বাংলাদেশে রোববার থেকে খুলে যাচ্ছে তৈরি পোশাকসহ রপ্তানিমুখী শিল্প কারখানা৷ সেই সিদ্ধান্তে শ্রমিকরা ঢাকায় ফিরতে গিয়ে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ ও কষ্টের শিকার হচ্ছেন৷ অনেকেরই আশঙ্কা, সময়মত কর্মস্থলে না ফিরলে তাদের চাকরি থাকবে না৷
মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া ফেরিঘাটে শনিবার ঢাকা ফেরত মানুষের স্রোত৷ছবি: Mahmud Zaman Ove/bdnews24
বিজ্ঞাপন
লকডাউনের পাঁচদিন বাকি থাকতেই কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত হলেও দূরপাল্লার সব ধরনের যানবাহন বন্ধ আছে৷ কারখানার পক্ষ থেকেও কোনো যানবাহনের ব্যবস্থা করা হয়নি৷ তাই পায়ে হেঁটে, ভ্যান ও রিক্সায় করে যে যার মতো ফিরছেন৷ ফেরিঘাট আর সড়কে ঢাকামুখী পোশাক কর্মীদের যেন মিছিল নেমেছে৷
মনারুল ইসলামের সাথে কথা হয় শনিবার দুপরের পর৷ তিনি ঢাকার মোহাম্মদপুরে একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করেন৷ বাড়ি সিরাজগঞ্জে৷ মনারুল বলেন, ‘‘সরকারের কারখানা খোলার ঘোষণার পর অফিস থেকে ফোন করা হয়, এসএমএস পাঠানো হয়৷ বলা হয় যেকোনো উপায়ে ১ আগষ্ট অফিসে হাজির থাকতে হবে৷ যদি তার অন্যথা হয় তাহলে চাকরি থাকবে না৷’’
মো. আকাশ মিয়া
This browser does not support the audio element.
মনারুলসহ তিনজন পোশাককর্মী শনিবার সকালেই সিরাজগঞ্জ থেকে রওনা হন৷ তাদের সঙ্গে একজন নারী সহকর্মীও ছিলেন৷ তারা কখনো ভ্যান, কখনো পায়ে হেঁটে আবার কখনো ব্যাটারি চালিত ইজিবাইকে করে ঢাকার গাবতলী আসেন দুপরের পর৷ তিনি বলেন, ‘‘আমাদের একজনের ঢাকায় আসতে ২৫০ টাকা খরচ হয়, কিন্তু এবার খরচ হয়েছে ৮০০ টাকা৷’’ চাকরির ভয়ে সবাই যে যেভাবে পারছেন কর্মস্থলে ফিরছেন বলে জানান তিনি৷
মো. আকাশ মিয়া কাজ করেন সাভারের হেমায়েতপুরের একটি পোশাক কারখানায়৷ তার বাড়ি রাজবাড়ি৷ তিনিও দুপরের পর তার স্ত্রী ও এক সান্তানকে নিয়ে সাভার এলাকায় আসেন৷ কীভাবে আসলেন জানতে চাইলে বলেন, ‘‘রাজবাড়ি থেকে ভ্যানে দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে রওনা দেয়ার পর মাঝখানে পুলিশ নামিয়ে দেয়৷ এরপর কখনো পায়ে হেঁটে আবার কখনো ভ্যানে ফেরি ঘাটে পৌঁছাই৷ ফেরি পার হওয়ার পর তারপর আবার পায়ে হেঁটে ও ভ্যানে করে সাভার আসি৷ কী যে কষ্ট হয়েছে বলে বুঝাতে পারব না৷’’
কেন আসলেন? লকডাউনের পরেও তো আসতে পারতেন? এমন প্রশ্নের জবাবে আকাশ বলেন, ‘‘না আসলে তো চাকরি থাকবে না৷ তখন খাবো কী,’’ জবাব আকাশের৷
এরকম ফিরে আসার কষ্টের গল্প গাবতলী ও সাভার এলাকায় অনেকের মুখেই শোনা গেছে রোববার৷ কেউ কেউ এই যাত্রায় ক্ষুধার্ত আর ক্লান্ত হয়ে রাস্তার পাশে বসে পড়েন৷
সিরাজুল ইসলাম রনি
This browser does not support the audio element.
