নাৎসি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে মুসলিম নেতাদের ঐতিহাসিক সফর
২৪ জানুয়ারি ২০২০
মুসলিম ওয়ার্ল্ড লিগের মহাসচিব মোহাম্মদ বিন আবদুলকারিম আল-ইসা ও অ্যামেরিকান জিউইশ কমিটির প্রধান নির্বাহী ডেভিড হ্যারিসের নেতৃত্বে বিশ্বের মুসলিম ও ইহুদি নেতাদের একটি দল পোল্যান্ডের নাৎসি কনসেনট্রেশন ক্যাম্প সফর করেছেন৷
বিজ্ঞাপন
বৃহস্পতিবার পোল্যান্ডের আউশভিৎস কনসেনট্রেশন ক্যাম্প সফর করেন তারা৷ ১৯৪৫ সালের ২৭ জানুয়ারি সোভিয়েট বাহিনী ক্যাম্পটি মুক্ত করে৷ এর ৭৫ বছর পূ্র্তি উপলক্ষে এই সফরের আয়োজন করা হয়৷
সৌদি আরবের মক্কা থেকে আসা মুসলিম নেতা আল-ইসা সঙ্গে ২৮টি দেশ থেকে আরো ৬১ জন মুসলিম প্রতিনিধি নিয়ে এসেছেন৷ এদের ২৫ জন মুসলিম বিশ্বে বেশ সুপরিচিত নেতা৷ তাঁদের এই সফরকে ‘ঐতিহাসিক' বলে উল্লেখ করেছে অ্যামেরিকান জিউইশ কমিটি বা এজেসি৷ ইউরোপীয় ইহুদিদের নিধন চালানো এই ক্যাম্পটিতে মুসলিম ও ইহুদিরা একসঙ্গে প্রার্থনা করেন৷
ইহুদি প্রতিনিধিদের মধ্যে এজেসির সদস্যরা ছাড়াও হলোকাস্ট থেকে বেঁচে যাওয়াদের সন্তানরা ছিলেন৷
‘‘হলোকস্ট থেকে বেঁচে যাওয়াদের সন্তানরা এবং ইহুদি ও মুসলিম গোষ্ঠীর নেতাদের সঙ্গে এখানে উপস্থিত হতে পারাকে আমি পবিত্র কর্তব্য পালন এবং বিশেষ সম্মানের বলে করছি,'' বলেন আল ইসা৷ ‘‘এই স্থান যে বিবেকবর্জিত অপরাধের সাক্ষী, তা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ৷ এটি আমাদের সবার বিরুদ্ধে ঘটেছে, সৃষ্টিকর্তার সব সন্তানের বিরুদ্ধে৷''
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি অধিকৃত পোল্যান্ডে নাৎসিরা ইহুদিদের নির্যাতন ও হত্যার জন্য এই ক্যাম্পগুলো ব্যবহার করত৷ আউশভিৎস সবচেয়ে কুখ্যাত ক্যাম্পগুলোর একটি৷ আউশভিৎসের ক্যাম্পটিতে প্রায় ১১ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে৷ এদের অধিকাংশই ছিলেন ইউরোপ মহাদেশের ইহুদি৷
শুক্রবার সফরকারী দলটি ওয়ারশতে পোলিশ ইহুদিদের ইতিহাস সম্বলিত পোলিন মিউজিয়ামে যান৷
দুবছর আগে আল-ইসা ওয়াশিংটনের ইউনাইটেড স্টেটস হলোকস্ট মেমোরিয়াল মিউজিয়ামে একটি চিঠি লেখেন৷ চিঠিতে হলোকাস্টের শিকার মানুষদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেন তিনি এবং উল্লেখ করেন এই ঘটনা ‘মানবতার ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে'৷ একই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘সত্যিকার ইসলাম এমন অপরাধের বিপক্ষে' এবং ‘হলোকস্ট বা এর প্রভাব অস্বীকার করাকে আমরা ইতিহাস বিকৃতি বলে মনে করি এবং যেসব নিরপরাধ আত্মা এর শিকার হয়েছে তাদের প্রতি অপমান বলে মনে করি৷''
২০১৮ সালের মে মাসে জাদুঘরটি সফরের পর আল-ইসা দ্য ওয়াশিংটন পোস্টে একটি উপ-সম্পাদকীয় লেখেন৷ সেখানে তিনি বলেন, ‘‘আমি নিজের চোখে ভিডিও, ছবি, প্ল্যাকার্ড, সাক্ষাৎকার ও স্মারক দেখেছি, এর সবই হলোকস্টের সাক্ষ্য প্রমাণ বহন করে৷ হলোকস্টের বিশালতা বুঝতে কারো জাদুঘরে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না৷ কিন্তু জাদুঘরটিতে যারা যাননি তাদের পক্ষে এটি ঘটেনি, এমন কথা বলা অসম্ভব৷''
লেখাটিতে তিনি ‘সকল মুসলিমকে হলোকস্টের ইতিহাস জানা, স্মৃতিস্মারক এবং জাদুঘরগুলো ভ্রমণ করার' আহ্বান জানান৷
হলোকস্টের চিত্রকলা
নাৎসি বন্দিশিবিরে মৃত্যুর দিন গোণার অবসরেও ছবি এঁকে গেছেন শিল্পীরা৷ ইসরায়েলের ইয়াদ ভাশেম সংগ্রহশালা থেকে আনা কিছু ছবি এখন প্রদর্শিত হচ্ছে বার্লিনে৷
ছবি: Collection of the Yad Vashem Art Museum, Jerusalem
রঙিন ‘ঘেটো’
‘ঘেটো’ বলতে বোঝায় শহরের সেই সংকীর্ণ অংশ, ইহুদিদের যেখানে থাকতে বাধ্য করা হতো৷ পোল্যান্ডের লুড্জ শহরের ঘেটোর এই ছবিটি এঁকেছিলেন ইয়োসেফ কোভনার, যিনি হলোকস্ট থেকে প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিলেন৷ ‘হলোকস্টের চিত্রকলা: ইয়াদ ভাশেম সংগ্রহশালা থেকে ১০০টি চিত্র’, এই নাম দিয়ে বার্লিনে জার্মান ঐতিহাসিক সংগ্রহশালায় কোভনার ও অন্যান্য হলোকস্ট শিল্পীদের শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হচ্ছে৷
ছবি: Collection of the Yad Vashem Art Museum, Jerusalem
উদ্বাস্তু
প্রদর্শনীতে যে ৫০ জন শিল্পীর ছবি প্রদর্শিত হচ্ছে, তাদের মধ্যে ২৪ জন প্রাণ হারিয়েছিলেন নাৎসিদের হাতে৷ নিহতদের মধ্যে ছিলেন বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী ফেলিক্স নুসবাউম, যিনি ১৯৪৪ সালে আউশভিৎসে প্রাণ হারান৷ তাঁর ‘উদ্বাস্তু’ ছবিটি আঁকা হয় ব্রাসেলসে, ১৯৩৯ সালে৷ নুসবাউম ছবিটিতে নির্বাসনের অবর্ণনীয় যন্ত্রণা তুলে ধরতে চেয়েছিলেন৷
ছবি: Collection of the Yad Vashem Art Museum, Jerusalem
আত্মপ্রতিকৃতি
শার্লট সালোমন-এর ছবি এর আগেও জার্মানিতে প্রদর্শিত হয়েছে৷ তাঁর সাতশ’র বেশি ছবির একটি সংগ্রহে দেখা যায়, ইহুদি হিসেবে শার্লট বার্লিনে কী ধরনের জীবন কাটিয়েছিলেন৷ পরে তিনি দক্ষিণ ফ্রান্সে আশ্রয় নেন, কিন্তু ১৯৪৩ সালে তাঁকে সেখান থেকে ধরে আউশভিৎসে পাঠিয়ে দেওয়া হয় এবং বন্দিশিবিরে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে হত্যা করা হয়৷ শার্লট তখন সন্তানসম্ভবা৷
ছবি: Collection of the Yad Vashem Art Museum, Jerusalem
লুকনো মেয়েটির আঁকা ছবি
নেলি টল ও তাঁর মা ইহুদি হওয়া সত্ত্বেও পোল্যান্ডের লুভভ শহরে প্রাণে বাঁচেন কেননা তাঁদের খ্রিষ্টান বন্ধুরা তাঁদের লুকিয়ে রেখেছিলেন৷ একা ঘরে আটক নেলি জলরং দিয়ে ছবি এঁকে সময় কাটাতেন, যেমন ‘মাঠের মধ্যে মেয়েরা’ নাম দেওয়া এই ছবিটি৷ ৮১ বছর বয়সি নেলি টল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বার্লিনে এসেছেন প্রদর্শনীর উদ্বোধন উপলক্ষ্যে৷
ছবি: Collection of the Yad Vashem Art Museum, Jerusalem
‘ব্যারাকের মাঝখানে রাস্তা’
লিও ব্রয়ার বন শহরের অধিবাসী ছিলেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মান কাইজারের হয়ে যুদ্ধও করেছেন৷ হিটলার ক্ষমতায় আসার পর ১৯৩৪ সালে তিনি প্রথমে দ্য হেগ ও পরে ব্রাসেলসে বসবাস করেন, শিল্পী হিসেবেই, তাঁর ছবিও তখন প্রদর্শিত হয়েছে৷ ১৯৪০ সালের পর ফ্রান্সের একাধিক শিবিরে অন্তরীণ হয়ে থাকেন লিও৷ সেখানকার অভিজ্ঞতা তুলিবদ্ধ করে রেখেছেন বিভিন্ন ছবিতে৷ লিও ব্রয়ার পরলোকগমন করেন ১৯৭৫ সালে, ঐ বন শহরেই৷
ছবি: Collection of the Yad Vashem Art Museum, Jerusalem
দুই শিল্পী
