নারীর প্রতি যৌন সহিংসতার দিক থেকে বিশ্বের নিকৃষ্টতম মেগাসিটির তালিকায় ব্রাজিলের সাও পাওলোর পাশাপাশি জায়গা করে নিয়েছে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি৷তালিকায় ঢাকার অবস্থান সাত নম্বরে৷
বিজ্ঞাপন
থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশন পরিচালিত এক জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে৷ ‘নির্ভয়া ধর্ষণকাণ্ডের' পাঁচ বছরের মাথায় এ জরিপের ফলে ভারতের রাজধানী যৌন সহিংসতায় বিশ্বের নিকৃষ্টতম মেগাসিটির কাতারে উঠে এলো৷
২০১২ সালের ডিসেম্বরে চলন্ত বাসে গণধর্ষণের শিকার হন নির্ভয়া, পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান৷ এ ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছিল ভারতকে৷ উত্তাল প্রতিবাদের মুখে দ্রুত বিচার ট্রাইবুনাল গঠন, ধর্ষণের শিকার নারীদের জন্য তহবিল গঠনসহ আইনের সংষ্কার ইত্যাদি নানা পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয় ভারত সরকার৷ তারপরেও দিল্লীসহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ধর্ষণ অত্যন্ত নিয়মিত ঘটনা৷ ধর্ষণ ও ধর্ষণ শেষে হত্যাকাণ্ড প্রায় নিয়মিতই জায়গা করে নেয় খবরের পাতায়৷ পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে দিল্লিতে ধর্ষণের শিকার হয় ২১৫৫ জন, যা ২০১২ সালের তুলনায় ৬৭ শতাংশ বেশি৷
যৌন হয়রানির হাত থেকে কীভাবে বাঁচাবেন শিশুকে
শিশুরা বিকৃতকাম মানুষের সহজ শিকার৷ সারল্যের সুযোগ নিয়ে সহজে ভোলানো যায় তাদের৷ অনেক সময় শিশুরা বুঝতে পারে না, চিনতে পারে না পিশাচের থাবা৷ আর বুঝলেও করতে পারে না প্রতিবাদ, প্রতিরোধ৷ শুধু একটা অস্বস্তি থেকে যায় সারাটা জীবন৷
ছবি: picture alliance/abaca
ভয়াবহ অবস্থা ভারতে
ভারতের জাতীয় ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের অর্ধেকেরও বেশি বাচ্চা যৌন নিগ্রহের শিকার৷ তবে সবচেয়ে ভয়ংকর সত্য হলো, নাবালিকা বা শিশুর ওপর যৌন হেনস্থার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে পরিবারের মধ্যে, পরিবারেরই কোনো মানসিক বিকারগ্রস্ত সদস্যের হাতে৷ তাই সে সব ঘটনা পুলিশের কাছে পৌঁছাচ্ছে না, হচ্ছে না কোনো ডাইরি অথবা মামলা৷
ছবি: Fotolia/Gina Sanders
হারিয়ে যাচ্ছে শৈশব
এভাবে প্রতিদিন বিকৃত যৌন নির্যাতনে হারিয়ে যাচ্ছে অগুন্তি শৈশব৷ অনেকক্ষেত্রেই শিশুরা বুঝে উঠতে পারছে না, বলে উঠতে পারছে না তাদের অমানবিক সেই সব অভিজ্ঞতার কথা৷ তাই শিশুদের প্রতি যৌনাসক্ত, বিকৃত মানুষগুলো থেকে যাচ্ছে লোকচক্ষুর আড়ালে৷ সমাজবিদরা বলছেন, এ জন্য আগাম সতর্কতার দায়িত্ব নিতে হবে অভিভাবক এবং স্কুলের৷ শিশুকে দিতে হবে তার প্রাপ্য শৈশব৷
ছবি: Fotolia/Kitty
যেভাবে বোঝাবেন বাচ্চাদের
সহজ ভাষায় খেলা বা গল্পচ্ছলে শিশুদের এ বিষয়ে একটা ধারণা গড়ে তোলা যেত পারে৷ বাচ্চাদের বলতে হবে যে, তাদের শরীরটা শুধুমাত্র তাদের৷ অর্থাৎ কেউ যেন তাদের ‘গোপন’ জায়গায় হাত না দেয়৷ তাই কোনো আত্মীয় বা পরিচিত ব্যক্তির আচরণ অস্বস্তিকর ঠেকলে, কেউ তাদের জোর ঘরে কোনো ঘরে নিয়ে গেলে, খেলার ছলে চুমু দিলে বা শরীরের কোথাও হাত দিলে – তা যেন মা-বাবাকে জানায় তারা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
চিনিয়ে দিন যৌনাঙ্গ