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ একদিন আগে বলেছে, ৮০ ভাগ শ্রমিকই চলে এসেছে৷ যারা চলে এসেছে তাদের দিয়েই পোশাক কারখানা চালু করা হবে৷ যারা আসতে পারবে না তাদের চাকরি যাবে না৷ খোলা হবে ঢাকার আশপাশের কারখানা৷ বিজিএমইএ'র সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম দাবি করেন, ‘‘ঈদের ছুটিতে এবার শ্রমিকরা বাড়ি যায়নি৷ যারা গেছে তারা এরইমধ্যে চলে এসেছে৷ ২০ ভাগের মতো শ্রমিক বাড়িতে আছে৷ তাদের যে শনিবারের মধ্যে আসতে হবে তা নয়৷ লকডাউন শেষে আসলেও চলবে৷’’
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনও বলেছেন শ্রমিকরা না আসতে পারলে তাদের চাকরি যাবে না৷ কিন্তু বাস্তবে পরিস্থিতি উল্টো৷ ফিরে আসা পোশাক শ্রমিকরা বলেন, তাদের ফোন করে এবং মেসেজ দিয়ে তাদের কারখানা থেকে বলা হয়েছে শনিবারের মধ্যে আসতে হবে৷ রোববার থেকে খোলা৷ না আসতে পারলে চাকরি থাকবে না৷
জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, ‘‘বিজিএমইএ অসত্য কথা বলছে৷ ঈদের ছুটিতে শতভাগ শ্রমিক গ্রামের বাড়িতে গেছেন৷ তারা এখন খোলার খবরে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন৷ আগে কোনো শ্রমিক ঢাকা আসেননি৷ তাদের চাকরির ভয় দেখিয়ে এই লকডাউনের মধ্যেও আসতে বাধ্য করা হচেছ৷ কিন্তু তাদের জন্য কোনা ধরনের যানবাহনের ব্যবস্থা করা হয়নি৷’’
সিদ্দিকুর রহমান
This browser does not support the audio element.
তিনি আরো বলেন, ‘‘পোশাক শ্রমিকরা বিপাকে পড়ে আমাদের ফোন করছেন৷ কিন্তু আমরা তাদের জন্য কিছুই করতে পারছি না৷ তারা অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করে কর্মস্থলে ফিরছেন৷’’
বিজিএমইএ'র সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘‘শ্রমিকরা যেভাবে গিয়েছেন সেভাবেই ফিরছেন৷ তারা দুই ঈদেই এরকম করেছেন৷ এই ঈদে তাদের বাড়ি না যেতে বলা হয়েছিলো৷ কিন্তু তারা গিয়েছেন৷ এখন খোলার খবর পেয়ে ছুটে আসছেন৷ তবে কেউ আসতে না পারলে চাকরি যাবে না৷ আমরা চাইনা যে এই ভাবে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে কেউ আসুক৷’’
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘রোববার থেকে পুরো স্বাস্থ্যবিধি মেনেই পোশাক কারখানা চালু হচ্ছে৷ ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট-এর কারণে আমরা আরো বেশি সতর্ক থাকব৷’’
বাংলাদেশে সাড়ে চার হাজারের মতো পোশাক কারখানায় ৪০ লাখেরও বেশি শ্রমিক কাজ করেন৷ যাদের অধিকাংশই নারী৷ এই শ্রমিকরা এখন ছুটছেন গণপরিবহন বিহীন লকডাউনের মধ্যে৷
রূপগঞ্জ ট্রাজেডির চারতলায় হারানো মানুষেরা
ঘটনার সাত দিন পর কারখানাটির আশেপাশে বসবাস করা কয়েকজনের সাথে কথা বলে এই গ্যালারি বানিয়েছেন প্রতিবেদক।
টেকা দিয়া আমরা কি করমু স্যার
আগুনের খবর পাওয়ার পরপরই কিশোরগঞ্জ থেকে চান্দু মিয়া তার মেয়ে রাবেয়া খাতুনের খোঁজে এসে বলেন, “স্যারের এক শিশি রক্ত নিসে কি নাকি পরীক্ষা করবো লাশের লগে। শুনসি সরকার দুই লাখ কইরা টেকা দিব যারা মারা গেছে অগো রে। কিন্তু মাইয়া না থাকলে এইসব দিয়া কি করুম? টেকা দিয়া তো মাইয়া ফেরত আইব না।”
আমার মাইয়াটা অর মা রে হারাইলো
পেশায় রিকশাচালক মোঃ সেলিম মিয়া হাশেম ফুডসের কারখানায় এসেছেন ক্ষতিপূরণের অর্থপ্রাপ্তির জন্য বিস্তারিত জানতে। তিনি জানান তার স্ত্রী অমৃতা বেগম ৮ তারিখের পর থেকে নিখোঁজ। তাদের আড়াই বছরের এক মেয়ে আছে জানিয়ে কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, “আমার মাইয়া অর মা রে হারাইলো, এ ক্ষতি কেমনে পোষামু আমি?”
