২৫শে নভেম্বর হলো জাতিসংঘের নির্বাচিত আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন বর্জন দিবস৷ মহাসচিব বান কি-মুন এ দিন বিশ্বের সব মানুষের প্রতি এই অভিযানে যোগদানের আহ্বান জানিয়েছেন৷ এ নিয়েই গ্রেহেম লুকাসের সংবাদভাষ্য৷
বিজ্ঞাপন
সোশ্যাল মিডিয়ায় আজ বহুদিন ধরে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলেছে৷ এই প্ল্যাটফর্মগুলির কল্যাণে আমরা নানা ধরনের নারী নির্যাতনের ঘটনার সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগ পাই৷ তবে সে সব ঘটনা সম্পর্কে অবহিত হওয়া এক কথা – আর সে'বিষয়ে কিছু একটা করা আরেক কথা৷
নারী নির্যাতন কদর্য থেকে কদর্যতর রূপ নিতে পারে৷ ভারতে ঘটছে একের পর এক ধর্ষণ, এমনকি গণধর্ষণের ঘটনা৷ ধর্ষণের সঙ্গে খুনের ঘটনারও কোনো কমতি নেই৷ আইনের কড়াকড়ি বাড়িয়েও যে সে'দেশে নারীদের প্রতি মনোভাব বদলাচ্ছে, তার কোনো লক্ষণ নেই৷ অথচ ভারত একটি উত্থানশীল দেশ, উঠতি পরাশক্তি৷ অতি সম্প্রতি ভারতের একটি গ্রামে এক মহিলাকে অর্ধোলঙ্গ অবস্থায় গাধায় চড়িয়ে ঘোরানো হয়েছে৷
অ্যাসিড সন্ত্রাস!
একটা সময় বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই আসতো নারীর ওপর অ্যাসিড নিক্ষেপের খবর৷ এমন বর্বরোচিত হামলা এখনও হয় কিছু দেশে৷ কয়েকটি দেশ ঘুরে জার্মান ফটোগ্রাফার অ্যান-ক্রিস্টিন ভোর্ল-এর তোলা ছবি নিয়ে আজকের ছবিঘর৷
ছবি: DW/M. Griebeler
বাংলাদেশের ফরিদা
ফরিদার স্বামী ছিলেন ড্রাগ এবং জুয়ায় আসক্ত৷ ঋণের দায়ে একসময় বাড়িটাও বিক্রি করে দেয় নেশাগ্রস্ত লোকটি৷ রেগেমেগে ফরিদা বলেছিলেন, এমন স্বামীর সঙ্গে আর ঘর করবেন না৷ সেই রাতেই হলো সর্বনাশ৷ ঘুমন্ত ফরিদার ওপর অ্যাসিড ঢেলে দরজা বন্ধ করে দিল পাষণ্ড স্বামী৷ যন্ত্রণায় চিৎকার করছিলেন ফরিদা৷ প্রতিবেশীরা এসে দরজা ভেঙে উদ্ধার করে তাঁকে৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
মায়ের স্নেহে, বোনের আদরে...
অ্যাসিডে ঝলসে যাওয়ার সময় ফরিদা ছিলেন ২৪ বছরের তরুণী৷ ১৭টি অস্ত্রোপচারের পর এখন কিছুটা সুস্থ৷ তবে সারা গায়ে রয়েছে দগদগে ঘায়ের চিহ্ন৷ পুড়ে যাওয়া জায়গাগুলোর ত্বক মসৃণ রাখতে প্রতিদিন মালিশ করে দেন মা৷ নিজের কোনো বাড়ি নেই বলে মায়ের সাথেই বোনের বাড়িতে থাকেন ফরিদা৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
উগান্ডার ফ্লাভিয়া
ফ্লাভিয়ার ওপর এক আগন্তুক অ্যাসিড ছুড়ে মেরেছিল ৫ বছর আগে৷ আজও ফ্লাভিয়া জানেন না, কে, কেন তাঁর ওপর হামলা চালালো৷ বিকৃত চেহারা নিয়ে অনেকদিন ঘরেই ছিলেন৷ বাইরে যেতেন না৷ এক সময় ফ্লাভিয়ার মনে হলো, ‘‘এভাবে ঘরের কোণে পড়ে থাকার মানে হয় না৷ জীবন এগিয়ে চলে৷ আমাকেও বেরোতে হবে৷’’
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
আনন্দময় নতুন জীবন
এখন প্রতি সপ্তাহে একবার সালসা নাচতে যায় ফ্লাভিয়া৷ আগের সেই রূপ নেই, তাতে কী, বন্ধুদের কাছে তো রূপের চেয়ে গুণের কদর বেশি! ফ্লাভিয়া খুব ভালো নাচ জানেন৷ তাই একবার শুরু করলে বিশ্রামের সুযোগই পান না৷ এভাবে পরিবার আর বন্ধুদের সহায়তায় আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন ফ্লাভিয়া৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
ভারতের নীহারি
নীহারির বয়স তখন ১৯৷ একরাতে আত্মহত্যা করার জন্য আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন নিজের শরীরে৷ স্বামীর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন থেকে মুক্তি পাওয়া জরুরি মনে হয়েছিল তখন৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
নতুন রূপ
যে ঘরটিতে বসে নীহারি তাঁর চুল ঠিক করছেন এটা ছিল বাবা-মায়ের শোবার ঘর৷ এখানেই নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলেন৷ দেয়াশলাইয়ের বাক্সে একটা কাঠিই ছিল৷ তা দিয়েই আগুন জ্বালিয়েছিলেন শরীরে৷ তবে এখন আর দুর্বল মনের মেয়েটি নেই নীহারি৷ নিজেকে সামলে নিয়ে একটা সংস্থা গড়েছেন৷ সংস্থাটির নাম, ‘পোড়া মেয়েদের রূপ’৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
পাকিস্তানের নুসরাত
দু-দুবার অ্যাসিড ছোড়া হয়েছে নুসরাতের ওপর৷ প্রথমে স্বামী আর তারপর দেবর৷ ভাগ্যগুণে বেঁচে আছেন নুসরাত৷ ভালোই আছেন এখন৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
আশার আলো
দু-দুবার অ্যাসিড হামলার শিকার হওয়ায় মাথার অনেকটা চুলও হারিয়েছেন নুসরাত৷ ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে মাথার ক্ষতস্থান পুরোপুরি সারিয়ে চুল এবং আগের হেয়ারস্টাইল ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
বন্ধুদের মাঝে...
