ফেসবুকের মাধ্যমে ভুয়া খবর ছড়ানো নিয়ে ব্যাপক বিতর্কের পর সামাজিক মাধ্যমটি কিছু উদ্যোগ নিয়েছে৷ সে কারণে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ছেন ভুয়া খবর ছড়ানো বড় বড় রাজনীতিবিদরাও৷ এবার প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোগ নিতে হবে নারীর সম্মানরক্ষায়৷
বিজ্ঞাপন
কিছুদিন আগে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেখে আঁতকে উঠেছিলাম৷ বাংলাদেশে আওয়ামীপন্থি হিসেবে পরিচিত একটি পত্রিকা সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত উল্লেখ না করে একটি মনগড়া প্রতিবেদন প্রকাশ করে৷ আর সেই সংবাদটি ফেসবুকে শেয়ার করেন দেশটির একজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ৷
ফেসবুকে সেই রাজনীতিবিদের ফলোয়ার প্রায় তিন মিলিয়ন৷ ফলে পোস্টটি মুহূর্তেই পৌঁছে যায় অনেকের ডিজিটাল দেয়ালে৷ কিন্তু বিপত্তি বাঁধায় ফেসবুক নিজেই৷ সেই পোস্টের নীচে একটি ট্যাগ জুড়ে দিয়ে জানিয়ে দেয়, পোস্টটি মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারে, কেননা, এটির প্রেক্ষাপট ঠিক নেই৷ সেই ট্যাগে ক্লিক করলে আবার আরেকটি প্রতিবেদন আসে, যেখানে আলোচিত পত্রিকাটির প্রতিবেদনটি যে ২০১৮ সালে অন্য একটি পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন চুরি করে নিয়ে পুনরায় প্রকাশ করা সেই কথা রয়েছে৷
ভুয়া খবররোধে বা মানুষকে সে বিষয়ে সচেতন করতে ফেসবুকের এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়৷ বর্তমানে দেখা যাচ্ছে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত ভুয়া খবর বা ভিডিও নিয়ে ফেসবুকে রিপোর্ট করা হলে আগের চেয়ে দ্রুতই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে৷ আর সেক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে সেই তথ্য যাচাই করে দেখা হয়৷ কিছুদিন আগেও বিষয়টি এমন ছিল না৷
ফেসবুকের এমন উদ্যোগের পাশাপাশি আমি মনে করি, নারীর মানসম্মান রক্ষায়ও ফেসবুকের আরো উদ্যোগী হতে হবে৷ মাঝেমাঝেই শোনা যায়, ফেসবুকে নগ্ন ছবি বা ভিডিও ছড়িয়ে দেয়ার নামে কোনো নারীকে হেনস্থা করা হচ্ছে, ধর্ষণ করা হচ্ছে৷ এমনকি এরকম পরিস্থিতি এড়াতে কখনো কখনো ভুক্তভোগী আত্মহত্যার পথও বেছে নিচ্ছে৷
সম্প্রতি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের এরকম এক ঘটনায় গোটা বাংলাদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে৷ সেই নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে৷ অনেকে সেটা দেখেছেন এবং তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন৷ এরকম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হওয়ায় সেই ঘটনার বিচারের পথ সুগম হয়েছে এটা যেমন সত্যি, তেমনি এটাও সত্যি যে, নিপীড়করা সেই নারীর ভিডিও প্রকাশের মাধ্যমে তার যে সম্মানহানির চেষ্টা করেছিলেন সেটাও ঘটেছে৷
