নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের দায়ে ১৩ জনের ১০ বছরের জেল
১৪ ডিসেম্বর ২০২১
নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার একলাশপুরে এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের মামলায় স্থানীয় সন্ত্রাসী দল দেলোয়ার বাহিনীর প্রধানসহ ১৩ আসামিকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত৷
বিজ্ঞাপন
ডয়চে ভেলের কনটেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানায়, মঙ্গলবার ৬০ পৃষ্ঠার এ রায় ঘোষণা করেন জেলার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক জয়নাল আবেদীন৷
রায়ের সময় আসামিদের মধ্যে কারাগারে থাকা নুর হোসেন বাদল, আবদুর রহিম, আবুল কালাম, ইসরাফিল হোসেন মিয়া, মাঈন উদ্দিন সাজু, সামছুদ্দিন সুমন কনট্রাকটর, নুর হোসেন রাসেল, আনোয়ার হোসেন সোহাগ ও দেলোয়ার হোসেন দেলুকে আদালতে হাজির করা হয়৷ বাকি চার আসামি আবদুর রব চৌধুরী, মোস্তাফিজুর রহমান, জামাল উদ্দিন ও মিজানুর রহমান তারেককে পলাতক দেখিয়ে মামলার বিচার কাজ চলে৷
১৩ আসামিকেই বিচারক ১০ বছরের কারাদণ্ড ছাড়াও ৫০ হাজার করে জরিমানা করেছেন জানান রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মামুনুর রশীদ লাভলু৷ এ মামলার বাদী ভুক্তভোগী সেই নারীও চাঞ্চল্যকর এ মামলার রায় দেওয়ার সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন৷ তার আইনজীবী মোল্লা হাবিবুর রাসুল মামুন তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন৷
আদালতে উপস্থিত বিভিন্ন মানবাধিকার ও নারী অধিকার সংগঠনের নেতারাও এই রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন৷
২০২০ সালের ২ সেপ্টেম্বর একলাশপুর ইউনিয়নের জয়কৃষ্ণপুর গ্রামে স্থানীয় সন্ত্রাসী দল দেলোয়ার বাহিনীর সদস্যরা মধ্যবয়সী এক নারীকে ঘরে ঢুকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন করে৷
বিচারকদের আলোচিত পর্যবেক্ষণ, রায়
বাংলাদেশ ও ভারতে বিচারকদের দেয়া পর্যবেক্ষণ ও রায় কখনও কখনও আলোচনার জন্ম দিয়েছে৷ এ বছরই ধর্ষণ মামলার শুনানির সময় ভারতের প্রধান বিচারপতির করা দুটি মন্তব্যের কারণে তার পদত্যাগের দাবি উঠেছিল৷
ছবি: bombayhighcourt.nic.in
বুকে হাত দেয়ার বিচার সম্ভব নয়!
গত জানুয়ারিতে ভারতের বম্বে হাইকোর্টের বিচারপতি পুষ্প গনেড়িওয়ালার দুটি পর্যবেক্ষণ আলোচনার জন্ম দিয়েছিল৷ তিনি বলেছিলেন, যৌন অপরাধের হাত থেকে শিশুদের নিরাপদ রাখার ‘পকসো’ আইনের সংজ্ঞা অনুযায়ী পাঁচ বছরের মেয়ে শিশুর হাত ধরা ও ট্রাউজারের চেন খোলা যৌন হেনস্থা নয়৷ এর কয়েকদিন আগে দেয়া আরেক পর্যবেক্ষণে তিনি বলেছিলেন, ১২ বছরের মেয়ের বুকে হাত দেয়ার ঘটনায় ত্বকে-ত্বকে স্পর্শ না হওয়ায় পকসো আইনে বিচার সম্ভব নয়৷
ছবি: bombayhighcourt.nic.in
স্থায়ী নিয়োগ হলো না