নিজের ভাবনা, যন্ত্রণার অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করতে কিংবা গল্প করতে প্রায়ই অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশন (এএসএফ)-এ যান নুসরাত৷ সেখানে এমন অনেকেই আসেন যাঁদের জীবনও অ্যাসিডে ঝলসে যেতে বসেছিল৷ এখন সকলেই জানেন, তাঁরা আর একা নন৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
9 ছবি1 | 9
শুধু ভারতেই তো নয়, বিশ্বের বহু দেশে নারীরা নিয়মিতভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন৷ নাইজেরিয়ায় বোকো হারাম গোষ্ঠীর জঙ্গি ইসলামপন্থিরা একটি মেয়েদের স্কুলের শত শত ছাত্রীকে অপহরণ করে তাদের আজও ধরে রেখেছে৷ কখনো শোনা যাচ্ছে, অপহৃত মেয়েদের নাকি বোকো হারাম জঙ্গিদের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে; কখনো বোকো হারাম হুমকি দিচ্ছে, সেই মেয়েদের নাকি খোলা বাজারে ‘বেচে' দেওয়া হবে৷ সিরিয়া এবং ইরাকে ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠীর জঙ্গিরা খ্রিষ্টান মেয়েদের সঙ্গে প্রায় একই রকম আচরণ করছে৷
আফ্রিকাতে প্রায় তিন কোটি মেয়ে এফজিএম বা ফিমেল জেনিটাল মিউটিলেশনের শিকার হবার আশঙ্কায় রয়েছে; যাদের বস্তুত যৌনাঙ্গ ছেদ করা হয়েছে, এমন মহিলাদের সংখ্যা নাকি ১৩ কোটি৷ অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের বিবাহ বিশ্বের বহু দেশে একটা প্রচলিত প্রথা, যার ফলে তাদের শিক্ষাদীক্ষা, কাজের সুযোগ, সবই অকালে সন্তানের মা হয়ে বিসর্জন দিতে হয়৷ অপরদিকে যে সব পুরুষ সন্তানেরা মায়ের এই দৈন্যদশা দেখছে, তারাই বা মহিলাদের সম্মান করতে শিখবে কোথা থেকে?
মহিলাদের অসম্মান, নারী নির্যাতন, এ সব তো আর প্রাচ্য কি প্রতীচ্য, উত্তর কি দক্ষিণ গোলার্ধের ব্যাপার নয়৷ নারী নির্যাতন বস্তুত সারা বিশ্বেই ঘটে চলেছে৷ মাত্র কয়েকদিন আগে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইপ এর্দোয়ান বলেছেন যে, মহিলাদের সমানাধিকার নাকি একটা প্রকৃতি-বিরুদ্ধ ব্যাপার! মহিলাদের স্থান নাকি হেঁসেলে! ওদিকে সৌদি আরবে মহিলাদের গাড়ি চালাতে দেওয়া হয় না৷ তবে যে পরিসংখ্যানটি শুনলে মনে হবে, এ সব চুলচেরা বিচার মাথায় থাক, সে'টি হল: বিশ্বের মহিলা ও কিশোরীদের ৩৫ শতাংশ নাকি তাঁদের জীবনে কখনো না কখনো কোনো ধরনের শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার হবেন৷ কোনো কোনো দেশে নাকি সেই অনুপাত ৭০ শতাংশেও পৌঁছায়, বলছে জাতিসংঘ৷
নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের অভিযান সাধারণ নারী-পুরুষদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে এই সংগ্রামকে তাদের গ্রাম কিংবা সম্প্রদায় পর্যায়ে টেনে নিয়ে গিয়ে বিষয়টি সম্পর্কে নতুন সচেতনতা সৃষ্টি করার৷ সেক্ষেত্রে দু'টি তথ্য মনে রাখা দরকার: প্রথমত, যে সব সমাজে নারী-পুরুষের সমানাধিকার আছে, সে সব সমাজ সুখি৷ দ্বিতীয়ত, পুরুষরা নারীবাদী না হলে সেই পরিবর্তন আসা সম্ভব নয়৷