তারা বলছেন, একদিকে মিডিয়ার নীতিবিবর্জিত, হীন ভূমিকা তদারকি করে তা বন্ধে নেই কোনো ব্যবস্থা৷ অন্যদিকে, এ নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে সমালোচনা ও বিতর্ক হলেও গণমাধ্যমের নীতি নির্ধারকদের টনক নড়ছে না৷ ফলে এই প্রবণতা বন্ধ না হয়ে বেড়েই চলেছে৷

কুমিল্লার মুরাদনগরে এক নারী ধর্ষণের ঘটনায় মিডিয়ার ভূমিকা নতুন করে আলোচনায় উঠে আসে৷ গত ২৬ জুন রাতে এক গৃহবধূকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে৷ এরপর স্থানীয় কয়েকজন যুবক ওই নারীকে বিবস্ত্র করে মারধর করে তার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়েও দেয়৷

পরের দিন সকাল থেকে সাংবাদিক ও ইউটিউবাররা দলে দলে ওই নারীর বাড়িতে ভিড় জমায়৷ আইন অনুযায়ী ভুক্তভোগীর পরিচয় গোপন রাখার কথা থাকলেও অনেকে তা অমান্য করে তারা নারীর ভিডিও ধারণ ও প্রকাশ করে৷ মূলধারার কিছু সংবাদমাধ্যমও তার ছবি ও ভিডিওসহ বিস্তারিত প্রতিবেদন করে৷ সাংবাদিকরা তাকে বারবার অস্বস্তিকর প্রশ্ন করে বিব্রত করতে দ্বিধা করেনি৷ এমন পরিস্থিতিতে মানসিক চাপ নিতে না পেরে তিনি বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হোন৷

মানসিকভাবে বিপর্যস্ত একজন নারীর সাথে কিছু সংবাদমাধ্যম যে আচরণ করেছে সেটাকেই অপরাধ হিসেবে গণ্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন৷

ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, সংবাদমাধ্যমে যারা গেটকিপার বা নীতিনির্ধারক তারা তো জানেন যে কি প্রকাশ করা যাবে আর কি প্রকাশ করা যাবে না৷ কিন্তু তারা সেটা ভুলে যাচ্ছেন৷ এটা করে তারা যে শুধু নিয়ম-নীতি ভঙ্গ করছেন তা না, আইনের বরখেলাপ করছেন, যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ৷

এর পেছনে নানান কারণ থাকলেও প্রতিযোগিতা একটি বড় কারণ বলে মনে করেন জেন্ডার ও গণমাধ্যম নিয়ে গবেষণা করা এই শিক্ষক৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা লক্ষ্য করেছি, গণমাধ্যমগুলো এক ধরনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত যেখানে কে কার আগে খবর বা ভিডিও প্রকাশ করে ভিউ বৃদ্ধি করবে সেটা বড় বিষয়৷ মুরাদনগরের ঘটনায় দেখা যায় অনেক মিডিয়া নারীর ধর্মীয় পরিচয় ব্যবহার করছে৷ একজন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে, কিন্তু তিনি কোন ধর্মের সেটা উল্লেখ করার প্রয়োজন ছিল না৷ আবার বলা হয়েছে প্রবাসীর স্ত্রী৷ অভিযুক্ত ব্যক্তির সাথে তার পরকীয়া প্রমাণেরও চেষ্টা করে অনেকে৷ মোটকথা গণধর্ষণ হয়েছে কিনা না তা নিশ্চিত না হয়েই অধিকাংশ মিডিয়া শব্দটি ব্যবহার করেছে৷ মূল ঘটনা উৎঘাটন করার আগেই সবাই ব্যস্ত হয়ে যায় নারীকে নিয়ে৷''

এই প্রবণতা বন্ধ করতে হলে একটি মনিটরিং বডি থাকা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন৷ গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন যে স্বাধীন গণমাধ্যম কমিশন প্রতিষ্ঠার কথা বলেছে সেটা উল্লেখ করে সাংবাদিকতার এই শিক্ষক বলেন, "কোনো একটা ব্যবস্থা থাকতে হবে যার কাজ হবে গণমাধ্যম নারী ও শিশুসহ স্পর্শকাতর বিষয়ে নীতি ও আইন ভঙ্গ করলে তাদের নিবৃত করতে ব্যবস্থা নেয়া৷

একাত্তর টিভির জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক শাহনাজ শারমিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, কিছু দিন আগে আছিয়া নামের একটি শিশুর বেলাতেও অনেক মিডিয়া ন্যাক্কারজনক কাজ করে সমালোচিত হয়৷ সে সময় দেখেছি শিশুটি খালি গায়ের ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলো৷

