শুধু ভারতেই নয়, ডাইনিবিদ্যা অল্পবিস্তর বিশ্বের সর্বত্র আছে৷ ভারতের মতো দেশে কোনো নারীকে ডাইনি দাগিয়ে দেবার পেছনে আসল কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জমি দখল, পারিবারিক বিরোধ মেটাতে প্রতিশোধ চরিতার্থ করা বা যৌন শোষণে বাধা দেয়া৷
বিজ্ঞাপন
এর বিরুদ্ধে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনে অভিযোগ জানিয়ে কোনো ফল হয় না৷ কারণ এই সব হতভাগ্য নারীরা জানে না কোথায় গিয়ে কিভাবে অভিযোগ দায়ের করতে হবে, কী লিখতে হবে, কেমনভাবে লিখতে হবে৷
পুলিশও এঁদের অভিযোগকে তেমন গুরুত্ব দেয় না, অনেক সময় শোনেই না তাঁদের কথা৷ ফলে ডাইনি চিহ্নিত নারীর ওপর অত্যাচারের মাত্রা একটা অকথ্য স্তরে পৌঁছে যায়৷ সেই অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে সেই নারী হয় আত্মহত্যার পথ বেছে নেন, কিংবা নিজের লোকেরাই তাঁকে পিটিয়ে মারধোর করে মেরে ফেলে৷ অত্যাচার যে কোন স্তরে পৌঁছোতে পারে – শুনলে গা শিউরে উঠবে আমাদের৷ মানুষের মলমূত্র, মুরগির রক্ত খাওয়ানো হয়, জোর করে অর্ধচেতন অবস্থায় তাঁর মুখ দিয়ে নানা রকম অসংলগ্ন কথা বলানো হয়৷ এখানেই শেষ নয়, ডাইনি চিহ্নিত নারীর স্তন কেটে নেয়া হয়, দাঁত ভেঙে ফেলা হয়৷ এই তো কিছুদিন আগে ছত্তিশগড়ে একটি উপজাতি গ্রামের পরিবারে একটি বাচ্চা অনেকদিন ধরে অসুখে ভুগছে৷ শেষে বাড়ির লোকজনের সন্দেহ নিশ্চয় কেউ তুকতাক করেছে৷ তারপর সেই বাড়িরই ৫৫ বছরের এক মহিলাকে ডাইনি নাম দিয়ে নগ্ন করে রাস্তায় এনে চোখে মুখে এবং যৌনাঙ্গে লঙ্কার গুঁড়ো ছিঁটিয়ে প্রকাশ্যে ঢিল মেরে মেরে খুন করা হয়৷
নারীদের চলাফেরার জন্য বিপজ্জনক ৭টি শহর
থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশন এ নিয়ে সম্প্রতি একটি জরিপ করেছে৷ ৬,৫৫০ জন নারীর উপর চালানো ঐ জরিপে বলা হচ্ছে যে, বিশ্বের সাতটি শহরের পরিবহন ব্যবস্থা নারীদের জন্য খুবই বিপজ্জনক৷
ছবি: Christophe Archambault/AFP/Getty Images
নতুন দিল্লি, ভারত
কোনো নারী যদি একা একা এই শহরটি ঘুরে বেড়াতে চান, তবে তা নাকি সম্ভব নয়৷ এই শহরে আড়াই কোটি মানুষের বাস, মানুষের বাসবাসের দিক দিয়ে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজধানী এটি৷ ২০১২ সালের ডিসেম্বরে চলন্ত বাসে ২৩ বছরের এক তরুণীর গণধর্ষণের ঘটনাই প্রমাণ করে যে শহরটির গণপরিবহন ব্যবস্থা কতটা অনিরাপদ৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বোগোটা, কলম্বিয়া
নারীদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক পরিবহন ব্যবস্থার তালিকায় প্রথম স্থান বোগোটার৷ জরিপ বলছে, বোগোটায় ৯৬ লাখ মানুষের বাস৷ অথচ সেখানকার বাস ও ট্রেনের যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই খারাপ৷ বিশেষ করে রাতে কোনো নারী বাস ও ট্রেনে চলাফেরা করলে যৌন হয়রানি ও ছিনতাইয়ের কবলে পড়েন৷
ছবি: Reuters/John Vizcaino
মেক্সিকো সিটি, মেক্সিকো
২ কোটি ১০ লাখ মানুষের বাস মেক্সিকোর রাজধানীতে৷ জরিপ বলছে, এই শহরে যেসব নারী গণপরিবহনে চলাফেরা করেন তাঁরা প্রায়ই মৌখিক ও শারীরিক লাঞ্ছনার শিকার হন৷
ছবি: Reuters/Edgard Garrido
