নারীর চরিত্র হনন: যৌন নিপীড়নের আরেক হাতিয়ার?
২৯ জুন ২০২৫
কুমিল্লার মুরাদনগরে বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) রাতে এক গৃহবধূকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। একপর্যায়ে স্থানীয় কয়েকজন যুবক ধর্ষণে অভিযুক্ত ফজর আলী এবং ওই নারীকে ঘরে ঢুকে আটক করে। তারা ওই নারীকে বিবস্ত্র করে মারধর করে তার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়েও দেয়। অভিযুক্তকেও মারধর করা হয়।
কিন্তু পরবর্তীতে অভিযুক্তকে ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে যেতে দেয়া হয়। এই পুরো ঘটনার সময় পুলিশ ছিলো নির্বিকার।
ঘটনার পরের দিন শুক্রবার মামলা হলেও পুলিশের কোনো তৎপরতা ছিলো না। শনিবার রাতে ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পরই হঠাৎ তৎপর হয়ে ওঠে পুলিশ। ঢাকার একটি হাসপাতাল থেকে রোববার ভোর রাত পাঁচটার দিকে আসামি ফজর আলীকে গ্রেপ্তার করে মুরাদনগর থানা পুলিশ।
নারীকে মারধর ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘটনার ভিডিও ছড়িয়ে দেয়ার অপরাধে আরো চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তারা হলো: মো. সুমন, রমজান আলী, মো. আরিফ ও মো. অনিক।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার রাতেই ফজর আলী কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। তবে ভুক্তভোগী শুক্রবার মামলা করলে ফজর আলী কুমিল্লা ছেড়ে ঢাকায় চলে যান।
থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বক্তব্যে বিভ্রান্তি
পুরো ঘটনাটিই মুরাদনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহিদুর রহমান জানতেন। কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন সময়ে দেয়া তার বক্তব্যে পাওয়া গেছে ভিন্ন বক্তব্য। শনিবার দিবাগত রাত ১টার দিকে একবার এবং পরবর্তীতে রোববার বিকালে আরো একবার ওসির সঙ্গে কথা বলেছে ডয়চে ভেলে। তবে দুই বার তার কাছ থেকে পাওয়া গেছে দুইরকম বক্তব্য।
শনিবার ভুক্তভোগীকে ডাক্তারি পরীক্ষা করানো হয়েছে কিনা জানতে চাইলে ওসি বলেছিলেন, "ওই মহিলা (ভুক্তভোগী) ডাক্তারি পরীক্ষা করতে চায় না।”
কিন্তু ঘটনাটি দেশব্যাপী আলোচনার জন্ম দিলে রোববার বিকালে ওসি বলেন, "শনিবারাই তার ডাক্তারি পরীক্ষা করা হয়েছে। শুক্রবার সকালে ওই মহিলা থানায় অভিযোগ দিয়ে চলে যায়, তাই তখন ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য পাঠানো সম্ভব হয়নি।”
শুক্রবার মামলা হওয়ার পরও আসামিদের গ্রেপ্তারে উদ্যোগ নেয়া হয়নি কেন জানতে চাইলে তিনি রোববার বলেন, "আসামিরা তা পালিয়ে ছিলো। তাদের অবস্থান জানতে তো সময় লাগবে।”
অথচ শনিবার দিবাগত রাতে তিনি ডয়চে ভেলেকে আসামি কোথায় কীভাবে আছে তার পূর্ণ বর্ণনা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, "আসামিকে তো মারপিট করা হয়েছে। তার একটি পা ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। প্রথমে তাকে কুমিল্লা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এখন ঢাকার সায়েদাবাদের একটি হাসপাতালে আছে। আমার দুইটা টিম ঢাকায় গেছে। ধরে আনবে।”
মামলার এজাহারে ওই নারী একজনকেই আসামিকে করেছেন- ফজর আলী। তিনি অভিযোগ করেছেন, ১৫ দিন আগে তিনি তার বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসেন। ঘটনার রাতে বাড়ির সবাই পাশের গ্রামে একটি মেলায় যান। রাত ১০ টার দিকে তিনি তার দুই সন্তানকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। রাত সাড়ে ১১টার দিকে কৌশলে ফজর আলী ঘরে ঢুকে ঘুমন্ত অবস্থায় মুখ চেপে ধরে গলায় ছুরি ধরে ধর্ষণ করে। তিনি আসামিকে চিনতে পারায় তাকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়। তার চিৎকারে আশপাশের লোকজন গিয়ে ফজর আলীকে মারধর করে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা গেছে ওই নারীকেও চার-পাঁচজন তরুণ বিবস্ত্র করে মারধর করেছে। ওই নারী রোববার গণমাধ্যমকে বলেছেন, "ফজর আলী দরজা ভেঙে তার ঘরে ঢুকেছে। এরমধ্যে কয়েকজন লোক আসে। তারা আমাকেও মারপিট করে ফজর আলীকেও মারপিট করে। তারা আমাকে মারপিটের সময় ভিডিও করে। তারপর ফেসবুকে ছেড়ে দেয়। মোট চারজন মিলে মারধর করে। তাদের আমি চিনি। তারা আমাকে জোর করে বিবস্ত্র করে মারপিট করে।”