এক মাইয়া ফেরত আইছে, আরেকটা আহে নাই
হাফসা বেগমের পাঁচ সন্তানের মধ্যে দুই মেয়ে কাজ করতেন হাশেম ফুডস অ্যান্ড বেভারেজ কারখানায়। সকালের শিফটে কাজ করে বড় মেয়ে বাড়ি ফিরলেও বিকালের শিফটে কাজ করা ১৫ বছরের ফাতেমা বেগম আর আসেননি। কেন এত ছোট মেয়েকে কাজে পাঠিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, “অভাবের তাড়নায় দিছি। অর বাপের পানের দোকানের আয় দিয়া সংসার চলে না। তাই বড় দুই মাইয়ারে কামে লাগাইছিলাম।“
ইস্কুল বন্ধ, তাই কামে দিছিলাম মাইয়াটারে
পেশায় কাঠমিস্ত্রী মুইরা চরণ সরকার জানান, এই কারখানায় পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা বেতনে কাজে দিয়েছিলেন ১৫ বছরের মেয়ে শেফালি সরকারকে। গত দেড় বছর ধরে করোনার কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় মেয়েকে এখানে দিয়েছেন। এখানে কাজ করতে দিয়ে ছোট মেয়েকে এভাবে হারাবেন, কল্পনাও করেননি বাবা।
নাতিনে খালি মায়ের কথা জিগায়
হাশেম ফুডস অ্যান্ড বেভারেজ কারখানায় এক বছর ধরে কাজ করেন ২৪ বছর বয়সী সুফিয়া বেগম। দূর্ঘটনার দিন থেকে তার কোন খোঁজ মেলেনি। সুফিয়ার মা রহিমা আক্তার জানান, তার মেয়ের চার বছরের মেয়ে রয়েছে। কিছুক্ষণ পরপর নাতনি শুধু তার মায়ের কথা জিগাস করে। তিনি বুঝতে পারছেন না এ অবুঝ শিশুকে কিভাবে বোঝাবেন।
মানুষের জীবনের দাম দুই লাখ টাকা?
মাছ ব্যবসায়ী প্রভা বর্মণ তার ১৫ বছরের মেয়েকে এ কারখানায় কাজে দিয়েছেন এক মাস হলো। এখানে চতুর্থ তলায় কাজ করতেন মেয়ে কম্পা রানী বর্মণ। ক্ষতিপূরণের টাকার ব্যাপারে ক্ষোভের সুরে তিনি বলেন, “আজকার বাজারে একটা গরুর দাম অই ১৫ লাখ টেঁকা। আর সেই জায়গায় মানুষ মাইরা ফালাইলো, তার জীবনের দাম নাকি মাত্র দুই লাখ?”
বইনের লাশটা খালি চাই
পেশায় হোটেল কর্মচারী রুবেল হোসেন বলেন, তার মামাতো বোন আমেনা বেগম সেজান জুস কারখানায় কাজ করতেন তিন বছর ধরে। মূলত ছয় তলায় কাজ করলেও কয়েকদিনের জন্য চার তলায় নিয়ে যাওয়া হয় তাদের কয়েকজনকে। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, “জানি বইন আর ফেরত আইব না, এখন খালি তার লাশটা ফেরত চাই আমরা।“
বেতন বোনাস কিছু পাই নাই
ক্ষতিপূরণের টাকা দাবি করে হাশেম ফুডসের কারখানার গেটে সস্ত্রীক পাওয়া গেল বাচ্চু মিয়াকে যিনি মেয়ে তাসলিমা আক্তারকে হারিয়েছেন। ক্ষোভের সুরে তিনি বলেন, “মাইয়ার এক মাসের কামের বেতন বোনাসের টেকা কিছু দেয় নাই আমাগোরে। যারা বাইচা আছে, হেরা খালি টেকা পাইছে। যারা মারা গেছে, কেউই এহনো এইসব পায় নাই বইলা হুনছি।”
মরণে টাইনা নিয়া গেছিল ঐ বিল্ডিংয়ে
১৫ বছর বয়সী ফারজানা আক্তার কাজ করতেন হাশেম ফুডসের একটি ভবনের ৬ তলায়। করোনার কারণে কাজ কম থাকায় আগুন লাগা ভবনের ৪র্থ তলায় তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় দিন সাতেক আগে। ফারজানার খালাতো বোন আসমা বলেন, “বইনরে সরায় না নিলে আজকা এই অবস্থা হইতো না তার। মরণই আমার বইনরে ঐ বিল্লিংয়ে লয়া গেসে।“
মাইয়া আমার কারো সাথে পাচে আছিল না
১৬ বছর বয়সী ইসরাত জাহান তুলি মাত্র দেড় মাস হলো হাশেম ফুডসের কারখানায় কাজ শুরু করেছেন। তুলির মা জহুরা বেগম কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, “আমার মাইয়াডা এতো লক্ষ্মী আছিল, কি কমু। পর্দা করতো, বাইরের কারো লগে তেমন কথা কইতো না। হেই সোনার টুকরা মাইয়া আমার বুকে আজ নাই, আল্লাহ লয়া গেছে হেরে।“
মামলা তুলে নেওয়ার চাপ
হাশেম ফুডস অ্যান্ড বেভারেজের প্রধান ফটকের সামনে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে নিখোঁজ কয়েকজনের আত্মীয় বসে আছেন। সাংবাদিক দেখে এগিয়ে এসে তারা বলেন, যারা বেঁচে আছেন এবং যারা নিহতের স্বজন, তাদেরকে মালিকপক্ষের লোকেরা চাপ দিয়েছেন যেন তারা মালিকের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য আন্দোলন করেন। তাহলে হয়ত তারা বকেয়া বেতন বোনাসের টাকা পেতে পারেন।