লিমা, পেরু
পেরুর রাজধানী লিমায় ৬২ লাখ মানুষের বাস৷ এই শহরের এক তৃতীয়াংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করে৷ ফলাফল গণপরিবহনে নারীদের চলাচল এখানে ভয়াবহ বিপদজনক৷ ছিনতাই, যৌন হয়রানি, শ্লীলতাহানি এখানকার নিত্যদিনের ঘটনা৷
ছবি: Reuters/Enrique Castro-Mendivil
জাকার্তা, ইন্দোনেশিয়া
জাকার্তার যোগাযোগ ব্যবস্থা ভীষণ ত্রুটিপূর্ণ৷ গণপরিবহনে নারীদের যৌন হয়রানি নিয়ে এরই মধ্যে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে সেখানকার সরকার৷ তাই ট্রেনে নারী ও পুরুষের আলাদা বসার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে৷ অফিস টাইমে ও অফিস ছুটির সময় মিনিবাসে পকেট কাটা খুবই সাধারণ ঘটনা৷
ছবি: Ulet Ifansasti/Getty Images
কুয়ালালামপুর, মালয়েশিয়া
গণপরিবহনে নারীদের নিরাপত্তার বিষয়ে দুইটি বিষয়ের দিকে নজর রাখা হয়েছে জরিপে৷ প্রথমত ঐ শহরে রাতের বেলায় গণপরিবহনে নারীরা নিরাপদ কিনা এবং দ্বিতীয়ত গণপরিবহনে নারীরা যৌন হয়রানির শিকার হন কিনা৷ মালয়েশিয়ার ক্ষেত্রেও দেখা গেছে গণ যোগাযোগ ব্যবস্থা নারীদের জন্য নিরাপদ নয়৷
ছবি: Manan Vatsyayana/AFP/Getty Images
ব্যাংকক, থাইল্যান্ড
দক্ষিণ এশিয়ায় পর্যটকদের কাছে অন্যতম পছন্দের স্থান ব্যাংকক৷ কিন্তু সেখানেও গণপরিবহন নারীদের চলাচলের জন্য তেমন নিরাপদ নয়৷ বাস বা ট্রেনে পকেট কাটা ও যৌন হয়রানি এখানে হরহামেশাই হয়ে থাকে৷
ছবি: Christophe Archambault/AFP/Getty Images
7 ছবি1 | 7
গত বছর ৫০ বছর বয়সি এক নারী এবং তাঁর মেয়েকে ডাইনি নাম দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়৷ এক এনজিও-র হিসেব মতো, ২০১০ সালে এইভাবে ডাইনি নাম দাগিয়ে দিয়ে মেরে ফেলা হয় আড়াই'শ-র মতো নারীকে৷ অতি সম্প্রতি বেশ কিছু এই ধরণের ঘটনা ঘটেছে ছত্তিশগড়, ঝাড়খন্ড, বিহার ও পশ্চিমবাংলার জলপাইগুড়ি চা-বাগান এলাকায়৷
আগেই বলেছি হয় ব্যক্তিগত না হয় পারিবারিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করা৷ তবে এই ধরণের ঘটনা বেশির ভাগ হয় প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে কিংবা জনজাতি প্রধান এলাকাগুলিতে৷ কারণ ঐ সব এলাকার সামাজিক পরিবেশ, রীতি-নীতি, জীবনধারণ, দারিদ্র্য, জাতপাতপ্রথা ভিন্ন ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন৷ যেমন কারো বাড়িতে অজানা কোনো রোগে কোনো বাচ্চা মারা গেল বা কারো জমিতে ফসল হলো না বা কারোর পাতকুয়োর জল শুকিয়ে গেল তো বিহিতের কোনো উপায় না পেয়ে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করতে কোনো নারীর ওপর ডাইনি নাম দাগিয়ে দাও৷ তাহলে তাঁকে গ্রামছাড়া করতে সুবিধা হয়, না হয় ঢিলিয়ে কিংবা নৃশংস অত্যাচার করে মেরে ফেলো৷ সব সময় যে এটা কুসংস্কার থেকে হয়, তা নয়৷ এটা লিঙ্গ-ভিত্তিকও বটে৷ নাহলে বেছে বেছে নারীকেই কেন করা হয়৷ পুরুষদের কেন করা হয় না৷ বিধানটা যেহেতু পুরুষদেরই একচ্ছত্র অধিকার! আসলে বেশিরভাগ পুরুষদের অবচেতন মনে লুকিয়ে থাকে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার স্পৃহা৷
ছোট পোশাক পরাই কি ধর্ষণের কারণ?