ফেসবুকের উচিত এ ধরনের কন্টেন্ট প্ল্যাটফর্মটিতে কেউ প্রকাশ করার পর সঙ্গে সঙ্গে বা যত দ্রুত সম্ভব তা বিস্তারিত তথ্যসহ স্থানীয় পুলিশকে জানানো এবং ভিডিওটি সরিয়ে ফেলা৷ সেক্ষেত্রে ভুক্তভোগী নারীর সম্মানহানি যেমন ঠেকানো যাবে তেমনি যারা এমন অপকর্ম করছে তাদেরকে ধরাও সহজ হবে৷ কারিগরিভাবে বিষয়টি হয়ত এখনো জটিল, তবে ভুয়া খবর রোধে যেমন উদ্যোগ নেয়া গেছে এক্ষেত্রেও কোনো একটি পন্থা নিশ্চয়ই বের করা সম্ভব৷ আর সেটা যত দ্রুত করা যাবে ততই মঙ্গল৷
পাশাপাশি ফেসবুকের উচিত ব্যাপক প্রচারনা চালিয়ে এটা নিশ্চিত করা যে, এরকম কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে নারীরা দ্রুত সহায়তা পাবেন৷ সেক্ষেত্রে প্ল্যাটফর্মটি নারীদের জন্য আরো নিরাপদ যেমন হয়ে উঠবে, তেমনি সমাজে এ সংক্রান্ত ভীতিও কাটবে৷
সাইবার বুলিং ও আত্মহত্যা
অনলাইনে হয়রানি বা সাইবার বুলিংয়ের কারণে অনেকেই হতাশায় ভোগেন৷ এদের একটি অংশ হতাশা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন৷
জাপানের ২২ বছর বয়সি হানা কিমুরা একজন পেশাদার কুস্তিগীর ছিলেন৷ এছাড়া নেটফ্লিক্সের জনপ্রিয় রিয়েলিটি টিভি শো ‘টেরাস হাউস’-এ অভিনয় করেছেন তিনি৷ এ বছরের ২৩ মে আত্মহত্যা করেন কিমুরা৷ অনলাইনে টেরাস হাউসের দর্শকদের ক্রমাগত সমালোচনার প্রতিক্রিয়ায় আত্মহত্যা করার আগে বেশ কয়েকটি টুইট করেছিলেন তিনি৷ কিমুরার টুইটগুলোতে আত্মহত্যার আভাস ছিল৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Pizzoli
সল্লি
দক্ষিণ কোরিয়ার ২৫ বছর বয়সি সল্লি একজন অভিনেত্রী, গায়িকা ও মডেল ছিলেন৷ মেয়েদের বিখ্যাত কে-পপ ব্যান্ড ‘এফ (এক্স)’-এর সাবেক সদস্য ছিলেন তিনি৷ তবে তার আরেক পরিচয় তিনি ‘নো-ব্রা’ আন্দোলনের একজন সমর্থক ছিলেন৷ অর্থাৎ, মেয়েদের বক্ষবন্ধনী না পরার পক্ষে ছিলেন সল্লি৷ এ কারণে তাকে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হতে হয়েছে৷ এসবের কারণে হতাশায় ভুগে গতবছর অক্টোবরে আত্মহত্যা করেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/Yonhap
খু হারা
দক্ষিণ কোরিয়ার কে-পপ ব্যান্ড ‘খারা’র সদস্য খু হারা গতবছর নভেম্বরে আত্মহত্যা করেন৷ তিনিও সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়েছিলেন৷ তার সাবেক প্রেমিক বিনা অনুমতিতে ধারণ করা তাদের যৌন মিলনের ভিডিও প্রকাশের হুমকি দিলে মামলা করেছিলেন খু হারা৷ এরপর ঐ ভিডিও প্রকাশিত হলে অনলাইনে হয়রানির শিকার হয়েছিলেন তিনি৷ ভালো বন্ধু সল্লির মাসখানেক পর আত্মহত্যা করেন খু হারা৷
ছবি: picture-alliance/YONHAPNEWS AGENCY
অ্যামান্ডা টড
ক্যানাডার ১৫ বছর বয়সি টড সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়ে ২০১২ সালে আত্মহত্যা করে৷ তার আগে ইউটিউবে সে একটি ভিডিও পোস্ট করে৷ অ্যামান্ডা জানায়, সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় ভিডিও চ্যাট করতে গিয়ে একজনে সঙ্গে তার পরিচয় হয়৷ একসময় সে তাকে তার খোলা বুক দেখাতে রাজি করায়৷ এরপর সেই ছবি বন্ধুদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেয়৷ পরে তা সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশও করা হয়৷ এই ঘটনায় অ্যামান্ডাকে কয়েকবার স্কুল বদল করতে হয়েছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