গনেড়িওয়ালার প্রথম পর্যবেক্ষণে স্থগিতাদেশ জারি করেছিল সুপ্রিম কোর্ট৷ গনেড়িওয়ালা এমন সময় ঐ পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলেন যখন বিচারপতি হিসেবে তার নিয়োগ স্থায়ী করতে সুপ্রিম কোর্ট কলেজিয়াম সুপারিশ করেছিল৷ দ্বিতীয় পর্যবেক্ষণের পর সেই সুপারিশ বাতিল করে তাকে দুই বছরের জন্য নিয়োগের সুপারিশ করা হয়৷ তবে সরকার সেটিও কমিয়ে তাকে এক বছরের জন্য নিয়োগ দেয়৷
ছবি: Anil Dave/Dinodia Photo/imago images
রেইনট্রি হোটেলকাণ্ড
রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণ মামলার বিচার শেষে বৃহস্পতিবার সব আসামির খালাসের রায় দেন ঢাকার ৭ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক বেগম মোছা. কামরুন্নাহার৷ রায়ের পর গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয় যে, রায় ঘোষণার সময় তিনি ধর্ষণের অভিযোগের ক্ষেত্রে ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলে পুলিশ যেন মামলা না নেয়, সেই নির্দেশনা দিয়েছেন৷ এরপর সমালোচনা হলে রোববার তার বিচারিক ক্ষমতা সাময়িকভাবে প্রত্যাহার করা হয়৷
ছবি: MAHMUD ZAMAN OVI/bdnews24.com
তবে লিখিত রায়ে যা আছে
মঙ্গলবার রাতে মামলার লিখিত রায় প্রকাশিত হয়৷ রায়ে বিচারক লিখেছেন, অনেক দিন পর মামলা হলে যৌন সহিংসতার প্রমাণ পাওয়া যায় না৷ মামলা করার সময় যদি বিষয়টি দেখা হয়, ৭২ ঘণ্টার মধ্যে যদি মেডিকেল পরীক্ষা করা হয় এবং ফরেনসিক পরীক্ষায় যদি প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে ধর্ষণ মামলায় তা গুরুত্বপূর্ণ নথি বলে গণ্য হয়৷ তখন ধর্ষণ মামলার অভিযুক্ত ব্যক্তির বিচার নিশ্চিত করা যায় এবং ন্যায়বিচার সর্বোত্তমভাবে করা সম্ভব হয়৷
ছবি: bdnews24.com
ধর্ষককে ধর্ষিতাকে বিয়ের প্রস্তাব
গত মার্চে ভারতের প্রধান বিচারপতি শারদ বোবদে এক মামলার শুনানির সময় ধর্ষণের অভিযোগ ওঠা এক সরকারি কর্মচারীকে ধর্ষিতাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন৷ তিনি বলেছিলেন, ‘‘আপনি যদি তাকে বিয়ে করেন তাহলে আমরা সহায়তা করতে পারি৷ তা না হলে আপনি চাকরি হারাবেন, জেলে যাবেন৷’’ ঐ ব্যক্তি ১৬ বছর বয়সি ঐ মেয়েকে বেঁধে রেখে, মুখে কাপড় গুঁজে বারবার ধর্ষণ করেছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছিল৷ এছাড়া হত্যারও হুমকি দিয়েছিল৷
ছবি: IANS
পদত্যাগ চেয়ে চিঠি
বোবদের (বামে) পদত্যাগের দাবি জানিয়ে লেখা এক চিঠিতে বলা হয়, ‘‘ধর্ষককে ধর্ষিতাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়ে আপনি, ভারতের প্রধান বিচারপতি, মেয়েটিকে এমন একজন নির্যাতনকারীর হাতে তুলে দিতে চেয়েছেন যে তাকে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দিয়েছিল৷ তার হাতে আপনি মেয়েটিকে সারাজীবন ধর্ষণের জন্য তুলে দিতে চেয়েছেন৷’’ নারী অধিকার কর্মী ও বিভিন্ন সংস্থায় কর্মরত ব্যক্তিসহ পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ ঐ চিঠিতে সই করেছিলেন৷
ছবি: IANS
দম্পতির মধ্যে যৌন মিলন কি ধর্ষণ?
