ঋতুস্রাব হলে বলা হয়, মেয়েদের দু’দিন চুল ধোয়া উচিত নয়৷ এটার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই৷ বরং চিকিৎসকরা বলে থাকেন মাথায় পানি দিলে মাসিকের ব্যথা অনেকটা কমে এবং এতে আরাম পাওয়া যায়৷

আগেরকার দিনে পুকুরে গোসল করতো অনেকেই৷ তাই হয়ত পানি নোংরা হওয়ার ভয়ে এ নিয়ম চালু হয়েছিল যে, মাসিক হলে গোসল করা যাবে না৷ কিন্তু এখনকার গোসলখানায় সে ধরনের কোনো অসুবিধা নেই৷ এমনকি ট্যাম্পন পরে অনেকে সাঁতারও কাটে এ সময়ে৷

মাসিকের চারদিন মেয়েদের সাথে এমন ব্যবহার করা হয়, যেন তারা অচ্ছুৎ এবং অভিশপ্ত৷ তাদের গাছে পানিও দিতে দেয়া হয় না৷ আমাদের সমাজে প্রচলিত ধারণা, তাদের দেয়া পানিতে গাছ নাকি মরে যাবে৷

মাসিকের সময় হরমোন বেশি সক্রিয় থাকে৷ মসলাযুক্ত খাবার তাই না খাওয়া ভালো৷ কিন্তু অনেক বাড়িতে আচার ছুঁতে দেয়া হয় না মেয়েদের, এতে নাকি আচারও নষ্ট হয়ে যাবে৷ এমনকি আচার খেতেও দেয়া হয় না তাদের৷

মাসিক চলাকালীন মেয়েদের শরীর কিছুটা দুর্বল থাকে৷ অনেকের খুব ব্যথা হয়৷ তাই এ সময়ে মেয়েদের বিশ্রাম করা দরকার৷ মনে করা হয়, এ সময় যৌন সম্পর্কে লিপ্ত না হওয়াই ভালো৷ স্বামীর উচিত স্ত্রীকে এ সময় বিশ্রাম দেয়া ও যত্ন নেয়া, যাতে তার কাজের চাপ বেশি না হয়৷

অনেক হিন্দু পরিবারে মাসিক চলাকালীন মেয়েদের রান্না ঘরে ঢুকতে দেয়া হয় না৷ বিশেষ করে বড় পরিবারে এ ধরনের কুসংস্কার লক্ষ্য করা যায়, তারা মনে করে এতে খাবার দূষিত হয়৷ এই ধারণা একেবারেই ভুল৷

অনেক পরিবারে মাসিক চলাকালীন মেয়েদের বিছানায় শুতে দেয়া হয় না৷ মাটিতে শুতে বলা হয়৷ কোনো কোনো পরিবারে তো ঘরে নয়, বরং বাইরে,অর্থাৎ বারান্দায় শুতে দেয়া হয় তাদের৷ অথচ এতে যে ঐ মেয়েটির কষ্ট আরো বেড়ে যায়, তা কেউই লক্ষ্য করে না৷

অনেকেই বলে থাকেন, মাসিকের রক্ত নাপাক, মানে অপবিত্র৷ তাদের ধারণা এই রক্ত দিয়ে জাদু, ঝাড়ফুকও করা যায়৷ আশ্চর্যের বিষয়, শুধুমাত্র অশিক্ষিত পরিবারে নয়, অনেক শিক্ষিত পরিবারেও এ ধারণা প্রচলিত আছে৷

‘‘ঈশ্বর এটা সৃষ্টি করেছেন৷ মাসিক একটা স্বাভাবিক জিনিস৷ তাই আমরা কীভাবে বলতে পারি যে মাসিক চলাকালীন নারীরা অপবিত্র? কেন মেয়েদের এ কারণে নোংরা ভাবা হবে এবং এই একই কারণে মেয়েরা স্কুলে যেতে পারবে না?

‘‘স্যানিটারি প্যাড নিয়ে এমন আচরণ করা হয় যেন এগুলো রেডিওঅ্যাকটিভ আইসোটোপ বা তেজষ্ক্রিয় পদার্থ৷ দোকানে কিনতে গেলে খবরের কাগজ দিয়ে ঢেকে গোপনে দেয়া হয়৷ এটা কী এমন ব্যাপার যে পুরুষরা যদি এই প্যাকেট সম্পর্কে জেনে ফেলে যে এটা ‘হুইসপার উইথ উইংস’ এবং জানার সাথে তারা ভেঙ্গে পড়বে?’’

