বড় আশা ছিল অমিয় দাশের৷ মা, স্ত্রীকে পেটানো, সন্তানকে চড়-থাপ্পর মেরে আগুনে ফেলতে যাওয়া, সম্ভব সব কিছু লুটে বাকিটা পুড়িয়ে দেওয়া – এসবের বিহিত হবে, ক্ষতিপূরণ পাবেন৷ তিন মাসে পেয়েছেন মিথ্যে আশ্বাস আর আড়াই হাজার টাকা!
বিজ্ঞাপন
গত ৫ই মার্চ যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির আদেশের পর বাংলাদেশের বেশ কিছু জায়গায় তাণ্ডব চালায় জামায়াত-শিবিরের কর্মী-সমর্থকরা৷ মামলার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই হামলার প্রধান শিকার ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন৷ বাড়ি-ঘর-মন্দির ভাঙচুর-পোড়ানো, লুটপাট, কোলের শিশু থেকে পরিবারের সর্বজ্যেষ্ঠ সদস্যকে পর্যন্ত পেটানো – সবই হয়েছে প্রতিবাদের নামে৷ সাতক্ষিরার অমিয় দাশের পরিবারও দেখেছে নিষ্ঠুরতা কাকে বলে!
চার বছরের মেয়েটি ঘুরে এসেছে আগুনে পুড়ে ছাই হওয়ার দোরগোড়া থেকে৷ সন্তানকে বাঁচাতে গিয়ে মা হয়েছেন প্রহৃত৷ তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে বৃদ্ধা, পক্ষাঘাতগ্রস্ত শাশুড়ি৷ পরিবারটির সবাই এখন ভালো করে জানে, হিন্দু হওয়া খুব বড় অপরাধ৷ চার বছরের শিশুটিও বুঝবে ভবিষ্যতে৷ কিন্তু ওর স্কুলপড়ুয়া বড় বোনটির নিশ্চয়ই আর তা বুঝতে বাকি নেই৷ সেদিনও নিশ্চয়ই মেয়েটি প্রতিবেশি বন্ধুদের সঙ্গে খেলেছে৷ বন্ধুদের অনেকেই নিরাপদ ছিল৷ অথচ ধোপাপাড়াকে দিনের আলোয় দেখতে হয়েছে বিভীষিকা৷ কয়রা উপজেলার ওই ছয়টি পরিবারের বেলায় অন্তত তা-ই সত্য৷ যে মেয়ে হামলাকারীরা ওদিক থেকে এসেছিল বলে আতঙ্কে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করেছিল, সে আবার স্কুলে যায়৷ একদিন হয়ত বড় হবে, কিন্তু শিশুমন যে চিরতরে ছোট হয়ে গেল তার কী হবে!
অমিয় দাশ সাক্ষাৎকার ২
সেদিন কী হয়েছিল তার বিবরণ গত ২৮ শে মার্চ প্রচারিত সাক্ষাৎকার শুনেই জানা যাবে৷ অমিয় দাশ অনুপু্ঙ্খ বর্ণনা দিয়েছিলেন দীর্ঘ কথোপকথনে৷ তবে আড়াই মাস পর তাঁর আর বেশি কিছু বলার নেই৷ এমন ক্ষেত্রে অতীতে যা হয়েছে তা-ই হচ্ছে৷ এক মুসলিম প্রতিবেশি এগিয়ে না এলে অমিয় আজ বৃদ্ধা মা, স্ত্রী, সন্তানকে কী অবস্থায় পেতেন বলা মুশকিল৷ এখন জানেন তাঁদের তিনি কিভাবে বাঁচিয়ে রাখছেন৷ কাঁচামালের ব্যবসায়ী গৃহকর্তা এখন সবাইকে নিয়ে গাদাগাদি করে থাকেন পুড়ে যাওয়া ঘরের পাশে কোনোরকমে তোলা ছোট্ট একটি দোচালায়৷ নগদ টাকা, স্বর্ণালঙ্কার সব লুট হয়ে যাওয়ায় খুব স্বল্প পুঁজিতেই শুরু করেছেন ব্যবসা৷ না করলে সবার মুখে দু'মুঠো ভাত তুলে দেবেন কী করে?
