়৷
ছবি: DW/S. Bandopadhayay
অমানবিক
তবু হাতে টানা রিকশা উঠে যাচ্ছে কলকাতা থেকে৷ কারণ, একজন মানুষ আর একজন মানুষকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, এটা অনেকের কাছেই খুব অমানবিক মনে হয়৷ সাইকেল রিকশাতে যদিও একই ঘটনা ঘটে, কিন্তু সেক্ষেত্রে চালক প্যাডেলের মাধ্যমে কিছুটা যান্ত্রিক সুবিধা পান৷ যদিও এই রিকশা নিয়ে রোমান্টিকতার কোনো শেষ নেই৷ পরিচালক বিমল রায়ের ‘দো বিঘা জমিন’ ছবির গোটা ক্লাইম্যাক্স সিনটিই গড়ে উঠেছে দুটি হাতে টানা রিকশার রেষারেষির মধ্য দিয়ে৷
ছবি: DW/S. Bandopadhayay
সময় কি বিদায় নেয়ার?
তাই দিনের শেষে পড়ন্ত সূর্যের আলোয় যখন ছায়া দীর্ঘতর হয়, আর রাস্তার একধারে স্থবির হয়ে অপেক্ষায় থাকে সওয়ারি না পাওয়া একটি রিকশা, ব্যস্ত শহর তার পাশ দিয়ে ছুটে যেতে যেতে তার কর্কশ কলরবে যেন বারবার মনে পড়িয়ে যায়, এবার সময় হয়েছে বিদায় নেওয়ার৷ আধুনিক সময়ের গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে না রিকশা৷ সে কারণেই রাজপথ থেকে সরে গিয়ে তাকে মুখ লুকোতে হয়েছে গলিতে৷ খুব শিগগিরই বোধহয় সেই আড়ালটুকুও যাবে৷
ছবি: DW/S. Bandopadhayay
8 ছবি1 | 8
কিন্তু প্রশিক্ষণের পরে তাঁর মনোভাব বদলে গেছে৷ তিনি জানান, ‘‘দিল্লির রাস্তায় মেয়েরা কতরকম সমস্যায় পড়ে তা আমি প্রশিক্ষণে জানতে পেরেছি৷ আমি বুঝতে পেরেছি এসব সমস্যা সমাধানে আমারও ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে৷''নারোতান হচ্ছেন দিল্লির চল্লিশ হাজার রিকশা চালকের একজন যারা এক ঘণ্টার এই প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছেন৷ এখন তারা ইতোমধ্যে ‘ধর্ষণের রাজধানী' হিসেবে পরিচিতি পাওয়া দিল্লির রাস্তায় নারীদের নিরাপদ চলাফেরা নিশ্চিতে ভূমিকা রাখছেন৷ নারীদের সম্মানের চোখে দেখে এই সমস্যা অনেকটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব৷
ভারতের জাতীয় ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ভারতে ২০১৩ সালে ধর্ষণের পরিমাণ আগের চেয়ে ৩৫ দশমিক দুই শতাংশ বেড়ে ৩৩,৭০৭-তে পৌঁছেছে৷ সেবছর শুধু নতুন দিল্লিতে ধর্ষণের ১,৪৪১টি ঘটনা পুলিশ নথিভুক্ত করেছে৷
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০১২ সালের ডিসেম্বরে ২৩ বছর বয়সি এক নারীকে বাসের মধ্যে গণধর্ষণের ঘটনা সংবাদ মাধ্যমে ফলাও করে প্রচার হয়৷ ধর্ষণ এবং নির্যাতনে গুরুতর আহত নারীটি চিকিৎসারত অবস্থায় কিছুদিন পরে মারা যান৷ সেই ঘটনায় টনক নড়ে ভারতবাসীর৷ ধর্ষণ প্রতিরোধের বিষয়টি সামনে চলে আসে৷
মানাস ফাউন্ডেশনের স্মিতা তেওয়ারি পান্ত জানান, ‘‘আমরা প্রশিক্ষণে রিকশা চালকদেরকে ধর্ষণের ভয়াবহ পরিসংখ্যান তুলে ধরি৷ এই পরিস্থিতি বদলে কি করা উচিত তাও তাদের জানানো হয়৷ পাশাপাশি এটাও মনে করিয়ে দেয়া হয় যে, এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে দিল্লিতে পর্যটকদের সংখ্যা কমে যাবে৷ তখন আর্থিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়বে রিকশা চালকরা৷''
নতুন দিল্লিতে অটো-রিকশা চালকের সংখ্যা ১২০,০০০৷ এই চালকদের এখন থেকে প্রতি বছর একঘণ্টা ‘লিঙ্গ সংবেদনশীলতা' বিষয়ক প্রশিক্ষণে অংশ নিতে হবে৷ নারোতান মনে করেন ট্যাক্সি এবং বাস চালকদেরও এই প্রশিক্ষণ দেয়া উচিত৷ তাহলে তাঁর মতো তারাও নারীকে আর পোশাক দেখে মাপার চেষ্টা করবে না৷ বরং তাদের নিত্যদিনের সমস্যা বোঝার চেষ্টা করবে, নিরাপদে পৌঁছে দেবে তাদের গন্তব্য৷