নারীরা কেন নিকাহ রেজিস্ট্রার হতে পারবেন না?
১১ জানুয়ারি ২০২১দিনাজপুরের ফুলবাড়িয়া পৌরসভার আয়েশা সিদ্দিকা ফাজিল পাশ৷ নিকাহ রেজিস্ট্রার পদে তিনি নিয়ম মেনেই আবেদন করেছিলেন৷ পরীক্ষাও দিয়েছেন৷ পরীক্ষায় তিনি হয়েছিলেন প্রথম৷ তারপরও তার নিকাহ রেজিস্ট্রার হওয়ার পথ আদালতের রায়ে আপাতত বন্ধ৷ আপাতত বলা হচ্ছে একারণে যে হাইকোর্টই শেষ আদালতনয়৷ এরপর আপিল বিভাগ আছে৷ এরইমধ্যে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল ফাইল করা হয়েছে৷
নিকাহ রেজিস্ট্রার হওয়ার জন্য সরকারি প্রজ্ঞাপনে তিনটি যোগ্যতার কথা বলা হয়েছে:
১.সরকার স্বীকৃত কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা মাদ্রাসাবোর্ডের নিবন্ধিত কোনো মাদ্রাসা থেকে কমপক্ষে আলিম সার্টিফিকেটধারী হতে হবে
২. বয়স কমপক্ষে ২১ এবং সবোচ্চ ৪৫ বছর হতে হবে
৩. সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দা হতে হবে
এই তিন যোগ্যতাই আছে আয়েশা সিদ্দিকার৷ তারপরও নারী হওয়ায় প্রথমে মন্ত্রণালয় এবং পরে হাইকোর্ট বলেছেন বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিবেচনায় নারীরা নিকাহ রেজিস্ট্রার হতে পারবেন না৷
আয়েশা সিদ্দিকার কথা, ‘‘যোগ্যতার কোথাও বলা হয়নি নিকাহ রেজিস্ট্রার হতে হলে পুরুষ হতে হবে৷ আর আমি ফাজিল পাশ৷ আলিমেরও এক ধাপ উপরে৷ তারপরও আমি কেন পারব না৷'' তার কথা, ‘‘তারা যা বলছেন তা আইনের ভাষা নয়৷''
২০১৪ সালে এই রিটের শুরু৷ হাইকোর্ট রিট খারিজ করে দেয়ার পর রবিবার পূর্নাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়েছে৷ বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী ও বিচারপতি কাজী জিনাত হকের এই রায়ে বলা হয়েছে, ‘‘নারীরা মাসের একটি নির্দিষ্ট সময় ফিজিক্যাল ডিসকোয়ালিফেশনে থাকেন৷ সেক্ষেত্রে মুসলিম বিবাহ হচ্ছে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং আমাদের দেশে বেশিরভাগ বিয়ে মসজিদে পড়ানো হয়ে থাকে৷ ওই সময়ে নারীরা মসজিদে প্রবেশ করতে পারেন না এবং তারা নামাজও পড়তে পারেন না৷ সুতরাং বিয়ে যেহেতু একটা ধর্মীয় অনুষ্ঠান, সেহেতু এই বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে নারীদের দিয়ে নিকাহ রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পালন সম্ভব নয়৷ ফলে নারীরা নিকাহ রেজিস্ট্রার (কাজী) হতে পারবেন না৷''
কিন্তু নিকাহ রেজিস্ট্রারের কাজ কী? তাদের কাজ বিয়ে পড়ানো নয়, বিয়ে রেজিস্ট্রি করা৷ বিয়ে যে কোনো মাওলানা পড়াতে পারেন৷ বিয়ের নিয়ম কানুন জানা যে কোনো সুস্থ বিবেক সম্পন্ন মুসলমান যে কোনো প্রাপ্ত বয়স্ক মুসলমান মুসলিম নর-নারীর বিয়ে পড়াতে পারেন৷ আর নিকাহ রেজিস্ট্রার সেটা আইন অনুযায়ী রেজিস্ট্রেশন করবেন৷ এজন্য নিকাহ রেজিস্ট্রারকে বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়া বাধ্যতামূলক নয়৷ ধানমণ্ডি কাজি অফিসের নিকাহ রেজিস্ট্রার হাফেজ মাসুম বিল্লাহ জানান, ‘‘বিয়ে সম্পর্কে জ্ঞান আছে এরকম যেকোনো মুসলমান পড়াতে পারেন৷ আমাদের এখানে এসে বিয়ের পর সাক্ষীসহ নির্ধারিত ফি দিয়ে রেজিস্ট্রি করতে হয়৷ তবে আমাদের বললে আমরা গিয়ে বিয়ে পড়াই৷ তবে এটা বাধ্যতামূলক নয়৷ আর সব সময় যে নিকাহ রেজিস্ট্রার বিয়ে পড়াতে যান তাও নয়৷ আমরা কোনো মাওলানাকে পাঠিয়ে দিই৷''
আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, ‘‘আমার কাজ তো বিয়ে পড়ানো নয়৷ বাংলাদেশে মসজিদে অধিকাংশ বিয়ে হয়, এই বিষয়টিও ঠিক নয়, কিছু বিয়ে হতে পারে৷ সেক্ষেত্রে আমি বিয়ে পড়ানোর জন্য প্রয়োজনে পুরুষ মাওলানা পাঠাতে পারতাম৷''
তিনি বলেন, ‘‘নারী হিসেবে আমার যে শারীরিক অক্ষমতার কথা বলা হয়েছে সেটা আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিনা৷ নারী প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন, পাইলট হতে পারেন৷ তাহলে আমি কেন নিকাহ রেজিস্ট্রার হতে পারব না৷''
একই কথা বলেন তার আইনজীবী অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবির৷ তিন বলেন, ‘‘আমাদের অবশ্য অন্য মুসলিম দেশে নারী নিকাহ রেজিস্ট্রার আছে কিনা তা দেখাতে বলেছিলেন আদালত৷ আমরা তখন সেই উদাহরণ আদালতে দিতে পারিনি৷ কিন্তু আদালত মুসলিম বিয়ে পড়ানো এবং রেজিস্ট্রেশনকে এক করে দেখছেন হয়তো৷ কিন্তু রেজিস্ট্রেশন বিয়ের পরে হয়, বিয়ের তথ্য দিয়ে৷ বিয়ে অন্য কেউ পড়াতে পারেন৷''
এই আদেশের বিরুদ্ধে আপিলের আবেদন করা হয়েছে৷ আর সেই আপিলে আইনজীবী হিসেবে যুক্ত হয়েছেন ফাউন্ডেশন ফর ল' অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট ফাওজিয়া করিম৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা আদালতের এই রায় মানতে পারছিনা বলেই আপিল করেছি৷ আইনে নিকাহ রেজিস্ট্রারের যোগ্যতা এবং কাজ সুনির্দিষ্ট করে দেয়া আছে৷ তিনি বিয়ে রেজিষ্ট্রি করবেন, সিগনেচার নেবেন৷ ডিভোর্সের ক্ষেত্রেও তাই৷ তাদের কোনো ধর্মীয় কাজ নাই৷ আর আইনে কিন্তু কাজি শব্দটি নাই৷ রেজিস্ট্রার বলা আছে৷ কাজি হলো বিচারক৷ বিচারকও যদি হয় আমাদের তো অনেক নারী বিচারক আছেন৷''
তিনি বলেন, ‘‘মসজিদে বিয়ে হয় এটা একটা ভুল ধারণা৷ বিয়ে হয় অনুষ্ঠানস্থলে৷ আর নারীরা বিশেষ শারীরিক অবস্থায় মসজিদে যেতে পারবেন না এটা ধরে নিয়ে তারা নিকাহ রেজিস্ট্রার হতে পারবেন না এটা কোনো যুক্তি নয়৷ কাজিদের সঙ্গে আরো অনেক পুরুষ মাওলানা থাকেন প্রয়োজন হলে তারা গিয়ে বিয়ে পড়াবেন৷ আমরা আপিলে আরো অনেক বিষয় তুলে ধরব৷''
হাফেজ মাসুম বিল্লাহ বলেন, ‘‘মসজিদে বিয়ে পড়াতে হবে এমন কোনো বিধান নাই৷ কেউ কেউ বেশি সওয়াবের আশায় মসজিদে বিয়ে পড়ান৷ তবে আমাদের দেশে অধিকাংশ বিয়েই মসজিদের বাইরে বাড়িতে, কমিউনিটি সেন্টার বা কাজি অফিসে পড়ানো হয়৷''
তিনি জানান, কাজি অফিসেই বিয়ের আলাদা ঘর আছে৷ অনেকে নিজেরাই মাওলানা নিয়ে আসেন, তাকে দিয়েই বিয়ে পড়িয়ে আমাদের এখানে রেজিস্ট্রেশন করিয়ে যান৷ তাঁর মতে, আইনে কোনো নারীর নিকাহ রেজিস্ট্রার হতে বাধা নাই৷ সাধারণত পুরুষরাই নিকাহ রেজিস্ট্রার হন৷ তবে বাংলাদেশে এখানো কোনো নারীকে নিকাহ রেজিস্ট্রারের লাইসেন্স দেয়া হয়নি৷