জার্মানির রাজধানী বার্লিনে এক ইমাম এক স্কুল শিক্ষিকার সঙ্গে করমর্দনে অস্বীকৃতি জানান৷ ফলে শিক্ষিকা ইমামকে বলেন, ‘নারীবিদ্বেষী এবং জার্মান জীবনে অভ্যস্ত হতে অক্ষম ব্যক্তি'৷ বিষয়টি বহুদূর গড়িয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
জার্মানি এবং ইউরোপে ‘হ্যান্ডশেক' বা করমর্দন সহকর্মী এবং পরিচিতদের মধ্যে অভিবাদনের সবচেয়ে প্রচলিত উপায়৷ কিন্তু সাম্প্রতিক এক ঘটনা করমর্দন নিয়ে একদিকে সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতার এবং অন্যদিকে যৌনবৈষম্যের বিতর্ক সৃষ্টি করেছে৷ এক শিয়া ইমাম গত ৩০ মে তাঁর সন্তানের স্কুলটিচারের সঙ্গে বৈঠকে করমর্দনে অস্বীকৃতি জানান৷ এরপর শিক্ষিকা বৈঠক তৎক্ষনাৎ শেষ করে ইমামকে দু'কথা শুনিয়ে দেন৷ পরবর্তীতে স্কুল কর্তৃপক্ষ ক্ষমা চাইলেও সেই ইমাম তা গ্রহণ করেননি৷
তুরস্কের পূর্বাঞ্চল থেকে আসা ইমামের প্রতিনিধিত্বকারী সংস্থার সাজিয়া সালাজ বলেন, ‘‘(করমর্দনে অস্বীকৃতি জানানোর সময়) ইমাম তাঁর হৃদয়ের উপর হাত দিয়ে বলেছিলেন, ‘দয়া করে মাফ করবেন, আমি ধর্মীয় কারণে করমর্দন করতে পারছি না৷' আমার মক্কেল উদ্ধত কোনো আচরণ প্রদর্শনের চেষ্টা করেননি৷''
এদিকে ঘটনার পর ক্ষমা চেয়ে চিঠি দেয়া ছাড়া আর কোনো কিছু জানায়নি স্কুল কর্তৃপক্ষ৷ একটি মিডিয়া এজেন্সির মাধ্যমে গণমাধ্যমের কাছে পাঠানো সেই চিঠি এখন সবাই দেখতে পাচ্ছে৷ চিঠিতে ইমামের সন্তান গ্রীষ্মের ছুটির পর আর সেই স্কুলে ফিরবে না বলে নিশ্চিত করা হয়েছে এবং ইমাম প্রয়োজন মনে করলে আলোচনার জন্য আবারো স্কুলে যেতে পারেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে৷
এটা পড়ার পর আপনি আর ‘হ্যান্ডশেক’ করবেন না
হ্যান্ডশেক বা করমর্দনকে আপনি কাউকে অভ্যর্থনা জানানোর বন্ধুত্বপূর্ণ কিংবা পেশাদার একটা উপায় মনে করেন, তাই না? আরেকবার ভাবুন৷ পশ্চিমা সংস্কৃতিতে রোগজীবাণু ছড়ানোর অন্যতম উপায় হচ্ছে হ্যান্ডশেক৷
ছবি: Fotolia/Andres Rodriguez
প্রাচীন প্রথা
দু’হাজারের বছরের বেশি সময় ধরে হ্যান্ডশেক চালু রয়েছে৷ প্রাচীন গ্রিক এই বোতলটি তার এক প্রমাণ৷ তবে গ্রিকরা তখন হ্যান্ডশেকের সঙ্গে রোগের সম্পর্কের বিষয়টি ধরতে পারেনি৷ তারা মনে করতো রোগবালাই ‘হিউমারের’ সঙ্গে সম্পর্কিত এবং ঈশ্বর প্রদত্ত শাস্তি৷
ছবি: picture alliance/Prisma Archiv
শান্তির ইঙ্গিত
ধারণা করা হয় হ্যান্ডশেকের শুরুটা হয়েছিল দু’জন মানুষের মধ্যে ইতিবাচক সম্পর্ক স্থাপনের উপায় হিসেবে৷ প্রাচীনকালে ডান হাত হ্যান্ডশেকের ভঙ্গিতে এগিয়ে দিয়ে বোঝানো যেত মানুষটি কোনো অস্ত্র প্রদর্শন করছে না৷ তাছাড়া হ্যান্ডশেক মানুষের মস্তিষ্কে ‘অক্সিটোকিন’ হরমোন নিঃসরণ করে যা দু’জন মানুষের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে গড়তে সহায়ক৷ তবে গবেষকরা বলছেন, এভাবে জীবাণুও ছড়ায়৷
ছবি: Fotolia/Sergiy Serdyuk
ভিন্ন ভিন্ন অর্থ
সংস্কৃতিভেদে হ্যান্ডশেকের অর্থও ভিন্ন হয়৷ পশ্চিমা সমাজে দৃঢ় করমর্দনের মাধ্যমে ব্যক্তির ইতিবাচক এবং সুদৃঢ় মনোভাব ফুটিয়ে তোলা হয়৷ তবে পূর্বের সংস্কৃতিতে নরম করমর্দনের প্রচলন বেশি৷ সেখানে দৃঢ় করমর্দনকে আধিপত্য স্থাপনের চেষ্টা হিসেবে বিবেচনা করা হয়৷
ছবি: imago/imagebroker
নোংরা অভ্যাস
হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে সর্দি বা জ্বরের ভাইরাস, পাঁচড়ার জীবাণু, এবং স্ট্যাফিলোকোকাসের মতো ব্যাকটেরিয়া একজনের দেহ থেকে অন্যের দেহে পৌঁছায়৷ আপনি নিজেই ভাবুন, সর্দি হলে কী করেন? হাত দিয়ে নাক পরিষ্কার করেন, তাই না? এভাবেই নাক দিয়ে হাতে যায় ভাইরাস, সেখান থেকে হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে অন্যের দেহে৷ এরপরও কি হ্যান্ডশেক করতে মন চাইছে আপনার?
ছবি: picture alliance/dpa/Centers for Disease Control and Prevention/MCT /Landov
পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার উপায়
হ্যান্ডশেকসহ বিভিন্ন উপায়ে আসা রোগজীবাণু থেকে বাঁচার অন্যতম উপায় হচ্ছে নিয়মিত গরম পানি এবং সাবান ব্যবহার করে হাত ধোয়া৷ তবে অনেক মানুষই এব্যাপারে সচেতন নয়৷ এক জরিপ বলছে, গণশৌচাগার ব্যবহারের পর মাত্র দুই-তৃতীয়াংশ ব্যক্তি পানি দিয়ে হাত পরিষ্কার করেন৷
ছবি: BilderBox
হ্যান্ডশেক ফোবিয়া
বিল গেটস এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিরা করমর্দন করেন না৷ সম্ভবত রোগজীবাণু থেকে দূরে থাকতে এই চেষ্টা তাঁদের৷ তবে একান্ত যদি হ্যান্ডশেক থেকে রেহাই পাওয়ার উপায় না থাকে, তাহলে সঙ্গে রাখতে পারেন ‘হ্যান্ড-সেনিটাইজার৷’ তাহলে প্রতিবার করমর্দনের পর এটি ব্যবহার করে হাত জীবাণুমুক্ত করতে পারবেন৷
ছবি: Fotolia/koszivu
হ্যান্ডশেকের বিকল্প
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে সম্পৃক্ত স্থানগুলোতে হ্যান্ডশেক নিষিদ্ধের প্রস্তাব করা হয়েছে৷ বিশেষ করে হাসপাতালগুলো হতে পারে করমর্দন মুক্ত স্থান৷ আর হ্যান্ডশেকের সঙ্গে রোগ-বালাইয়ের সম্পর্ক নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতাও ক্রমশ বাড়ছে৷ ফলে ‘অ্যান্টি-হ্যান্ডশেক’ মুভমেন্টের প্রতি সমর্থন বাড়ছে৷ কিন্তু হ্যান্ডশেকের বিকল্প কি হতে পারে?
ছবি: Fotolia/Andres Rodriguez
মুঠো সম্ভাষণ
গবেষকরা বলছেন, করমর্দনের বদলে হাত মুঠো করে উপরের ছবির মতো করে সম্ভাষণ বা অভিবাদন জানালে নাকি রোগজীবাণু ছড়ানোর আশঙ্কা ৯০ শতাংশ কমে যায়৷ প্রশ্ন হচ্ছে, এই পন্থা কি আপনার পছন্দ?
ছবি: picture-alliance/AP Photo/Stew Milne
8 ছবি1 | 8
তবে সালাজ জানিয়েছেন, তাঁর মক্কেল ক্ষমা প্রার্থনার চিঠিটি গুরুত্ব সহকারে নিতে পারছেন না, কেননা, যে শিক্ষিকা তাঁর সঙ্গে এমন আচরণ করেছেন, তিনি সরাসরি চিঠিটি পাঠাননি৷ পাশাপাশি চিঠিতে সন্তানের বিষয়টি বিবেচনায় আনা হয়নি বলেও মনে করেন তিনি৷ সালাজ মনে করেন, স্কুলের উচিত ইমামের সন্তানকে সরাসরি জানানো যে, তার বাবার সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে সেটা ভুল ছিল৷
এদিকে, অনলাইন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চিঠিটি নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে৷ কেউ কেউ মনে করছেন, স্কুল কর্তৃপক্ষ যৌনবৈষম্য ইস্যুতে শক্ত অবস্থান না নিয়ে পিছু হঠেছে৷
সালাজ অবশ্য ধর্ষণ বিষয়ক সাম্প্রতিক আইনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘‘প্রত্যেকের নিজের সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে তিনি শারীরিক স্পর্শ চান, নাকি চান না৷ ‘না মানে না' - এটা আমরা এখন জার্মানিতে আলোচনা করছি৷''
নারীর সঙ্গে পুরুষের করমর্দনের বিষয়টি ইসলামে নিষিদ্ধ কিনা সেটা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে৷ ফ্রাইবুর্গের ইসলাম বিশেষজ্ঞ আব্দেল-হাকিম উরঘুই এ বিষয়ে বলেন, ‘‘সমগ্র কোরআনের কোথাও একটি লাইন নেই যেখানে একজন পুরুষকে একজন অপরিচিত নারীকে সম্ভাষণ জানাতে নিষেধ করা হয়েছে৷ করমর্দনের মাধ্যমে একে অপরকে অভ্যর্থনা জানানো পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধার লক্ষণ৷ সেটা না করা অবজ্ঞার লক্ষণ৷''