‘‘মাসিকের রক্ত নিয়ে কেউ যদি কথা বলে সেটা নিয়ে মোটেও আমি বিচলিত হই না৷ কেবল এটাকে বিশাল একটা কিছু না ভাবলেই হলো৷ এর ফলেই আমাদের মধ্যে নতুন প্রাণের সঞ্চার হওয়ার সামর্থ্য জন্মে৷ পুরুষদের শরীরের নির্গত ফ্লুইড নিয়ে যদি এত কথা না হয়, তাহলে মেয়েদের শরীর নিঃসৃত তরল নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করার কিছুই নেই৷’’

‘‘ঋতুস্রাব বা মাসিক খুব স্বাভাবিক একটা প্রক্রিয়া৷ কোনো মেয়ের এটা নিয়ে অস্বস্তিতে পড়ার কারণ নেই৷ এ বিষয়ে নিশ্চুপ থাকা মানে এ বিষয়ে শিক্ষার অধিকার থেকে আমাদের বঞ্চিত করা, যেটা কিনা মেনোপজের আগ পর্যন্ত আমাদের জীবনের মাসিক ঘটনা৷’’

‘‘এটা ভীষণ লজ্জাজনক যে পুরুষরা এখনো মাসিক সম্পর্কে সচেতন নয়৷ এটা আরও দুঃখজনক যে তারা এটাকে সমস্যা বলে মনে করে৷ একবিংশ শতাব্দীতেও আমরা এ ধরনের কথা বলছি!’’

‘‘যখন আমরা আমাদের মাসিক চলাকালীন সময়টা নির্বিঘ্নে পার করছি, তখন হাজার হাজার মেয়েকে নানা কুসংস্কার ও প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে৷ তাই আমি মেয়েদের বলতে চাই, সব কুসংস্কার ভেঙ্গে সামনে এগিয়ে চল৷’’

‘‘আমি স্কুলে মাসিক নিয়ে ছেলেদের সঙ্গে মজা করতাম৷ আমার যে মাসিক চলছে সেটাও তাদের জানিয়ে দিতাম৷ তারা বলতো, ‘তুই কীভাবে নির্দ্বিধায় এটা বলিস?’ আমি বলতাম, ‘এই যে আমি বললাম৷’

ডা. এলকে কাইল জানান, যেসব মেয়েদের প্রথম প্রথম মাসিক হতে শুরু করেছে তাদের অনিয়মিত ঋতুস্রাব হতেই পারে৷ তখন শরীরে হরমোনের পরিবর্তন হয়, যার ফলে এমনটা হয়৷ তাই এতে চিন্তার কোনো কারণ নেই৷ তবে অন্যদের ক্ষেত্রে ভিন্ন কথা৷ তাই তেমনটা হলে ডাক্তার দেখানোই স্রেয়৷

বার্লিনের স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞ এলকে কাইল জানান জরায়ুতে মায়োমা বা টিউমার থাকার কারণে মেয়েদের পিরিয়ডের সময় খুব বেশি ব্লিডিং ও ব্যথা হয়ে থাকে৷ তাছাড়া অনেকের ক্ষেত্রে টিউমারের সংখ্যা একাধিকও হতে পারে, যা খুব দ্রুত বড় হয়ে যেতে পারে৷ এই অবস্থায় অপারেশন করা জরুরি, বিশেষকরে যারা ‘মা’ হতে চান৷

ডিম্বাশয় বা ওভারিতে ‘সিস্ট’ হওয়ার কারণেও পিরিয়ড অনিয়মিত হতে পারে৷ সিস্ট হয়ে থাকে নানা আকারের এবং এগুলোর ভেতরে রক্ত এবং পানির মতো তরল পদর্থ থাকতে পারে৷ কখনো কখনো সিস্ট নিজে থেকেই, মানে কিছুদিনের মধ্যেই মিলিয়ে যায়৷ তবে তার আকার যদি চার সেন্টিমাটারের বেশি হয়, তাহলে অপারেশন করাই ভালো৷

এছাড়াও যোনির আশেপাশের নরম ত্বকে এবং জরায়ুর প্রবেশপথেও ছোট ছোট শক্ত ফুসকুড়ির মতো হয়ে থাকে৷ এটা সাধারণত মেয়েদের হরমোন এস্ট্রোজেন বা ইস্ট্রোজেনের কারণেই হয়ে থাকে৷ এক্ষেত্রেও ফুসকুড়ি অপারেশন করে বের করে ফেলাই বুদ্ধিমানের কাজ৷

মেয়েদের শরীরে বেশ কিছু সমস্যা থাকে, যা নিয়ে সাধারণত সরাসরি কথা বলা হয় না, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে৷ মেয়েদের অনিয়মিত মাসিকও সেরকমই একটি সমস্যা৷ মাসিকের সময় শরীর কিছুটা খারাপ লাগা স্বাভাবিক, তবে নিয়মিত কোনো কষ্ট বা ব্যথা হলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়া দরকার বলে জানান এলকে কাইল৷

পিরিয়ডের সময় প্রায় সব মেয়েদেরই কম-বেশি শরীর খানিকটা খারাপ লাগে বা ম্যাজ ম্যাজ করে৷ মাথা ও স্তনে ব্যথাভাব হয় এবং আর মেজাজও অনেকসময় খিটখিটে হয়৷ তাই এ সব থেকে মুক্তি পেতে ভেষজ চা পান করার পরামর্শ দিয়েছেন স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞ এলকে কাইল৷