রুমেনিয়ার মেয়ে মিহায়েলা নোরোক ছবি তুলে বেড়ান সারা পৃথিবীর মহিলাদের৷ যেন তিনি খুঁজছেন কোনো চিরন্তন নারীমুখ৷ মিহায়েলা তাঁর ‘সৌন্দর্যের মানচিত্রে' সারা বিশ্বের মহিলাদের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতে চান৷
বিজ্ঞাপন
নারীর সৌন্দর্য যখন ক্যামেরায়
04:22
মিহায়েলা নোরোক প্রতিদিন বেরোন তাঁর কাজে, বড় রাস্তায়, খোলামেলা পাবলিক চত্বরে৷ তাঁর কাজ হলো মহিলাদের ছবি তোলা৷ ২০১৩ সাল যাবৎ তিনি ৫০টির বেশি দেশ সফর করেছেন এই কাজে৷ তাঁর লক্ষ্য হলো, তিনি সত্যিকারের সৌন্দর্যকে ক্যামেরার লেন্সে ধরে রাখবেন৷ এমন সব মহিলা যাদের তিনি মিয়ানমারে দেখেছেন, অথবা রুমেনিয়ার বুখারেস্টে, ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায়, ফিনল্যান্ডে, ইকুয়েডরে....মিহায়েলা বলেন, ‘‘মেয়েদের মুখ একটা রহস্য৷ আমি আজও জানি না, রাস্তাঘাটে আমি তাদের মুখে কী দেখি, যা আমাকে মুগ্ধ করে৷ যদি কেউ আমার চোখে পড়ে, আমি তার ভেতরে কিছু একটা অনুভব করি, কোনো ধরনের রসায়ন কিংবা শক্তি, যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়৷ তখন আমি সেই মেয়েটির ছবি তোলার চেষ্টা করি৷''
২৭ বছর বয়সে রুমেনিয়ার মেয়ে মিহায়েলা বুখারেস্টের একটি টিভি প্রোডাকশন কোম্পানিতে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে, যা কিছু সঞ্চয় ছিল, তা সঙ্গে নিয়ে বেরোন তাঁর একটি আইডিয়াকে বাস্তবে পরিণত করতে৷ ‘দ্য অ্যাটলাস অফ বিউটি' বা সৌন্দর্যের মানচিত্র, এই হলো তাঁর প্রকল্প৷ এ-কাজে শত শত মহিলাদের ছবি তুলেছেন তিনি৷ কেপটাউনের বস্তিতে এক মাংস-বিক্রেতা মহিলার ছবি; এক ভারতীয় মহিলার ছবি, যার বয়স একশ' ছুঁই ছুঁই করছে; এক জার্মান মহিলার ছবি, যিনি দু-দু'বার ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করে জিতেছেন...৷
যে আট ছবি জয় করেছে সেরার পুরস্কার
২০১৫ সালে গোটা বিশ্বে অন্যতম আলোচনার বিষয় ছিল শরণার্থী সংকট৷ এই সংকট সম্পর্কিত এক ছবি চলতি বছর ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো অব দ্যা ইয়ার’ নির্বাচিত হয়েছে৷ চলুন দেখা যাক, পুরস্কারজয়ী আরো কয়েকটি ছবি৷
ছবি: Rohan Kelly/Daily Telegraph
ওয়ারেন রিচার্ডসন, অস্ট্রেলিয়া
সার্বিয়া-হাঙ্গেরি সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়ার নীচ দিয়ে একটি শিশুকে আরেকজনের হাতে তুলে দিচ্ছেন এক পুরুষ৷ এই ছবি চলতি বছর ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো অ্যাওয়ার্ড’ জয় করেছে৷ সাদা-কালো ছবিটিতে শরণার্থী সংকটের করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে৷
ছবি: Warren Richardson
মোরিসিও লিমা, ব্রাজিল
লিমা গত বছর আগস্টে সিরিয়ায় এই ছবিটি তোলেন৷ ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো প্রতিযোগিতার সাধারণ সংবাদ বিভাগে এই ছবিটি প্রথম পুরস্কার জয় করেছে৷ ছবিতে ‘ইসলামিক স্টেটের’ ১৬ বছর বয়সি এক যোদ্ধার পুড়ে যাওয়া শরীরে চিকিৎসককে মলম লাগাতে দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Mauricio Lima/The New York Times
ঝাং লি, চীন
চীনের উত্তরাঞ্চলে কুয়াশায় ঢেকে যাওয়া তিয়ানজিন শহরের এই ছবিটি তোলা হয় গতবছরের ডিসেম্বর মাসে৷ সমসাময়িক বিষয় বিভাগে প্রথম পুরস্কার জয় করেছে ছবিটি৷
ছবি: Zhang Lei/Tianjin Daily
কেভিন ফ্রেয়ার, কানাডা
চীনের সানক্সিতে কয়লানির্ভর একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পাশের রাস্তায় ত্রিচক্রযান টানছেন এক চীনা নাগরিক৷ ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটোর নিত্যদিনের জীবন বিভাগে প্রথম পুরস্কার জয় করেছে ছবিটি৷
ছবি: Kevin Frayer/Getty Images
মেরি এফ. কালভার্ট, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প বিভাগে প্রথম পুরস্কার জয় করেছে ২০১৪ সালের মার্চে তোলা এই ছবিটি৷ ছবিতে ২১ বছর বয়সি নাতাশা শ্যুটেকে দেখা যাচ্ছে, যিনি এক সহকর্মীর হাতে শারীরিকভাবে লাঞ্ছনার শিকার হওয়ার পর অভিযোগ করায় মার্কিন সামরিক বাহিনীর পুরস্কার জয় করেন৷ সাহসিকতার জন্য তাঁকে এই খেতাব দেয়া হয়েছিল৷
ছবি: Mary F. Calvert
রোহান কেলি, অস্ট্রেলিয়া
আতঙ্কিত হওয়ারও সময় নেই! সিডনির বন্ডি সমুদ্রতটের কাছে যখন একটি মেঘ সুনামি সৃষ্টি হচ্ছিল, তখনও বই পড়ছিলেন সূর্যস্নানরত এক নারী৷ গত বছর নভেম্বরে তোলা ছবিটি প্রকৃতি বিভাগে সেরা পুরস্কার জয় করে৷
ছবি: Rohan Kelly/Daily Telegraph
মাটিচ জর্মান, স্লোভেনিয়া
মানুষ বিভাগে এই ছবিটি প্রথম পুরস্কার জয় করে৷ সার্বিয়ার কাছে একটি শরণার্থী কেন্দ্রে নিবন্ধনের আশায় রেইনকোট পড়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক শিশুকে দেখা যাচ্ছে ছবিতে৷
ছবি: Matic Zorman
ক্রিস্টিয়ান ভালগ্রাম, অস্ট্রিয়া
ভালগ্রাম গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত এফআইএস ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ চলাকালে ছবিটি তোলেন৷ ক্রীড়া বিভাগে সেরা পুরস্কার জয় করেছে এটি৷
ছবি: Christian Walgram/GEPA pictures
8 ছবি1 | 8
মিহায়েলা নোরোক তাঁর ফটোগ্রাফিতে মহিলাদের প্রশান্তি, আনন্দ আর শক্তিকে ধরে রাখতে চেয়েছেন৷ মিহায়েলা বলেন, ‘‘মিডিয়া ঘাঁটলে দেখবেন যুদ্ধের মানচিত্র, সমস্যার মানচিত্র৷ আমি যেটা দেখানোর চেষ্টা করছি, সেটা হলো এই যে, তা দিয়ে পরিস্থিতি বদলানো যাবে না৷ আমাদের মেনে নিতে হবে যে, সব সত্ত্বেও জীবন সুন্দর৷''
