যৌনাঙ্গচ্ছেদ, অপহরণ, ধর্ষণ, শিক্ষায় বাধা৷ এই রকমই ছিল ৫০-এর দশকে ইথিওপিয়ার সামাজিক চিত্র৷ এ ধরনের বিদ্বেষমূলক পরিবেশ থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছেন বোগালেথ গেবরে৷ তৈরি করেছেন আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার৷
বিজ্ঞাপন
‘কেএমজি ইথিওপিয়া' নারী উন্নয়নমূলক এক প্রতিষ্ঠান৷ ‘কেএমজি' অর্থ হলো ‘মেয়েরা কামবাটির জন্য এক সঙ্গে কাজ করে'৷ এটি ইতিমধ্যে বেশ কিছু পুরস্কার পেয়েছে৷ সম্প্রতি বোগালেথকে নারী উন্নয়নে অবদানের জন্য ব্রাসেলসে ‘কিং বোদুয়াঁ আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট পুরস্কার' দিয়ে সম্মানিত করা হলো৷
সোনার জন্য সংগ্রাম
মাটির তলা থেকে সোনা সংগ্রহ, কাজটি মোটেই সহজ নয়৷ এই কঠিন কাজটি করছে বিদেশি প্রতিষ্ঠান৷ কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দারাও বাঁচতে চান৷ তাই মাঝেমাঝে খনিতে অনুপ্রবেশ করেন তারা, উদ্দেশ্যে ধ্বংসাবশেষ কুড়িয়ে এনে সোনা খোঁজা৷
ছবি: DW/J. Hahn
গুপ্তধন
তাঞ্জানিয়ার উত্তরপশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত উত্তর মারার মাটির নিচে রয়েছে ৩.৮ মিলিয়ন আউন্স সোনা৷ সেদেশের ছয়টি খনির একটি সেখানে অবস্থিত৷ ২০০৬ সাল থেকে এই খনিটি পরিচালনা করছে ‘আফ্রিকান বারিক গোল্ড’৷ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সোনার সন্ধানে খনি খননকারী প্রতিষ্ঠান বারিক গোল্ড’এর একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান এটি৷
ছবি: DW/J. Hahn
সোনার খনি
উত্তর মারায় উম্মুক্ত পদ্ধতিতে খনন করা তিনটি কূপের একটির নাম ‘গোকোনা’৷ এখানে প্রতিদিন বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মাটির তলা থেকে সোনাযুক্ত পাথর বের করা হয়৷ প্রতি একটন ভালো ম্যাটেরিয়ালের মধ্যে সোনা থাকে চার থেকে পাঁচ গ্রাম৷ আগামী দশ বছরের মধ্যে অবশ্য এখানকার সোনার মজুদ শেষ হয়ে যাবে৷
ছবি: DW/J. Hahn
চাকুরির আশা
উত্তর মারাতে অন্যতম চাকুরিদাতা হচ্ছে ‘দ্য আফ্রিকান বারিক গোল্ড’৷ সেখানে দু’হাজারের বেশি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত৷ তাসত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট এলাকায় অনেক মানুষ এখনো চাকুরিহীন অবস্থায় দিনযাপন করছেন৷
ছবি: DW/J. Hahn
কাঁটাতারের বেড়া
খনি রক্ষায় এরকম বেড়া দেওয়া হয়েছে৷ তবে লুণ্ঠনকারীরা মাঝেমাঝেই এই বেড়া কেটে ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করে৷ খনি খননকারী প্রতিষ্ঠান তাই সেদিকে কড়া নজর রাখে৷ বেসরকারি নিরাপত্তা কর্মী এবং তাঞ্জানিয়ার পুলিশ নিয়মিত খনি পাহারা দেয়৷ মাঝেমাঝেই নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে স্থানীয় বাসিন্দাদের সংঘর্ষ বাঁধে৷ এতে হতাহতের ঘটনাও ঘটে৷
ছবি: DW/J. Hahn
অনুপ্রবেশকারীরা
প্রায় এরকম দল বেঁধে জোর করে খনিতে প্রবেশ করে সাধারণ মানুষ৷ এরপর সোনাযুক্ত পাথর খুঁজে বের করে তারা৷ সেগুলো মধ্যসত্ত্বভোগীদের কাছে বিক্রি করে কিছু টাকা আয় করে তারা৷
ছবি: DW/J. Hahn
সোনা খনক