তিনি আরো বলেন, "ফজর আলী আমার পূর্ব পরিচিত । তার কাছ থেকে আগে ৫০ হাজার টাকা ধার নিয়েছি। আর তার ছোট ভাই শাহ পরাণও আমার পরিচিত।”
এজাহারে ভুক্তভোগী নারী বলেছেন, তারা দুই জনই (ফজর আলী এবং শাহ পরাণ) আগে তাকে নানাভাবে উত্যক্ত করেছে। এজাহারে মারপিট ও বিবস্ত্র করার কথা কেন উল্লেখ করেননি, জানতে চাইলে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, "আসলে আমাকে ওইভাবেই মামলা করতে বলা হয়েছে।” তবে পরবর্তীতে রোববার দায়ের করা আরেকটি মামলায় ভিডিও ধারণ এবং মারপিটের ঘটনারও উল্লেখ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগী।
ওই নারীর পাশের বাড়ির একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, "বৃহস্পতিবার রাতে ওই বাড়িতে অনেক শব্দ হচ্ছিল। আমি ভয়ে দৌড়ে গিয়ে লোকজন ডেকে আনি। লোকজন গিয়ে দেখেন দরজা ভাঙা। পরে আমরা ওই নারীকে উদ্ধার করি। এ সময় কিছু লোক তাকে মারধর ও ভিডিও করেন। এরপর লোকজন ফজর আলীকে মারধর করেন। পরে তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়।”
ওই এলাকার ইউনিয়ন চেয়ারম্যান গোলাম কিবরিয়ার সঙ্গে কথা বলেছে ডয়চে ভেলে। তিনি ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, "আমরা ঘটনা শুক্রবারই জেনেছি। শুনেছি ওই নারীর বাড়ির দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। কিছু যুবক গিয়ে ওই নারীতে বিবস্ত্র করে মারধোর করেছে। ধর্ষণের অভিযোগ যার বিরুদ্ধে তাকেও মারধর করা হয়েছে।”
ফজর আলীসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তারের ঘটনাকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, "তারা এখন তদন্ত করে দেখুক কী হয়েছে। আমরা এর সুষ্ঠু বিচার চাই।”
আবারও ভুক্তভোগীর চরিত্রহনন
স্থানীয় কয়েকজন জানান, তিতাস নদীর তীরে ওই এলাকায় হিন্দু বসতি। আর ওই বাড়িতে একটিই ঘর, ভুক্তভোগী নারীর স্বামী প্রবাসে থাকেন।
সাম্প্রতিক সময়ের অন্য নানা ঘটনার মতো এই ঘটনাতেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা তথ্য ছড়িয়ে বিভিন্নভাবে ভুক্তভোগী নারীরই চরিত্রহননের চেষ্টা চলছে।
স্থানীয় পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, ঘটনার পর কয়েকজন যুবক এবং একজন ইউনিয়ন চেয়ারম্যান নানাভাবে ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেন। তারা বিষয়টি নিজেদের মতো করেই ফয়সালা করতে চান। ফলে ঘটনা জানার পরও পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়নি। আসামিদের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়েও শুরু হয়েছে ঘটনাকে অন্যদিকে মোড় ঘোরানোর চেষ্টা। একপক্ষ মূল অভিযুক্ত ফজর আলী
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, "বাংলাদেশে এরকমই হচ্ছে। এখানে নারীর অবমাননাকারীদের ফুলের মালা দিয়ে বরণ করা হয়।”
মানবাধিকার কর্মী নূর খান ডিডাব্লিউকে বলেন, "পুলিশ ঘটনার পররপই কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এখন এর ভিতরে রাজনীতি ঢুকানো হচ্ছে। নারীর নানা সম্পর্কের ডালপালা বানানো হচেছ। কিন্তু ধর্ষণ এবং তাকে বিবস্ত্র করে যে মারপিট করা হলো সেটা নিয়ে যেন কোনো মাথা ব্যথা নাই।”
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান বলেন, "ধর্ষণের ঘটনা বা নারীর অবমানার পর তার চরিত্র হনন এখানে একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। নারী পরকীয় করেছে, চরিত্র খারাপ- এগুলো বলার উদ্দেশ্যই হলো ধর্ষকদের রেহাই দেয়া।”
উত্যক্ত, নির্যাতনে অভিযুক্তদের গলায় ফুলের মালা
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত পাঁচ মাসে বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৩৮৩টি। এরমধ্যে ৩১১টি ঘটনায় মামলা হয়েছে। আর ৭১টি ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। ১৬ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। পাঁচজন ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন। ২০২৪ সালে পুরো বছরে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল ৪০১টি।