ফরাসি বন্দিশিবিরে লিও ব্রয়ার যে আলোকচিত্রশিল্পীর সঙ্গে নানাভাবে সহযোগিতা করেছিলেন – যেমন মঞ্চসজ্জায় – তাঁর নাম ছিল কার্ল রবার্ট বোডেক৷ দু’জনে গ্রিটিংস কার্ড ইত্যাদিও সৃষ্টি করেছেন৷ বোডেক-কে ১৯৪১ সালে অপরাপর শিবিরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং শেষমেষ আউশভিৎসে পাঠানো হয়৷ সেখানেই তিনি নিহত হন ১৯৪২ সালে৷
ছবি: Collection of the Yad Vashem Art Museum, Jerusalem
শিল্পীর গুপ্তজীবন
বেড্রিশ ফ্রিটা থেরেজিয়েনস্টাট বন্দিশিবিরে সরকারি প্রচারপত্র ইত্যাদি তৈরির কার্যালয়ের প্রধান ছিলেন৷ অপরদিকে তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা গোপনে নাৎসি ঘেটোগুলির বিভীষিকাকে ছবিতে ধরে রেখেছেন৷ ১৯৪৪ সালে তা ফাঁস হয়ে যাবার পর ফ্রিটাকে আউশভিৎসে জীবন দিতে হয়৷ থেরেজিয়েনস্টাট বন্দিশিবির মুক্ত হবার পর সেখানকার দেয়াল ও মাটির তলা থেকে ফ্রিটার আঁকা ২০০টি ছবি পাওয়া যায়৷
ছবি: Collection of the Yad Vashem Art Museum, Jerusalem
মৃত্যুর পরেও বন্ধুত্ব
লিও হাস তাঁর বন্ধু ফ্রিটাকে বন্দিশিবিরের জীবন নিয়ে ছবি আঁকতে নানাভাবে সাহায্য করেছিলেন৷ সাক্সেনহাউজেন বন্দিশিবিরে লিও হাস-এর ওপর নির্দেশ হয়, মিত্রশক্তিদের পাউন্ড ও ডলার নকল করার৷ যুদ্ধের পর হাস ফ্রিটার পুত্র টোমাসকে দত্তক নেন৷ এছাড়া হাস থেরেজিয়েনস্টাট বন্দিশিবিরে বেড্রিশ ফ্রিটার আরো চারশ’টি লুকনো ছবি আবিষ্কার করেছেন৷
ছবি: Collection of the Yad Vashem Art Museum, Jerusalem
ডাক্তারের ছদ্মবেশে শিল্পী
পাভেল ফান্টল থেরেজিয়েনস্টাটের শিল্পীমহলের সদস্য ছিলেন৷ ডাক্তার হিসেবে তিনি শিবিরের মধ্যে টাইফুস রোগীদের জন্য একটি ক্লিনিক চালাতেন৷ ফ্রিটার মতো তিনিও ধরা পড়েন, তাঁর উপর শারীরিক নিপীড়ন চালানো হয়; পরে তাঁকে আউশভিৎস বন্দিশিবিরে পাঠানো হয়৷ ১৯৪৫ সালের জানুয়ারি মাসে তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়৷ তাঁর প্রায় ৮০টি ছবি থেরেজিয়েনস্টাট থেকে বার করে আনা সম্ভব হয়েছিল৷
ছবি: Collection of the Yad Vashem Art Museum, Jerusalem
কলা শিক্ষক
ইয়াকব লিপশিৎস যুদ্ধের আগে ভিলনিয়ুস-এর একটি কলা প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনা করতেন৷ ১৯৪১ সালে তিনি কাউনুস শহরের ঘেটোয় গিয়ে বাস করতে বাধ্য হন; সেখানে তিনি অপরাপর শিল্পীদের সঙ্গে গোপনে ঘেটো জীবনের ছবি আঁকতেন৷ ১৯৪৫ সালের মার্চ মাসে কাউফেরিং বন্দিশিবিরে তাঁর মৃত্যু ঘটে৷ যুদ্ধের পরে তাঁর স্ত্রী ও কন্যা কাউনুস ঘেটোয় ফিরে গিয়ে একটি কবরখানায় লুকনো ছবিগুলো উদ্ধার করেন৷ লিপশিৎস নিজেই সেগুলোকে লুকিয়ে রেখেছিলেন৷
ছবি: Collection of the Yad Vashem Art Museum, Jerusalem
চরম দুর্দশার মধ্যেও আত্মমর্যাদা
বার্লিনের জার্মান হিস্টোরিক্যাল মিউজিয়ামের এই প্রদর্শনী চলবে ৩রা এপ্রিল অবধি৷ ছবিগুলিতে একদিকে যেমন দেখতে পাওয়া যাবে নাৎসি বন্দিশিবিরের বিভীষিকা, অপরদিকে এই অমর শিল্পীরা যেন সেই বিভীষিকার মধ্যেই জীবনের জয়গান গেয়ে গেছেন৷ মরিৎস ম্যুলার-এর ‘শীতকালে বাড়ির ছাদে’ সেরকম একটি ছবি৷
ছবি: Collection of the Yad Vashem Art Museum, Jerusalem