তৈরি পোশাক খাতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করা নারীদের নেতৃত্বের জায়গায় তুলে আনতে সংকল্পের কথা জানিয়েছেন তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ-র প্রথম নারী সভাপতি রুবানা হক৷
ছবি: bdnews24.com
বিজ্ঞাপন
সম্প্রতি বিজিএমইএ-র নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন মোহাম্মদী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুবানা৷ ২০ এপ্রিলের মধ্যে বিজিএমইএ-র পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠিত হবে৷
৫৫ বছর বয়সি এই নারী এমন এক সময়ে সংগঠনের নেতৃত্বে এলেন, যখন বাংলাদেশ পৃথিবীতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ৷ এই খাতে কাজ করছেন ৪০ লাখ শ্রমিক৷ আর এইচঅ্যান্ডএম ও প্রাইমার্কের মতো প্রতিষ্ঠানের পোশাক তৈরি করছে রুবানার প্রতিষ্ঠান৷
মঙ্গলবার বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে এক সাক্ষাৎকারে রুবানা হক বলেন, ‘‘আমি বিশ্বাস করি, যে শিল্পের ৮০ ভাগের অধিক শ্রমিক নারী, নিজেদের স্বার্থ তুলে ধরতে তাঁদেরকে বড় রকমের সুযোগ দেওয়া উচিত৷ অধিকাংশ শ্রমিক নারী হলেও বর্তমানে ব্যবস্থাপক পর্যায়ের বেশিরভাই পুরুষ৷ এই অবস্থার পরিবর্তন আনতে হবে৷''
'ফাস্ট ফ্যাশন': প্রদীপের নীচেই অন্ধকার
ফ্যাশনের নেশা আর জাদু চিরকালে, তা সত্ত্বেও জামাকাপড় আজ ফেলে দেওয়ার জিনিস হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ ড্রেসডেন শহরের স্বাস্থ্যবিজ্ঞান সংগ্রহশালায় আয়োজিত একটি প্রদর্শনীতে গার্মেন্টস শিল্পের অন্ধকার দিকটাও দেখানো হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M.Christians
বিশেষ মূল্য ছাড়ের মূল্য
সব ধরনের পছন্দ আর সবরকম দামের জামাকাপড় সরবরাহ করার জন্য ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি এমন সব দেশে গার্মেন্টস তৈরি করাচ্ছে, যেখানে পরিবেশ সুরক্ষার মান ও পারিশ্রমিক, দুই-ই নীচের দিকে৷ ড্রেসডেনের ‘ফাস্ট ফ্যাশন’ প্রদর্শনীতে ফ্যাশন নামের বিগ বিজনেসের যবনিকার আড়ালে উঁকি মারা হয়েছে৷ প্রদর্শনীটি চলবে ২০১৬ সালের ৩রা জুন অবধি৷
ছবি: anna.k.o.
গ্ল্যামারের অপর পীঠ
শুরু থেকে ‘শ্রেডিং’ বিশেষ দূর নয়৷ পশ্চিমের মানুষ নিত্যনতুন পণ্য চায় ও কেনে – প্রয়োজনের অনেক বেশি৷ ড্রেসডেনের প্রদর্শনীতে দেখতে পাওয়া যাবে এর অর্থনৈতিক, নৈতিক ও পরিবেশগত ফলশ্রুতি৷ পশ্চিমি জীবনধারার ফলে বাংলাদেশের মানুষ কতটা প্রভাবিত হচ্ছেন?
ছবি: Tim Mitchel/lHygienemuseum Dresden
রিসাইক্লিং, নাকি সস্তায় আবর্জনা সরানো?