প্রায় একই সময়ে আরেক মামলার শুনানিতে করা বোবদের (ডানে) আরেক বক্তব্যও আলোচনার জন্ম দেয়৷ বিবাহিত দম্পতির মধ্যে যৌন মিলন কখনও ধর্ষণের পর্যায়ে পড়ে কিনা সেই প্রশ্ন তুলেছিলেন তিনি৷ ‘‘স্বামী হয়ত বর্বর হতে পারেন৷ কিন্তু আপনি কি একজন বৈধভাবে বিবাহিত পুরুষ ও স্ত্রীর মধ্যে যৌন মিলনকে ধর্ষণ বলতে পারেন?’’ বোবদে পদত্যাগ করেননি৷ পরের মাসে স্বাভাবিক মেয়াদ শেষ করে তিনি অবসরে গিয়েছিলেন৷
ছবি: IANS
‘ময়ূর ব্রহ্মচারী পাখি, সেক্স করে না’
২০১৭ সালে ভারতের রাজস্থান হাইকোর্টের বিচারপতি মহেশচন্দ্র শর্মা তার শেষ কর্মদিবসে দেয়া নির্দেশনায় গরুকে জাতীয় পশু ঘোষণা ও গো-হত্যায় দোষী সাব্যস্তদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সুপারিশ করেছিলেন৷ পরদিন তার বিদায়ী সংবর্ধনা আনুষ্ঠানে বলেন, ‘‘অনেকেই জানেন না, সারাজীবন ব্রহ্মচারী থাকে ভারতের জাতীয় পাখি ময়ূর৷ তার চোখের জলের মাধ্যমেই সন্তানের জন্ম দেয় ময়ূরী৷ ভগবান শ্রীকৃষ্ণও ময়ূরের পালক মাথায় ধারণ করেছিলেন৷’’
ছবি: Reuters/T. Melville
বিচারক বদলাতে সরকারের প্রস্তাব
২০১৭ সালের স্বাধীনতা দিবসের আমন্ত্রণপত্রে দুই শিশুর আঁকা বঙ্গবন্ধুর ছবি ব্যবহার করেন বরিশালের আগৈলঝাড়ার তৎকালীন ইউএনও তারিক সালমন৷ এই ঘটনায় তার বিরুদ্ধে ‘বঙ্গবন্ধুর ছবি বিকৃত করে ছাপানোর’ অভিযোগে মামলা হলে সালমনকে কারাগারে পাঠান বরিশালের মুখ্য মহানগর হাকিম আলী হোসাইন৷ অবশ্য দুই ঘণ্টা পর তিনিই তার জামিন মঞ্জুর করেন৷ এই ঘটনায় আলী হোসাইনকে বদলির জন্য সুপ্রিম কোর্টে প্রস্তাব পাঠিয়েছিল সরকার৷
ছবি: bdnews24.com
হাস্যকর রায়?
২০১৭ সালে খুলনায় এক অনুষ্ঠানে ছাগল বিতরণ করেন প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ৷ পরে ফেসবুকে স্থানীয় সাংবাদিক আব্দুল লতিফ মোড়ল লেখেন, ‘প্রতিমন্ত্রীর সকালে বিতরণ করা ছাগলের রাতে মৃত্যু’৷ পোস্টে প্রতিমন্ত্রীর ছবি ব্যবহার করায় তার মানহানি হয়েছে এই অভিযোগে মামলা হলে লতিফকে কারাগারে পাঠান সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমলী আদালত ‘খ’ অঞ্চলের বিচারক নুসরাত জাবিন৷ একদিন পর তিনি তাকে জামিন দেন৷
ছবি: picture alliance/AP/The Flint Journal,Jake May
10 ছবি1 | 10
ঘটনার একমাস পর মোবাইল ফোনে ধারণ করা একটি ভিডিও ৪ অক্টোবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়৷ সন্ত্রাসীদের ভয়ে আত্মগোপনে থাকা ওই নারীকে ওইদিনই উদ্ধার করে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়৷ ঘটনাটি সাড়া দেশে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দেয়৷এবং বিভিন্ন সংগঠন নিপীড়কদের গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে প্রতিবাদী কর্মসূচি পালন করে৷
পরে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন এবং পর্ণগ্রাফি আইনে বেগমগঞ্জ মডেল থানায় দুটি মামলা করেন ওই নারী৷
তিনি একই থানায় আরেকটি মামলা করেন, যেখানে ২০১৯ সালের ৫ অক্টোবর এবং ২০২০ সালের ৭ এপ্রিল দুই দফায় তাকে ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয় স্থানীয় সন্ত্রাসী দল দেলোয়ার বাহিনীর প্রধান দেলোয়ার হোসেন দেলু ও তার সহযোগী আবুল কালামের বিরুদ্ধে৷
গত ৪ অক্টোবর ওই ধর্ষণ মামলায় রায়ে দেলোয়ার ও কালামকে যাব্বজীবন করাদণ্ড দেয় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল৷
বিবস্ত্র করে নির্যাতনের এ মামলায় মোট ১৪ আসামির বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ৷ পরে স্থানীয় ইউপি সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন সোহাগকে মামলার থেকে অব্যাহতি দিয়ে ১৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করে আদালত৷
বাদীসহ ৪০ জনের সাক্ষ্য শুনে আসামিদের সবাইকে দোষী সাব্যস্ত করে এ রায় দিয়েছেন বিচারক জয়নাল আবেদীন৷