ধর্ষণ এবং নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা কোনোভাবেই কমছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইনের দৃষ্টিতে প্রমাণিত হওয়ার আগ পর্যন্ত কোনো অভিযুক্তকেই দোষী বলা যাবে না। কিন্তু নারীকে হেনস্তা ও অবমাননা করার অভিযোগ আসা ব্যক্তিদের জামিন পাওয়ার পর ফুলের মালা দিয়ে বরণের ঘটনা সমাজে একটি বিরূপ বার্তা দিচ্ছে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামের মৃত্যুদণ্ডাদেশ থেকে খালাস ও মুক্তির প্রতিবাদে ২৮শে মে বিকেলে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব এলাকায় গণতান্ত্রিক ছাত্রজোটের ডাকা মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচিতে এক নারীসহ দুজনকে লাথি মারা হয়। এ নিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে ওই ঘটনায় জড়িত থাকা ইসলামী ছাত্র শিবিরের কর্মী আকাশ চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করা হয়। ৪ জুন জামিনে মুক্তির পর আকাশ চৌধুরীকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা।
মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এক নারীকে তার পোশাক নিয়ে হেনস্তা করার পর ভুক্তভোগী নারী শাহবাগ থানায় মামলা দায়ের করেন। এই ঘটনাতেও ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী মোস্তফা আসিফ অর্ণবকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। কিন্তু এরপর তৌহিদী জনতা ব্যানারে কিছু লোক থানা ঘেরাও করে। আদালত থেকে তিনি জামিন পাওয়ার পর তাকে পাগড়ি ও ফুলের মালা দিয়ে বরণ করা হয়। ওই নারী পরবর্তীতে নানা চাপে মামলা প্রত্যাহারেও বাধ্য হন।
এমন ঘটনা যে কেবল অন্তর্বর্তী সরকারের শাসনামলেই ঘটছে, এমন না। এর আগেও নারী নিপীড়ণে অভিযুক্তদের ফুল দিয়ে বরণের উদাহরণ রয়েছে।
২০২০ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ভোলার লালমোহনে মোহাম্মদ রাসেল নামে এক তরুণ ধর্ষণ মামলায় খালাস পেলে তাকেও ফুলের মালা দিয়ে বরণ করা হয়। ওই মামলায় তিনি দুই বছরেরও বেশি সময় কারাগারে ছিলেন।
আর ওই বছরেরই ১৮ জুলাই কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে মো. সোহেল নামে ধর্ষণ মামলার এক আসামী জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর তাকে ফুলের মালা গলায় দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো হয়। শুধু তাই নয়, তাকে নিয়ে মটরসাইকেলে আনন্দ শোভাযাত্রাও বের করা হয়েছিল। আপন চাচাতো বোনকে ধর্ষণের অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো।
নূর খান বলেন, "কুমিল্লার ঘটনায় দেখলাম নারী ধর্ষণের শিকার হলেন। আবার তার ভিডিও ভাইরাল হলো। পুলিশ সময়মতো পদক্ষেপ নিলে এই ঘটনা ঘটত না। পুলিশ সব জানার পরও সময় মতো আসামিদের গ্রেপ্তার করেনি।”
তিনি বলেন, "আসলে আমরা দখতে পাচ্ছি, ধর্ষণ ও নারীর অবমাননাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। উল্টো আসামীদের গলায় ফুলের মালা দিয়ে ওই অপরাধীদের উৎসাহিত করা হচ্ছে।... দেশে একটি গোষ্ঠী দাঁড়িয়ে গেছে, যারা নারীকে অবমাননা করছে। তারা এটা দলবেঁধে করছে।”
মালেকা বানু মনে করেন, যারা নারীর চরিত্র হনন করে ধর্ষণ ও নারীর অবমাননাকে উৎসহিত করছে এবং বিকৃত মানসিকতা ছড়িয়ে দিচ্ছে, তাদেরও আইনের আওতায় আনা দরকার। "কিন্তু," তিনি বলেন, "আমরা দেখতে পাচ্ছি তাদের আইনের আওতায় আনা তো দূরের কথা ধর্ষক, অবমাননাকারীরাই রেহাই পেয়ে যাচ্ছে।”
ডিডাব্লিউকে তিনি বলেন, "আসলে এমন পরিস্থিতি হয়েছে যে নারীর কোনো নিরাপত্তা নাই। একটার পর একটা ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। এর দায় সরকারকেই নিতে হবে।”
ধর্ষণ মামলার নানা জটিলতার কথা তুলে ধরে অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান বলেন, "ধর্ষক তো সাক্ষী রেখে ধর্ষণ করে না। বাংলাদেশের বিচার প্রক্রিয়া এবং নানা জটিলতার কারণে ধর্ষণ মামলার অনেক আসামি ছাড়া পান, জামিন পান। আর তাদের ফুলের মালা দিয়ে বরণ করা হয়। এটা একটি সমাজের বিকৃত মানসিকতা। অনেক মামলার আসামিই তো জামিন পান, খালাস পান, তাদের তো ফুলের মালা দেয়া হয় না। এর মানে হচ্ছে একটি গোষ্ঠী ধর্ষণ, নারীর অবমাননাকে উৎসহিত করছে।”