ইউরোপে বিভিন্ন দাতব্য সংস্থা যে সব পুরনো জামাকাপড় সংগ্রহ করেন, তার ৬০ শতাংশ উন্নয়নশীল দেশগুলিতে পাঠানো হয়৷ ধরন, রং ও ফ্যাশন অনুযায়ী বড় বড় গাঁট বেঁধে, জাহাজে করে সারা পৃথিবীতে রপ্তানি করা হয়৷ ভারতের পানিপথে পুরনো গরম জামাকাপড় আবার রং অনুযায়ী ভাগ করা হয় – তার ফলে নাকি তার দাম বাড়ে৷
ছবি: Tim Mitchel/lHygienemuseum Dresden
বাঁচাও যায় না, মরাও যায় না
ফাস্ট ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে যেভাবে প্রোডাকশন চলে, তা ইউরোপেও এককালে ছিল৷ ধীরে ধীরে তা পুবদিকে ‘রপ্তানি’ করা হয়েছে: প্রথমে পূর্ব ইউরোপে, তারপর এশিয়ায়৷ মাইনেপত্র এক হিসেবে দারিদ্র্যসীমার নীচে৷ বাংলাদেশে একজন গার্মেন্টস কর্মীর পরিবারের ১১ জন মানুষ একটি ঘরে বাস করছেন, এমনও দেখা যায়৷
ছবি: Taslima Akhter/Hygienemuseum Dresden
হাজার স্বপ্নের সমাধি
রিনার মা কাঁটাতারের বেড়ার সামনে বসে তাঁর মেয়ের ফেরার অপেক্ষা করছেন – অনর্থক৷ বেড়ার পেছনে সাভারের সেই গার্মেন্টস ফ্যাক্ট্রি, রানা প্লাজা, যা ২০১৩ সালের ২৪শে এপ্রিল ধসে পড়ে ১,১৩৪ জন মানুষের জীবন নেয়৷ ছবিটি তোলেন তসলিমা আখতার৷
ছবি: Taslima Akhter/Hygienemuseum Dresden
সোয়েটশার্টেই তার প্রমাণ
সস্তায় উৎপাদন আর কাজের পরিবেশের মধ্যে সংযোগসূত্র শুধু ছবি আর ডায়াগ্রামের মাধ্যমেই নয়, গার্মেন্টসের মধ্যে দিয়েও ফুটিয়ে তোলা যায়৷ জার্মান শিল্পী মানু ভাসহাউস চীনে এমন সব সোয়েটশার্ট তৈরি করিয়েছেন, যার উপর রানা প্লাজা বিপর্যয়ের ছবি ছাপানো রয়েছে৷
ছবি: Manu Washaus/Hygienemuseum Dresden
স্লো ফ্যাশন
ফ্যাশন কথাটার সঙ্গে ‘ফেয়ার’ – মানে ন্যায্য – কথাটাও যে যোগ করা যায়, তার প্রমাণ এই ধরনের ফ্যাশন৷ এই সব ডিজাইনাররা শ্রমিকদের শোষণ, পরিবেশের পক্ষে হানিকর অথবা জন্তুজানোয়ারের পক্ষে কষ্টদায়ক, এমন কোনো পন্থায় ফ্যাশন সৃষ্টি করতে চান না৷
ছবি: Daniel Bark/Deutsches Hygiene-Museum
এথিক্যাল ফ্যাশন শো
এ বছর বার্লিন ফ্যাশন উইকে টেকসই ফ্যাশন চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল৷ ড্রেসডেনের প্রদর্শনীতে তা-ও দেখানো হয়েছে৷ পশ্চিমে এখন ‘সবুজ’ ফ্যাশন আর ‘ফেয়ার ট্রেড’-এর প্রবণতা বেড়েছে৷
ছবি: Getty Images/Thomas Lohnes
কিন্তু ‘পেপে’?