অনেক বাবা-মা নিজ সন্তানের সঙ্গে যৌনাঙ্গ নিয়ে কথা বলতে কুণ্ঠা বোধ করেন৷ কিন্তু এই লজ্জা কাটিয়ে উঠতে হবে এবং খুব ছোটবেলাতেই ছবি এঁকে অথবা গল্পে-গানে বাচ্চাকে তার শরীরের অন্য সব অঙ্গের মতো যৌনাঙ্গ, লিঙ্গ ইত্যাদি চিনিয়ে দিতে হবে৷ এমনটা করলে কেউ যদি তাদের সঙ্গে পিশাচের মতো ব্যবহার করে, তাহলে শিশুরা সহজেই বলতে পারবে কে, কখন, কোথায় হাত দিয়েছিল৷
ছবি: DW/S.Rahman
শিশুর কথা শুনুন, তার পক্ষ নিন
শিশু যাতে আপনাকে বিশ্বাস করতে পারে, বন্ধুর মতো সবকিছু খুলে বলতে পারে – সেটা নিশ্চিত করুন৷ আপনার বাচ্চা যদি পরিবারের কাউকে বা আপনার কোনো বন্ধুকে হঠাৎ করে এড়িয়ে যেতে শুরু করে অথবা আপনাকে খুলে বলে বিকৃত সেই মানুষের কৃতকর্মের কথা, তবে সময় নষ্ট না করে শিশুটির পক্ষ নিন আর তিরস্কার করে বাড়ি থেকে বার করে দিন ঐ ‘অসুস্থ’ লোকটাকে৷
ছবি: Fotolia/pegbes
স্কুলেরও দায়িত্ব আছে
বাচ্চারা দিনের অনেকটা সময় স্কুলে কাটায়৷ তাই যৌন শিক্ষার ক্ষেত্রে স্কুলের একটা বড় দায়িত্ব থেকে যায়৷ তবে স্কুলের মধ্যে, বিদ্যালয় চত্বরেও ঘটতে পারে শিশু নির্যাতনের ঘটনা৷ তাই স্কুল থেকে ফেরার পর বাচ্চা যদি অতিরিক্ত চুপচাপ থাকে, একা একা সময় কাটায় বা পড়াশোনা করতে না চায়, তাহলে ওর সঙ্গে কথা বলুন৷ জানতে চান কী হয়েছে, প্রয়োজনে স্কুল কর্তৃপক্ষকেও জানান৷
ছবি: picture-alliance/blickwinkel
ছেলে-মেয়ে সমান!
আমাদের সমাজে ছোট থেকেই মেয়েদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়৷ মেয়ে হলেই হাতে একটা পুতুল আর ছেলে হলে ধরিয়ে দেয়া হয় বল বা খেলনার পিস্তল৷ ছেলের পাতে যখন তুলে দেয়া হয় মাছের বড় টুকরোটা, তখন মেয়েটির হয়ত এক গ্লাস দুধও জোটে না৷ এ বৈষম্য বন্ধ করুন৷ বাবা-মায়ের চোখে ছেলে-মেয়ে সমান – সেভাবেই বড় করুন তাদের৷ তা না হলে নারীর ক্ষমতায়ন হবে কীভাবে? কীভাবে কমবে শিশু নির্যাতন?
ছবি: picture alliance/abaca
7 ছবি1 | 7
অবশ্য এই জরিপের আগে থেকেই দিল্লি বিশ্বে ‘ধর্ষণের রাজধানী' হিসেবে নিন্দা কুড়িয়ে আসছে৷ প্রায় ২ কোটি ৬৫ লাখ মানুষের আবাস দিল্লি বিশ্বের দ্বিতীয় জনবহুল মেগাসিটি৷ দিল্লি শহরের নারীরা সম্ভ্রম হারানো, যৌন হামলার শিকার হওয়া, ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির আতঙ্কে থাকে৷ তবে ‘নির্ভয়া ধর্ষণকাণ্ডের' পর সারা বিশ্বে ভারতের যৌন সহিংসতা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়, যেখানে পথেঘাটে, স্কুলে, গণপরিবহনে নারীরা ধর্ষণের শিকার হয়৷ দালালের হাতে পড়ে পাচার ও বিক্রি করে হয়ে যায় অসংখ্য নারী৷
জাতিসংঘ ঘোষিত বিশ্বের ১৯টি মেগাসিটিতে এ বছরের জুন-জুলাই মাসে এ জরিপ চালানো হয়৷ ধর্ষণের তালিকায় সবার শীর্ষে দিল্লির সাথেই নাম এসেছে ব্রাজিলের সাও পাওলোর৷ এ বছরের জুলাইতেই ২,২৮৭টি ধর্ষণের মামলা হয়েছে সাওপাওলোতে৷ সেখানে ২০১৬ সালে এ সংখ্যা ছিল ২,৮৬৮৷ দক্ষিণ অ্যামেরিকার দেশ ব্রাজিলের শহরটিতে গণপরিবহনে নারী ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্তরা যাতে প্রমাণের অভাবে ছাড়া না পায়, তার দাবি তুলে গত সেপ্টেম্বরে #মাইঅ্যাবিউজারড্রাইভার নামের অনলাইন ক্যাম্পেইন সাড়া জাগায় বিশ্বব্যাপী
ধর্ষিতার দুই আঙুল পরীক্ষা
কোনো নারী ধর্ষিতা হয়েছেন কিনা, তা নিরূপণের জন্য বিতর্কিত দুই আঙুল পরীক্ষা চালু করতে চেয়েছিল ভারত৷ এ নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে, বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়৷ শেষে অবশ্য বিশেষ কারণ ছাড়া পরীক্ষাটি বাতিল করা হয়৷ কী এই পরীক্ষা?