‘অ্যাটলাস অফ বিউটি'
মিহায়েলা নোরোক তাঁর ছবি আর কাহিনিগুলি অনলাইনে দেন৷ ফেসবুকে তাঁর প্রকল্পের ফ্যান আজ ন'লাখের কাছাকাছি৷ টামব্লর-এ তাঁর ব্লগ আজ এই প্ল্যাটফর্মে যে সব ব্লগ সবচেয়ে বেশি শেয়ার করা হয়, তাদের মধ্যে পড়ে৷ ৩০ বছর বয়সি মিহায়েলা তাঁর প্রকল্পের কাজ চালান প্রধানত ক্রাউডফান্ডিং-এর মাধ্যমে৷ মিহায়েলা জানালেন, ‘‘আমি এমন সব মানুষের খোঁজ করছি, যারা আমাদের আশা দেবার ক্ষমতা রাখে, অন্যদের প্রেরণা দেবার ক্ষমতা রাখে৷ যারা তাদের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যকে দেখাতে পারে, যা আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ মহিলাদের মধ্যে যে শক্তি আছে, সেটাই আমি তুলে ধরার চেষ্টা করছি৷''
মিহায়েলা নোরোক উত্তর কোরিয়া সফর করেন ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে৷ অসাধারণ সফর! তিনি উত্তর কোরিয়ার মহিলাদের দৈনন্দিন জীবন দেখাতে চেয়েছিলেন৷ এমন একটি বিচ্ছিন্ন দেশ, যা শুধু তার রাজনীতির মাধ্যমে সারা বিশ্বে আগ্রহের সঞ্চার করে৷ মিহায়েলা এখানে বিশজনের বেশি মহিলার ছবি তোলেন, যা তাঁর প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি৷ মিহায়েলার ভাষ্যে, ‘‘উত্তর কোরিয়া সফর করার সময় সবসময় আমার সঙ্গে একজন গাইড থাকত, কাজেই অভিজ্ঞতা কিছুটা ফিলটার্ড ছিল বলতে হয়৷ তবুও আমি আশ্চর্য হই যে, আমি মহিলাদের সঙ্গে কথা বলতে পেরেছি, তাদের রাস্তায় থামিয়ে আমার প্রকল্পের জন্য তাদের ছবি তুলতে পেরেছি, যা আমার খুবই ইন্টারেস্টিং লেগেছে৷''
শিশুর ক্যামেরায় নিজের জগত
দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউনের কাইয়েলিচা এলাকার শিশুরা তাদের কাছে যা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় সেসবের ছবি তোলে৷ ক্যামেরা হাতে আশেপাশের ছবি তুলে বেড়ায় ওরা৷ কাইয়েলিচায় প্রায় ১২ লাখ মানুষের বাস, তাঁদের প্রায় সবাই খুব গরিব৷
ছবি: Elethu/Karin Banduhn
একদিনের রিপোর্টার
‘‘জীবনে সত্যি যা ভালোবাসো তা দেখাও’’ – ঠিক এই কথাটাই বলে দেয়া হয়েছে স্থানীয় একটি স্কুলের ছয় বছর বয়সি এই শিশুদের৷ এই প্রথম ক্যামেরা হাতে নিয়েছে ওরা৷ কয়েক ঘণ্টা ক্যামেরা চালানো শেখার পর নেমে পড়েছে সেরা ছবি তোলার কাজে৷
ছবি: Karin Banduhn
‘নতুন বাড়ি’
কোসা ভাষায় কাইয়েলিচা মানে ‘নতুন বাড়ি’৷ সরকার চায় এলাকায় নতুন ঘর-বাড়ি হোক৷ কিন্তু লিখতার পরিবারের মতো অনেকেরই কাঠের বাড়ি ছেড়ে নতুন বাড়িতে ওঠার সাধ্য নেই৷
