‘নারীর কাজের মূল্যায়ন হলে নির্যাতন কমবে'
১৪ নভেম্বর ২০১৭ডয়চে ভেলে: নারীরা গৃহে যে কাজ করেন, তার কি কোনো মূল্য আছে?
শাহীন আনাম: আসলে মূল্য তো অনেক আছে৷ কিন্তু মূল্যায়ন করা হয় না৷ একজন নারী গৃহে যে কাজ করেন, সেটা তিনি না করলে অন্য কাউকে দিয়ে করাতে হতো৷ তখন তাঁকে তো একটা পারিশ্রমিক দিতে হতো৷ যেহেতু নারী নিজের গৃহে কাজ করেন, তাই এটার মূল্য ধরা হয় না৷ অবশ্যই এটার একটা মূল্য আছে৷ এই কাজের মূল্যায়ন করা হয় না, স্বীকৃতি দেয়া হয় না – তাই বলা হয়, এটার কোনো মূল্য নেই৷
নারীরা গৃহে শ্রমের মূল্য পান না কেন?
সাধারণ যে কোনো কাজের একটা পারিশ্রমিক থাকে৷ কিন্তু গৃহের কাজের কোনো মূল্য নির্ধারণ করা নেই, তাই এটাকে মূল্যায়ন করা হয় না – বলা হয় এটা নিজের গৃহের কাজ, ফলে এটাকে মূল্য দেয়া হয় না৷
নারীর গৃহশ্রমকে সমাজ কীভাবে দেখে?
নারী শুধু গৃহে কাজ করেন না, অনেক উৎপাদনশীল কাজও তাঁরা করেন৷ কিন্তু সবগুলো কাজকেই ধরা হয় সংসারের কাজ৷ সমাজও ঠিক সেইভাবেই দেখে৷ সমাজ মনে করে, নারী সংসার দেখেন, সন্তান সামলান – এটাই তাঁর কাজ৷ এর বাইরেও গ্রামের নারীরা কিন্তু গবাদি পশু দেখেন, বীজ সংরক্ষণ করেন – এমন হাজারো কাজ করেন তাঁরা৷ যেহেতু এ সব কাজেরও মূল্য নির্ধারণ করা নেই, তাই সমাজও মনে করে যে, এগুলো মূল্যহীন কাজ৷ আমি বলব, এ সবের ফলে সমাজ তাঁদের কাজকে মর্যাদার চোখে দেখে না৷
আর্থিক হিসেবে নারীর গৃহশ্রম নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
সব কাজেরই তো মূল্য আছে৷ তাই নারীর গৃহের কাজের একটা মূল্য নির্ধারণ করা দরকার৷ আমরা একটা গবেষণা করেছিলাম – নারীর অস্বীকৃত কাজের মূল্য কত? আমি মনে করি, এই মূল্য জিডিপিতে ঢোকানো দরকার৷জিডিপিতে যদি না-ও নেয়া হয়, তাহলেও এর একটা মূল্য নির্ধারণ করা দরকার৷ আমরা গবেষণা করে এর একটা কৌশল নির্ধারণ করেছি৷ আমরা বলেছি, একজন নারী যদি গৃহে এই কাজ না করতেন, তাহলে অন্য কাউকে দিয়ে এই কাজটা করাতে হতো৷ তখন সেটার মূল্য কত হতো? আমরা ১৩ হাজার নারীর উপর গবেষণা করে দেখেছি, বাংলাদেশে নারীরা কাজ করে যে মূল্য পান আর গৃহে কাজ করে যে নারীরা মূল্য পান না, সেটার হিসাব করে দেখেছি৷ ঘরের কাজের জন্য বাইরের কাজের সম পরিমাণ মূল্য দেয়া হলে তিনগুণ মূল্য পেতেন নারীরা৷
অনেক নারী চাকরি করেন, আবার গৃহস্থালির কাজও সামলান৷ পরিবারে এমন নারীদের মূল্যায়ন কেমন?
এটা আসলে একেক পরিবারে একেক রকম৷ যাঁরা বাইরে চাকরি করেন আর গৃহস্থালির কাজও করেন, তাঁদের জন্য এটা তো অধিক বোঝা৷ কারণ আমাদের দেশে গৃহস্থালির কাজকে এখনও নারীর কাজ হিসেবেই দেখা হয়৷ ফলে চাকরিজীবী নারীকে বাইরে কাজ করে এসে আবার ঘরের কাজও সামলাতে হয়৷ পরিবারের অন্য কোনো সদস্য যদি ঘরের কোনো কাজ করেন, তখন বলা হয়, ‘তোমার কাজ করে দিলাম৷' তার মানে, তিনি মনে করেন না যে ‘এটা আমাদের কাজ'৷ তিনি মনে করেন, এটা বাড়ির মেয়ে বা বউয়ের কাজ৷ পরিবারের সদস্যরা যদি এটাকে ‘আমাদের কাজ' মনে করতেন, তাহলে নারীর জন্য এটা বোঝা হতো না৷
বাংলাদেশে কতভাগ গৃহিণী নির্যাতনের শিকার হন?