ছবি: AP
প্রমাণ করার জন্য
ধর্ষণকারীকে সাজা দিতে তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনাটাই যথেষ্ট নয়৷ ধর্ষণ যে হয়েছে, সেটা প্রমাণ করতে হয়৷ তাই এতদিন পর্যন্ত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চিকিৎসকরা দুই আঙুল পরীক্ষা করতেন৷
ছবি: Fotolia/detailblick
সম্ভোগের অভ্যাস
নিগৃহীতা মহিলার যৌনসম্ভোগের অভিজ্ঞতা বা অভ্যাস আছে কিনা, তা যাচাই করা হতো, কোথাও কোথাও এখনও হয়ে থাকে যোনিপথে আঙুল ঢুকিয়ে৷
ছবি: AP
কুমারিত্বের প্রমাণ
আঙুলের স্পর্শে চিকিৎসকরা বুঝতে পারেন, একজন নারীর সতীচ্ছদ অক্ষত আছে কিনা, অর্থাৎ সেই নারীর কুমারিত্ব অক্ষুণ্ণ আছে কিনা৷
ছবি: Fotolia/NinaMalyna
ভিত্তিহীন ধারণা
আঙুলের সাহায্যে নাকি বোঝা যায়, বলপূর্বক যৌন সম্পর্ক হয়েছিল, না সম্মতি নিয়ে৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই পদ্ধতিকে ভিত্তিহীন বলে নিষিদ্ধ করার পক্ষপাতী৷
ছবি: picture-alliance/Photoshot
সর্বোচ্চ রায়
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ২০১৩ সালেই বলেছিল, দুই আঙুল পরীক্ষা ধর্ষিতার পক্ষে শারীরিক ও মানসিকভাবে অবমাননাকর৷ সরকারের বিকল্প পদ্ধতির সন্ধান করা উচিত৷
ছবি: CC-BY-SA-3.0 LegalEagle
আর্মিতে ভর্তি হতে গেলে
ইন্দোনেশিয়ায় মহিলারা আর্মিতে ভর্তি হতে চাইলে, তাঁদের এই পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়৷ দেশটির আর্মি প্রধান জেনারেল মোয়েলদোকোর কথায়, ‘‘দুই আঙুল পরীক্ষা নারীর আচার-আচরণ, চরিত্র নিরীক্ষণের মূল চাবিকাঠি৷’’ বলা বাহুল্য, দক্ষিণ এশিয়া ছাড়াও মধ্য-পূর্ব এবং উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোতেও এটি একটি চালু পরীক্ষা৷
ছবি: AFP/Getty Images/A. Berry
6 ছবি1 | 6
তবে নারীর জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক শহরের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে মিশরের কায়রো৷ পাকিস্তানের করাচি রয়েছে দ্বিতীয় অবস্থানে৷ ধর্ষণে সবার ওপরে থাকলেও নারীদের জন্য ‘সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক' শহরের তালিকায় দিল্লীর নাম রয়েছে চারে৷ এ তালিকায় ঢাকার অবস্থান সপ্তম৷ যৌ্ন সহিংসতার বিচারে ‘নারীর জন্য সবচেয়ে নিরাপদ' হিসেবে নাম এসেছে জাপানের রাজধানী টোকিওর৷
শিক্ষা, ভূমি বা সম্পত্তির মালিকানাসহ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রবেশাধিকারের আরেকটি তালিকায় দিল্লি রয়েছে তৃতীয় অবস্থানে৷ এ তালিকায় সবার ওপরে আছে লন্ডন৷