ভারতে প্রতিদিন অন্তত ৯২ জন নারী ধর্ষণের শিকার হন৷ যখনই এ ধরনের কোন মামলা আদালতে উঠেছে তখন প্রথম যে প্রশ্নটি সামনে এসেছে তা হলো, ধর্ষণের শিকার ঐ নারী কি ধরনের পোশাক পরেছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
যুগের সাথে পোশাক
যুগে যুগে পোশাকের ধরনে পরিবর্তন এসেছে৷ আদিমকালে ছিল পশুর চামড়া, গাছের ছাল আর এখন রয়েছে নানা ধরনের পোশাক৷ বর্তমানে দেশ, সংস্কৃতি, সমাজ ব্যবস্থা, কাজের ধরন, অনুষ্ঠান, পছন্দ ও ফ্যাশানের ভিত্তিতে বহু ধরনের পোশাক পরে থাকেন নারীরা৷
ছবি: AP
শরীর প্রদর্শন মানেই কি ধর্ষককে আমন্ত্রণ?
ভারতে বেশিরভাগ ধর্ষণ মামলায় দেখা গেছে, ধর্ষিতা সালোয়ার কামিজ বা শাড়ি পরেছিলেন৷ অর্থাৎ যাকে বলা হয় ভারতীয় নারীর আদর্শ পোশাক, সে ধরনের পোশাকই তাঁরা পরেছিলেন৷ অর্থাৎ এ জরিপ থেকেই প্রমাণিত হচ্ছে যে, শরীর প্রদর্শন না করে বা তথাকথিত ‘আধুনিক’ পোশাক না পরেও শ্লীলতাহানির শিকার হচ্ছেন নারীরা৷
ছবি: Reuters
আইনের ভয় নেই
২০১৩ সালে এক জরিপে দেখা গেছে যে, এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোতে প্রতি চারজনের মধ্যে একজন পুরুষ জীবনে অন্তত একবার কোনো নারীকে ধর্ষণ করেছে৷ এর মধ্যে বেশিরভাগ পুরুষকেই কোনো আইনি ঝামেলা পোহাতে হয়নি৷
ছবি: Fotolia/DW
ধর্ষণ যখন বিনোদনের মাধ্যম
ভারতের উত্তর প্রদেশে ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলেছে৷ এর কারণ হিসেবে পুলিশ নারীদের উপর পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব, মেয়েদের মোবাইল ব্যবহার ও ছোট পোশাক পরিধানকে উল্লেখ করেছে৷ নারীদের নিরাপত্তা দিতে পুরোপুরি ব্যর্থ পুলিশ বলেছে, সেখানকার পুরুষরা তাদের বিনোদনের অভাব পূরণ করছে ধর্ষণের মাধ্যমে৷
ছবি: dapd
নারীদের দাবিয়ে রাখার হাতিয়ার
রাস্তা, অফিস বা যে কোনো পাবলিক প্লেসে পুরুষের যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন নারীরা৷ বিশেষ করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ হওয়ায় নারীদের দাবিয়ে রাখতে পুরুষরা ধর্ষণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে৷
ছবি: UNI
পরিচিতদের দ্বারাই বেশি ধর্ষণ