এটা নিয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর বিস্তারিত রিপোর্ট আছে৷ তারা ২০১০ সালে একটা গবেষণা করেছে, আবার ২০১৩ সালে আরেকটা করেছে৷ সেখানে সর্বশেষ দেখা গেছে, ৬৫ ভাগ নারী কোনো-না-কোনোভাবে গৃহে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন৷
গৃহে নারীদের নির্যাতনের ক্ষেত্রে কাদের ভূমিকা বেশি?
এক্ষেত্রে ভূমিকা সবচেয়ে বেশি পরিবারের৷ পরিবার থেকেই যদি বুঝতো নারীর মূল্য কত, তাহলে তারা সম্মান দেখাতো৷ আমার বিশ্বাস, সেটা হলেই নারীর প্রতি সহিংসতা কমবে৷ এখানে পরিবারের পাশাপাশি সমাজের একটা দায়িত্ব আছে, রাষ্ট্রেরও একটা দায়িত্ব আছে৷
নারীদের গৃহের কাজে স্বাস্থ্যঝুঁকি কতটা?
ঝুঁকি থাক আর না থাক কাজ কিন্তু তিনি করে যাচ্ছেন৷ একজন নারী মনে করেন এটা তাঁর কাজ, ফলে এটা তাঁকে করতে হবে৷ তাতে ঝুঁকি থাক আর না থাক৷ ঝুঁকি তো আছেই৷ অনেক সময় তাঁর স্বাস্থ্য খারাপ থাকে, তিনি গর্ভবতীও থাকে পারেন, তারপরও তাঁকে এই কাজগুলো করতে হয়৷
চাকরি করা নারীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে কিছু বলবেন?
চাকরি করা নারীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেশি৷ তাঁদের বাসার সব কাজ সামলে অফিসে যেতে হয়৷ সেখানে কাজ করতে হয়৷ সন্তান সমালানোর দায়িত্বও কিন্তু তাঁর৷ এ জন্য আমরা বলছি, স্বামী যদি স্ত্রীর সঙ্গে কাজ ভাগাভাগি করে নেন, তাহলে নারীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি অনেক কমে যাবে৷
চাকরি করা নারীরা কি স্বামীর পর্যাপ্ত সহযোগিতা পান?
এটা নিয়ে আমাদের গবেষণা নেই৷ তবে আমার ধারণা, পরিস্থিতি একটু একটু করে পরিবর্তন হচ্ছে৷ শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে সচেতনতা বাড়ছে৷ তবে ব্যাপকভাবে এখনো এটা হয়নি৷ এখনো স্বামী মনে করেন, ঘরের সব কাজ নারীর কাজ৷ তিনি কোনো কিছু একটা করে দিয়ে বলেন, ‘তোমার কাজটা করে দিলাম৷' অথচ এটা তাঁরও যে কাজ, সেটা তিনি মনে করে না৷
বাংলাদেশে কতভাগ নারী গৃহ নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন?
এমন কোনো জরিপ নেই৷ অনেক সময় দেখি, যৌতুকের কারণে, উত্যাক্ত করার কারণে নারী আত্মহত্যা করেন৷ কিন্তু গৃহনির্যাতনের কারণে কতভাগ নারী আত্মহত্যা করেন, সেটা সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারছি না৷
সমাজে নারীদের মর্যাদা বৃদ্ধিতে কি উদ্যোগ নেওয়া উচিত?
আমরা একটা প্রচারাভিজান শুরু করেছি, যার নাম আমরা দিয়েছি, ‘মর্যাদায় গড়ি সমতা'৷ আমরা মনে করি, নারীকে মর্যাদা দিলে তাঁর প্রতি সহিংসতা কমবে৷ আপনি যাঁকে সম্মান দেন, নিশ্চয়ই তাঁকে আপনি নির্যাতন করবেন না৷ তাঁকে আপনি সমান সমান দেখেন৷ আমরা মনে করি, নারীর সম্মান আমাদের সমাজে, রাষ্ট্রে বাড়াতে হবে৷ কীভাবে বাড়াতে হবে? সমাজে যে তাঁর বহুমুখী অবদান, তার স্বীকৃতি দিতে হবে, সম্মান করতে হবে, মূল্যায়ন করতে হবে৷
এ বিষয়ে আপনার কিছু বলার থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