রুকাইয়া রূপা
পিরোজপুরের ভান্ডারিয়ার স্কুল শিক্ষার্থী রূপা (১৬) গত বছর আগস্টে আত্মহত্যা করে৷ পুলিশ ও পারিবারিক সূত্রের উল্লেখ করে প্রথম আলো জানায়, তামিম খান (১৮) নামে একজন রূপাকে তার সঙ্গে প্রেম না করলে আপত্তিকর ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেয়৷ রূপার বাবার দাবি, তার মেয়ের ছবি ফটোশপ করে তামিম বিভিন্নজনের কাছে ছড়িয়েছে৷ তাই তার মেয়ে আত্মহত্যা করেছে৷
ছবি: Klicksafe/M. Kusch
অ্যামি ‘ডলি’ এভারেট
১৫ বছরের অস্ট্রেলীয় এই শিক্ষার্থী সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়ে ২০১৮ সালে আত্মহত্যা করে৷ এরপর অস্ট্রেলিয়ায় সাইবার বুলিং নিয়ে আলোচনা শুরু হয়৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/Akubra Hats
১০ বছরের মারিয়ান
যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনার মেসা শহরের দশ বছর বয়সি মারিয়ান হার্নান্দেজ রোখাস সম্প্রতি আত্মহত্যা করেছে৷ সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়ে সে এ কাজ করেছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় দৈনিক ‘দ্য অ্যারিজোনা রিপাবলিক’ জানিয়েছে৷ মোবাইলে তাকে নানারকম বার্তা পাঠিয়ে হয়রানি করা হতো বলে জানিয়েছে রোখাসের বন্ধুরা৷
ছবি: picture-alliance/empics/P. Byrne
প্যারিস জ্যাকসন
মাইকেল জ্যাকসনের মেয়ে প্যারিস জ্যাকসন তার চেহারা নিয়ে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়েছেন৷ সে কারণে তিনি আত্মহত্যার চেষ্টাও করেন বলে ২০১৭ সালে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন৷ তিনি বলেছিলেন, ‘‘বাকস্বাধীনতার বিষয়টি ভালো৷ কিন্তু আমার মনে হয় আমাদের জাতির জনকেরা যখন সংশোধনী (সংবিধানে) রচনা করছিলেন তখন সামাজিক মাধ্যমের বিষয়টি অনুধাবন করতে পারেননি৷’’
ছবি: Getty Images/N. Barnard
বিজয়লক্ষ্মী
তামিল অভিনেত্রী বিজয়লক্ষ্মী সম্প্রতি আত্মহত্যার চেষ্টা করেন৷ তামিল নায়ক কাম রাজনীতিবিদ সীমানের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ এনেছিলেন তিনি৷ তার অভিযোগ, সীমান তাকে বিয়ের অঙ্গীকার করেছিলেন৷ আত্মহত্যার জন্য বিপি ট্যাবলেট খেয়েছেন জানিয়ে ২৬ জুলাই রাতে ফেসবুকে ভিডিও প্রকাশ করেন বিজয়লক্ষ্মী৷ তিনি অভিযোগ করেন, সীমানের দলের লোকেরা কয়েকমাস ধরে অনলাইনে তাকে হয়রানি করেছে৷ সেজন্য তিনি প্রচণ্ড চাপ অনুভব করেছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বাংলাদেশ পরিস্থিতি
গতবছর ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত ইউনিসেফের গবেষণা বলছে, বাংলাদেশের ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সি শিশুদের মধ্যে ৩২ শতাংশ সাইবার হয়রানির মুখে পড়ছে৷ এদিকে, গতবছর সেপ্টেম্বরে ঢাকা মহানগর পুলিশের সাইবার নিরাপত্তা ও অপরাধ বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার মিশুক চাকমা জানান, ঢাকায় অনলাইনে হয়রানির শিকার নারীদের ৭০ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে৷