‘আমরা শুধুমাত্র খননের পর যা রয়ে গেছে তা খুঁজি, কিন্তু পুলিশ আমাদেরকে তাড়িয়ে দেয়’, বলেন জুমেনি৷ তিনি বলেন, পুলিশ আমাদেরকে গ্রাম থেকে অনুসরন করতে থাকে৷ আরো অনেক গ্রামবাসীর মত জুমেনিরও দাবি হচ্ছে, খনি খনকরা ধ্বংসাবশেষ তাদের জন্য রেখে দিক৷ যেগুলোর মধ্য থেকে সোনা খুঁজে জীবন নির্বাহ করবেন সাধারণ গ্রামবাসী৷
ছবি: DW/J. Hahn
সোনার সন্ধান
খনির মধ্য থেকে ধ্বংসাবশেষ কুড়িয়ে আনার পর সেসবের মধ্যে ছিটেফোঁটা সোনা আছে কিনা তা পরীক্ষা করা হয় এভাবে৷ মূলত ঘণ্টার পর ঘণ্টা এভাবে সোনা খোঁজেন নারীরা৷ এই কাজ করে মাস শেষে তাদের আয় হয় মাত্র ১৩ মার্কিন ডলারের মতো৷
ছবি: DW/J. Hahn
বিস্মৃত অঞ্চল
তাঞ্জানিয়ার অন্যতম গরীব এবং অনুন্নত অঞ্চল হচ্ছে উত্তর মারা৷ সেখানে অবস্থিত খনিটির আশেপাশের সাত গ্রামের মানুষ আগে নিজেরাই সোনা খুঁজে জীবিকা নির্বাহ করতেন৷ কিন্তু নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের নজর পড়ে সেদিকে৷ ফলে সোনা খোঁজা বাদ দিয়ে এখন গ্রামবাসীরা চাষাবাদ করে অর্থ উপার্জনের চেষ্টা করছেন৷ এভাবে খুব কমই রোজগার হয় তাদের৷
ছবি: DW/J. Hahn
হতাশা
‘খনি আমাদের জন্য কিছুই করেনি’, কাওয়ানজা গ্রামের বাসিন্দারা করলেন এই অভিযোগ৷ তাদের জন্য পানির কোন সুব্যবস্থা নেই, নেই বিদ্যুৎ৷ সেখানে অবস্থানরত ২০টি পরিবার মানবেতর জীবনযাপন করছেন৷ সবমিলিয়ে তাদের মাসিক আয় মাত্র ১৪০ ইউরো৷
ছবি: DW/J. Hahn
হারানো সন্তান
‘খনি আমাদের কাছ থেকে সবকিছু কেড়ে নিয়েছে’, বললেন গাতি মারেমবেরা মুইতা৷ গত বছরের ছয় নভেম্বর এক পুলিশ সদস্য তার সন্তানকে গুলি এবং হত্যা করে৷ এর আগে অবশ্য খবর ছড়িয়েছিল যে, কয়েকশত তরুণ গ্রামবাসী সনাতন অস্ত্র নিয়ে সোনার খনিতে হামলা করেছে৷ তবে এই পিতা জানিয়েছেন, আমার সন্তান খনিতে অনুপ্রবেশকারীর দলে ছিল না৷ সে খনির কাছে রাখালের কাজ করছিল৷
ছবি: DW/J. Hahn
পুরস্কার
পাথর-গুড়া-সোনা৷ গ্রামবাসী এই প্রক্রিয়ায় সোনা সংগ্রহে বিশেষ পারদর্শী হয়ে উঠেছেন৷ তবে কাজটি খুবই কঠিন৷ সোনা পেতে খনি থেকে সংগৃহীত গুড়া অত্যন্ত বিষাক্ত মারকারির সঙ্গে মেশানো হয়৷ এতে করে সোনার গুড়াজট বাঁধে৷ এই গ্রামবাসীর হাতে যে সোনার ছোট্ট টুকরাটি দেখছেন, সেটির মূল্য ২০ ইউরো৷
ছবি: DW/J. Hahn
11 ছবি1 | 11
একসময় আমি নিজেই নিজেকে বলেছি, ‘‘আমি তো গরু নই৷ আমার সঙ্গে পশুর মতো আচরণ করতে দেব না৷'' এইভাবেই বোগালেথ তাঁর স্বদেশ ইথিওপিয়ার পরিস্থিতি সম্পর্কে বর্ণনা করছিলেন৷ তাঁর ভাষায় ‘‘মেয়েদের সেখানে এমনভাবে বড় করা হয়, যেখানে তাদের সবসময় ‘না' ‘না' শুনতে হয়৷ এভাবে হেঁটো না, ওভাবে হেসো না, এভাবে বসো না, ওভাবে কাপড় পরো না৷ এসব শুনতে শুনতেই আমরা বড় হয়েছি৷ কিন্তু স্বাধীনতাই সবকিছু৷ স্বাধীনতা ছাড়া তুমি কিছুই চিন্তা করতে পারো না৷''
স্বাধীনতার জন্য লড়াই