ছবি: Liktha/Karin Banduhn
ভরপুর বাড়ি
সিফোকাজির পরিবারে এক ছাদের নীচে বাস করে তিন প্রজন্ম৷ কাইয়েলিচার বেশির ভাগ পরিবারের মতো এ পরিবারেরও মূল উপার্জনকারী বাবা, পরিবারের প্রয়োজন মেটাতে অন্য বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করে মা৷ মা-বাবা যখন কাজে ব্যস্ত, তখন বাচ্চাদের দেখাশোনা করেন দাদা-দাদি৷
ছবি: Siphokazi/Karin Banduhn
অমূল্য সম্পদ
খেলনা খুব প্রিয় মাহলের৷ বেশিরভাগ খেলনাই তার স্কুলে আসে জার্মানির হামবুর্গ শহরের শুলকাম্প প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে৷ কাইয়েলিচা সংস্থা ওদের স্কুলের পাশে আছে সবসময়৷
ছবি: Mahle/Karin Banduhn
ছেলেদের খেলনা
মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের পাশাপাশি একটা গাড়ি থাকলে কার না ভালো লাগে! জায়গা নেই বলে কাইয়েলিচার বাচ্চারা বাড়িতে খুব একটা খেলতে পারে না৷ খুদে ফটোগ্রাফার ইভিভসে তাই খালি ক্যান দিয়েই বানিয়ে নিয়েছে রেস ট্র্যাক৷
ছবি: Ivivse/Karin Banduhn
ক্ষুধা নিবারণ
লুলুথো স্কুল থেকে ফেরে ভীষণ ক্ষুধা নিয়ে৷ ঘরে সবসময় খাওয়ার মতো কিছু না কিছু থাকে বলে রক্ষা৷ কাইয়েলিচার অধিকাংশ পরিবার খাবারের পেছনে প্রতিদিন খরচ করে ২২ রান্ড, অর্থাৎ ১.৭০ ইউরোর মতো৷
ছবি: Lulutho/Karin Banduhn
ঐতিহ্য আর দৈনন্দিন জীবন
স্থানীয়দের অধিকাংশই কোসা জনগোষ্ঠীর৷ নেলসন ম্যান্ডেলা আর তাঁদের ভাষা এক৷ তাঁদের কাছে ঐতিহ্য খুব গুরুত্বপূর্ণ৷ সাধারণত মেয়েরা রান্না করে আর ছেলেরা কাজ করতে যায় বাইরে৷
ছবি: Yandise/Karin Banduhn
কাইয়েলিচার শিশুরা
ফটোসাংবাদিক এলেথুর জন্য বন্ধুরা খুব গুরুত্বপূর্ণ৷ এখানে শিশুরা আত্মবিশ্বাসী এবং সুখি মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠতে পারে৷ এটা দরকারও, কেননা শিশুদের হাতেই তো দেশের ভবিষ্যৎ!
ছবি: Elethu/Karin Banduhn
8 ছবি1 | 8
মিহায়েলা নোরোক তাঁর প্রকল্পে নানা ধরনের মহিলাদের ছবি তুলেছেন৷ কিন্তু তাঁর কাছে সৌন্দর্য বলতে কী বোঝায়? মিহায়েলা বললেন, ‘‘সৌন্দর্য খুবই বিচিত্র৷ একবার তাকানো, হাত মেলানো, একটি হাসির মধ্যে সৌন্দর্য থাকে৷ আমি জানি না, হয়ত একটা শক্তি, আমাদের চারপাশে৷ শুধু মনোযোগী হতে হবে, দেখার জন্য মন খোলা রাখতে হবে, কেননা সৌন্দর্য তো সর্বত্র, হয়ত পাশ দিয়ে চলে যাবে অথচ আপনি খেয়ালই করবেন না৷''
মিহায়েলাকে তাঁর প্রকল্প আরো অনেক জায়গায় নিয়ে যাবে, সামনে পরিকল্পনা আছে সুইজারল্যান্ড, জাপান ও মেক্সিকো যাত্রার৷ তাঁর ‘অ্যাটলাস অফ বিউটি', সৌন্দর্যের মানচিত্র বই হিসেবেও ছাপা হয়ে বেরোতে চলেছে৷৷