তিনিও মনে করেন গণমাধ্যমে অসুস্থ প্রতিযোগিতা ও নারী ও শিশুর ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় এমনটি ঘটে চলেছে৷ তিনি আক্ষেপ করে বলেন, গণমাধ্যমের নীতি নির্ধারকরা সবাই জানেন তারপরও তারা প্রতিটি ঘটনায় নারীর ছবি,পরিচয় প্রকাশ করেন৷ অপরাধীর ছবি বড় বড় করে না ছাপিয়ে বার বার নারীর ছবি প্রকাশ করেন তারা৷ "এক কারণ হচ্ছে প্রতিযোগিতা৷ কারণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অথবা কোন একটি একটি নারীর ছবি বা ভিডিও প্রকাশ করলে অন্যরা মনে করে তারা পিছিয়ে পড়ছে৷ ফলে তারাও অনৈতিক কাজটি করতে দ্বিধা করে না,” বলছিলেন শাহনাজ শারমিন৷

দি ডেইলি স্টারের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক জায়মা ইসলাম বলেন, মুরাদনগরে ধর্ষণের শিকার নারীর সাথে সাংবাদিকরা যা করেছে তাতে তিনি মর্মাহত, শোকাহত ও লজ্জিত৷ তিনি বলেন, অভিযুক্ত ধর্ষণকারীর সাথে ওই নারীর কী সম্পর্ক সেটা নিয়ে বার বার ব্যক্তিগত প্রশ্ন করছিল৷ টাকা লেনদেন ছাড়া আর কোন সম্পর্ক নেই বলার পরেও একই প্রশ্ন আবার করা হয়৷ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ওই নারীর সাক্ষাৎকার দেখে মনে হচ্ছিল তিনি বেশ অস্বস্তি বোধ করছিলেন৷ কিন্তু এরপরও তাকে ছাড় দেয়া হয়নি৷ ফলে তিনি বাড়ি ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন৷

এই দুই সংবাদকর্মী ও শিক্ষক মনে করেন, মফস্বলে যারা সাংবাদিকতা করেন তাদের নীতি ও নৈতিকতা সম্পর্কে ভাল ধারণা নাও থাকে পারে, কিন্তু যারা নিউজের কন্টেন্ট ও শিরোনাম বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয় তাদের এ বিষয়ে ধারণা না থাকার কোন কারন নাই৷ কাটতি বৃদ্ধি ও পাঠক-দর্শক আকৃষ্ট করার জন্য যে তারা তা করেন সেটা সহজেই বোঝা যায়৷

তারা বলেন, স্বাধীনতা ৫৩ বছর পেরিয়ে গেলও গণমাধ্যমে নারী ও শিশুদের নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কোন নীতিমালা দেখা যায় না৷ দুই দশকের বেশি সময় ধরে সম্প্রচার গণমাধ্যম চালু হয়েছে কিন্তু এখানেও শিশু বিষয়ক প্রতিবেদনে কি দেখানো হবে বা কি উহ্য রাখা হবে সে বিষয়ে কোনো ঐক্যমতে পৌঁছানো যায়নি৷ ফলে অনেক মিডিয়া লাগামহীনভাবে যা ইচ্ছা তাই করে যাচ্ছে৷ মুরাদনগরে নারীর সাথে মিডিয়া যা করেছে তা দেশের সাংবাদিকতা আরও এক ধাপ পিছিয়ে দিয়ে মবে তারা মনে করেন৷

এ অবস্থা থেকে উত্তোরণের জন্য সচেতনতার পাশাপাশি সাংবাদিক ও গেটকিপারদের মানসিকতা পরিবর্তন জরুরি বলে মনে করেন তারা৷

ধর্ষণের ঘটনাকে সংবাদের বড় পণ্য হিসেবে গণ্য করে বড় হেডলাইন, বিভ্রান্তিকর শিরোনাম ও বিভৎস বিবরণ থেকে বিরত থাকার আহবান জানিয়েছেন তারা৷ এছাড়াও ভুক্তভোগীকেই দোষারোপ করার সংস্কৃতি বন্ধ করে দায়িত্বশীল, তথ্যভিত্তিক এবং মানবিক সাংবাদিকতা সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে বলে তারা মনে করেন৷ অন্যথায়, আইনি সহায়তা বিচারের পাওয়ার পরিবর্তে ভিকটিম শুধু হয়রানির মুখোমুখি হবে৷