পাওলো উডস-এর তোলা এই ছবিটি যে ব্যঙ্গাত্মক, তা কাউকে বলে দিতে হবে না৷ ‘আমাকে চুম্বন করো, আমি ব্লন্দিনী’, লেখা রয়েছে টি-শার্টটিতে৷ অথচ যে মেয়েটি এই সেকেন্ড হ্যান্ড টি-শার্ট পরে রয়েছে, সে হাইতির, ইউরোপ বা অ্যামেরিকার নয়৷ দাতব্য হয়ে এই ধরনের সব টি-শার্ট হাইতিতে আসে৷ সেখানে তাদের বলা হয় ‘পেপে’৷
আবার এমন এক সময়ে রুবানা বিজিএমইএ সভাপতি হলেন, যখন ইউরোপীয় ইউনিয়নে দেওয়া কারখানা পরিদর্শন প্রক্রিয়া থাকবে কি, থাকবে না- সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অপেক্ষায় আছে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট৷ ২০১৩ সালে সাভারের রানা প্লাজা ধসে ১১০০ জন নিহত হওয়ার পর ‘বাংলাদেশ অ্যাকর্ড' নামে এ পরিদর্শন প্রক্রিয়া চালু হয়েছিল৷
এমতাবস্থায় পোশাক প্রস্তুতকারকদের পক্ষ থেকে কারখানা পরিদর্শন ও পরীক্ষা নিরীক্ষার উপর জোর দিচ্ছেন রুবানা৷ বিজিএমইএ-র সভাপতি পদের দায়িত্বে আসাকে গত দুই দশক ধরে তৈরি পোশাক খাতে নিজের কাজের ধারাবাহিকতা হিসাবেই বর্ণনা করছেন তিনি৷
রুবানা বাংলাদেশের পোশাক কারখানার নির্বাহী পদে হাতেগোনা কয়েকজন নারীর একজন৷ ‘‘নারীকে অবহেলার চোখে দেখার একটা প্রবণতা আছে, এটাকে পরিবর্তন করতে হবে'', রয়টার্সকে বলেন তিনি৷ ‘‘কিন্তু আমি নারী হিসাবেই এখানে আছি, এবং আমি বিশ্বাস করি- নারীদের চ্যালেঞ্জগুলোকে ভিন্নভাবে দেখা ও তাঁদের প্রতি সমানুভূতিশীল হতে পারব৷''
কবিতার জন্য সার্ক সাহিত্য পুরস্কার পাওয়া রুবানা কলামও লেখেন৷ তাঁর প্রয়াত স্বামী আনিসুল হক পোশাক খাতের ব্যবসায়ী এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র ছিলেন৷
অধিকাংশ শ্রমিক নারী হলেও বর্তমানে ব্যবস্থাপক পর্যায়ের বেশিরভাই পুরুষছবি: Reuters/A. Biraj
রুবানা বলছেন, শিক্ষিত করে নারী শ্রমিকদের ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করার পাশাপাশি তাঁদেরকে মধ্যম সারির ব্যবস্থাপক পদে আনার কথা ভাবছেন তিনি৷ ‘‘জেন্ডারভিত্তিক নেতৃত্বের কর্মসূচি হাতে নিতে চাই আমি, যার মাধ্যমে নারীরা ক্ষমতায়িত হবেন৷''
গার্মেন্টসে শ্রমিক নির্যাতনের অভিযোগকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা, বাজে চর্চা' হিসাবে উড়িয়ে দেন তিনি৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘বাস্তবে আমাদের ৮০ ভাগ নারী স্বাধীনভাবে কাজ করছে এবং অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছে- এটাই বড় কথা৷''
এদিকে, রুবানা হক একটি শীর্ষ পদে আসলেও নারী শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কতটা কাজ করতে পারবেন সে বিষয়ে সন্দিহান শ্রমিক অধিকার সংগঠকরা৷ তাঁদের ধারণা, শ্রমিকদের চাইতে মালিকদের স্বার্থই দেখবেন তিনি৷ ‘‘তিনি (রুবানা) নির্বাচিত হয়েছেন এটা ভালো ব্যাপার৷ তবে পুরুষ নিয়ন্ত্রিত একটি সংগঠনে তিনি কতটা প্রভাব রাখতে পারবেন, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই'', রয়টার্সকে বলেন আওয়াজ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা নাজমা আক্তার৷
শ্রমিক অধিকার নিয়ে কাজ করা সাবেক এ শিশু শ্রমিক বলেন, ‘‘আমি আশা করি, তিনি শ্রমিকদের জীবনযাত্রা, স্বাস্থ্য, মাতৃত্বকালীন সুবিধা এবং কারখানায় সংঘাতের বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করবেন৷''