২০১৩ সালে ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরোর রিপোর্ট বলছে, সে বছর ১০০ জন ধর্ষণের শিকার নারীর মধ্যে ৯৮ জন এমন ব্যক্তিদের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছেন, যারা তাঁদের পরিচিত৷ আদালতে যেসব মামলা ওঠে, বা গণমাধ্যমে যেসব ঘটনা প্রকাশ পায় সেগুলো বেশিরভাগই বাইরের লোকের হাতে৷ ফলে পরিচিত ব্যক্তি দ্বারা ধর্ষণের ব্যাপারটি ধামাচাপা পড়ে যায়৷
ছবি: Reuters/Ahmad Masood
যৌন নিগ্রহ সর্বত্র
ভারতে জন্মের আগে ভ্রুণের লিঙ্গ নির্ধারণ বেআইনি হলেও, খুব সাধারণ ঘটনা৷ ফলে পৃথিবীর আলো দেখতে পাওয়া মেয়েদের সংখ্যা এত কম যে, সমাজে নারী-পুরুষের অনুপাতে হেরফের হয়৷ এছাড়া বাল্যবিবাহ, কম বয়সে মা হওয়া, সন্তান জন্ম দিতে গিয়েও মৃত্যুবরণ করছেন নারীরা৷ পরিবারের ভেতরেও চলে যৌন নির্যাতন এবং ধর্ষণ৷ এরপরও কি আপনারা ধর্ষণের জন্য পোশাককে দায়ী করবেন?
ছবি: picture-alliance/dpa
7 ছবি1 | 7
কোনো নারীকে কিভাবে ডাইনি নাম দেয়া হয়? পদ্ধতিটা অদ্ভুত৷ পরিবারে বা গ্রামে অজানা কারণে কোনো অঘটন বা অস্বাভাবিক কিছু ঘটলে প্রথমে ডাকা হয় ওঝা বা গুণিন নামে গ্রামের বৈদ্যকে৷ ওঝা প্রথমে কিছু শিকড় বাকড় দিয়ে ঝাড়ফুঁক করেন৷ জাদুটোনা করেন৷ তারপর একটি গাছের পাতায় কয়েকজন সন্দেহভাজন নারীর নাম লেখেন৷ যাঁর নাম আগে মুছে যাবে সেই নাকি ডাইনি৷ আরো একটা প্রক্রিয়া আছে৷ সেটা হলো কয়েকটি ছোট ছোট পুঁটলিতে চাল বেঁধে পিঁপড়ের গর্তে রাখা হয়, কয়েকজন নারীর নাম লিখে৷ পিঁপড়েরা প্রথমে যে পুঁটলির চাল খাবে, তার মধ্যে থাকা যাঁর নাম, সেই নারীকেই দাগিয়ে দেয়া হয় ডাইনি বলে৷ তৃতীয় পদ্ধতিটা আরও অদ্ভুত৷ এটা এক ধরণের নিছক ধোঁকাবাজি৷ সন্দেহভাজন নারীকে বিষাক্ত গাছ গাছড়া দিয়ে বানানো ওষুধ জোর করে খাইয়ে অসুস্থ ও তন্দ্রাচ্ছন্ন করে তাঁর মুখ দিয়ে নানা অবাস্তব, অসংলগ্ন সব কথা বলিয়ে নেয়া হয়৷ সম্প্রতি এক নারীকে নগ্ন করে রাস্তা দিয়ে হাঁটানো হয়, পরে গণধর্ষণ করা হয় তাঁর৷ এ সব ঘটনা রোধে স্থানীয় কিছু আইন থাকলেও, জাতীয়স্তরে কোনো আইন আছে বলে আমার জানা নেই৷ তবে সমাজবিজ্ঞানীদের মতো আমিও বিশ্বাস করি যে, অসুখটা সমাজের গভীরে৷ অশিক্ষাজনিত কুসংস্কার তার একটা লক্ষণ৷