এই স্বাধীনতার জন্য বোগালেথকে, যাকে বোগে বলে ডাকা হয়, অনেক লড়াই করতে হয়েছে৷ সমাজের অনুশাসনের বিরুদ্ধে গোপনে স্কুলে ভর্তি হন তিনি৷ প্রতিভা ও অধ্যাবসায়ের গুণে এগিয়ে যান৷ বোগেই তাঁর অঞ্চলের প্রথম মেয়ে, যিনি রাজধানী আদ্দিস আবাবায় হাইস্কুলের বেড়া ডিঙাতে সক্ষম হন৷ এরপর বৃত্তি নিয়ে যাত্রা ইসরাইলে৷ তারপর অ্যামেরিকায়৷ সেখানে ডক্টরেটের থিসিস লেখেন এপিডেমিওলজি বা মহামারি সংক্রান্ত বিদ্যায়৷ কিন্তু স্বদেশকে তিনি ভুলে যাননি৷ ১৯৯৭ সালে তিনি ফিরে আসেন তিনি ইথিওপিয়ায়৷
বিয়ের আগে প্রস্তুত করা
বোগালেথ জানান, ‘‘আমি দেখেছি, মেয়েদের অবস্থাটা সেখানে কীরকম? সেখানে বিয়ের আগে মেয়েদের যৌনাঙ্গচ্ছেদের উত্সব পালন করা হয়৷ যা ঘটে তা ভাষায় বর্ণনা করার মতো নয়৷ বিভীষিকাময়৷ কিন্তু মেয়ে বিয়ের উপযুক্ত হওয়ায় বেশ গর্ববোধ করে মায়েরা৷''
বোগালেথ গেবরে জানেন, কোন বিষয়ে তিনি কথা বলছেন৷ ১২ বছর বয়সে নিজের যৌনাঙ্গচ্ছেদের সময় রক্তপাত হয়ে প্রায় মরেই যাচ্ছিলেন স্বাধীনচেতা এই নারী৷ এই ধরনের নিদারুণ অদৃষ্টের হাত থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মেয়েদের রক্ষা করতে চান বোগো৷
আর তাই তো বোনের সঙ্গে মিলে কেএমজি সংস্থাটি গড়ে তোলেন তিনি৷ উদ্যোগ নেন মেয়েদের বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রতিরোধে৷ দুই বোন নিজের এলাকা কাম্বাটিতে ৫০০০ ডলার পুঁজি নিয়ে যাত্রা শুরু করেন৷ কুয়া ও সেতু তৈরির প্রকল্প গড়ে তোলেন৷ এর ফলে গ্রামবাসীদের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হন দুই বোন৷ আয়োজন করেন বিভিন্ন সভা সমিতি ও আলোচনা অনুষ্ঠানের৷
নির্দেশ নয় বোঝানো
এই প্রসঙ্গে বোগালেথে জানান, ‘‘তোমরা এটা ভুল করছো' কিংবা ‘ওটা খারাপ' এই ধরনের নির্দেশ দিতে আমরা চাইনি৷ তার চেয়ে মেয়েদের যৌনাঙ্গচ্ছেদের মারাত্মক ফলাফল সম্পর্কে মানুষকে বোঝাতে চেয়েছি আমরা৷ আমাদের কথা শুনে অনেকেই মাথা নেড়ে সায় দিয়েছেন৷ কেউ কেউ কেঁদেছেন৷ অবশেষে ২০০২ সালে যৌনাঙ্গচ্ছেদ না করা প্রথম মেয়েটির বিয়ে হয় প্রকাশ্যে৷''
সেই সময়ে হাজার হাজার মানুষ ঐ দম্পতিকে দেখতে এসেছিলেন৷ এরপর অল্পবয়সী মেয়েরা এক ধরনের পরিচয়-পত্র বহন করতে শুরু করে, যাতে লেখা থাকে ‘‘আমি যৌনাঙ্গচ্ছেদ করতে দেব না৷ আমাকে দেখে তোমরাও শেখ৷'' এই ঘটনার পর জাতিসংঘের শিশুবিযয়ক সংস্থা ইউনিসেফের এক জরিপে দেখা গেছে কেজিএম-এলাকার প্রায় সব মানুষই মেয়েদের যৌনাঙ্গচ্ছেদের বিরুদ্ধে মতামত দিয়েছেন৷
নারী পুরুষের সমানাধিকারের দাবি
ইতোমধ্যে বোগে এইচআইভি/এইডস, নারী পুরুষের সমানাধিকার ইত্যাদি বিষয়গুলির দিকেও মনোযোগ দিয়েছেন৷ দুই বোনের ছোট্ট এক প্রকল্প থেকে একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে এখন এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নানা পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছে৷
কীভাবে এত সব অর্জন করতে পারলেন বোগালেথ? এই প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, কার কাছে কৃতজ্ঞ তিনি৷ তাঁর কথায় স্পষ্ট হলো সেটাই, ‘‘আমার মায়ের কাছে কৃতজ্ঞ আমি৷ তিনি আমাকে গোপনে স্কুলে যেতে অনুমতি দিয়েছিলেন৷ তিনি চেয়েছিলেন, মেয়েরা তাঁর চেয়ে ভালোভাবে জীবন কাটাক৷ আমার স্বাধীনতার জন্য আমি তাঁর কাছে অসীম ঋণী৷''