সাঈদীকে ফাঁসির রায়, জামায়াতের তাণ্ডব
একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের একাধিক অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় বৃহস্পতিবার দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল৷ এই রায় ঘোষণার পর গোটা বাংলাদেশে তাণ্ডব চালিয়েছে জামায়াত-শিবির৷ এতে হতাহত অনেক৷
ছবি: AFP/Getty Images
ট্রাইব্যুনালের রায়
দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে ২০টি অভিযোগে গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজসহ মানবতা বিরোধী অপরাধের কথা বলা হয়েছে৷ কয়েকটি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল-১ এর প্রধান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের আদালত মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করেন৷ অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম জানান, তার বিরুদ্ধে মানবতা বিরোধী ২০টি অভিযোগের ৮টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হয়েছে৷
ছবি: AP
রায়ের পরই তাণ্ডব
সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার পরপরই রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় সক্রিয় হয়ে ওঠে জামায়াত-শিবির৷ শুধু বৃহস্পতিবার বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছে কমপক্ষে ৩৫ ব্যক্তি৷ বার্তাসংস্থা এএফপি এবং আমাদের কন্টেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম নিশ্চিত করেছে এই তথ্য৷ তবে শুক্রবার মৃতের সংখ্যা আরো বেড়েছে৷
ছবি: Reuters
আক্রান্ত পুলিশ
বৃহস্পতিবার জামায়াতের তাণ্ডবে প্রাণ হারান চার পুলিশ সদস্য৷ এদের মধ্যে তিনজন নিহত হন গাইবান্ধা জেলায়৷ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরডটকম জানিয়েছে, ‘পুলিশ ফাঁড়িতে পিটিয়ে মারা হয় তাদের’৷ অপর একজন প্রাণ হারান চট্টগ্রামের লোহাগড়ায় সংঘর্ষের সময়৷ বার্তাসংস্থা এএফপি জানিয়েছে, আহত এক পুলিশ সদস্য শুক্রবার প্রাণ হারান৷ সবমিলিয়ে সাঈদীর রায় ঘোষণার পর শুক্রবার দুপুর অবধি পুলিশ সদস্য নিহতের সংখ্যা ৫৷
ছবি: STR/AFP/Getty Images
‘অধিকাংশই জামায়াত-শিবির কর্মী’
জামায়াত দাবি করেছে, ‘‘পুলিশের গুলিতে তাদের ৫০ জন ‘নিরপরাধ’ সমর্থক নিহত হয়েছে৷ পুলিশ তাদেরকে ‘পাখির মতো গুলি করে’ হত্যা করেছে৷’’ তবে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রধান সুলতানা কামাল পুলিশের উপর সন্ত্রাসী হামলার জন্য জামায়াতকে দায়ী করেছেন৷
ছবি: AFP/Getty Images
প্রাণ হারাচ্ছে নিরীহ মানুষও
জামায়াতের তাণ্ডবে পুলিশ সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন, নিহত হয়েছেন আওয়ামী লীগ সমর্থকও৷ তবে সাধারণ মানুষও মরছে এই তাণ্ডবে৷ ঢাকায় বৃহস্পতিবার প্রাণ হারান এক পথচারী, নোয়াখালি এবং বাঁশখালীতে নিহত হন হিন্দু সম্প্রদায়ের দুই ব্যক্তি৷ শুক্রবারও গাইবান্ধায় এক রিকশা চালক নিহত হয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের এবং জামায়াতের সমর্থকদের মধ্যকার সংঘর্ষের মাঝে পড়ে৷ নিরীহ প্রাণহানির এরকম খবর আরো শোনা যাচ্ছে৷
ছবি: AFP/Getty Images
‘ফেসবুক বন্ধ’
সাঈদীর বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার সময় বাংলাদেশ থেকে কম্পিউটার ব্যবহার করে স্বাভাবিক উপায়ে ফেসবুকে প্রবেশ করা যাচ্ছিল না৷ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি’র ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াসউদ্দিন আহমেদ জানান, ‘কারিগরি সমস্যার জন্য এমনটা হয়েছে’৷ তবে তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ জাকারিয়া স্বপন বলেন, ‘বৃহস্পতিবার তারা (বিটিআরসি) কিছুক্ষণের জন্য ফেসবুক বন্ধ করে দিয়েছিল এবং পুনরায় আবারো চালু করেছে৷’
সতর্ক নিরাপত্তা বাহিনী
জামায়াত-শিবির তাণ্ডব আর নাশকতা রুখতে গোটা দেশে সতর্ক রয়েছে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা৷ বৃহস্পতিবার রাতেই বিভিন্ন এলাকায় মোতায়েন করা হয়েছে বিজিবি৷
ছবি: Reuters
ভিন্ন চিত্র
তবে সাঈদীর ফাঁসির রায়ে সামগ্রিকভাবে সন্তুষ্ট সাধারণ মানুষ৷ বৃহস্পতিবার এই রায় ঘোষণার পর উল্লাসে ফেটে পড়েন শাহবাগে অবস্থানরতরা৷ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় মিষ্টি বিতরণ করা হয়৷ ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানান অগুনতি মানুষ৷
ছবি: Reuters
‘শহীদের আত্মা শান্তি পাবে’
সাঈদীর বিরুদ্ধে একটি মামলার বাদি ও প্রথম সাক্ষী মাহবুবুল আলম হাওলাদার৷ রায় ঘোষণার পরে ডয়চে ভেলেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘সাঈদীর ফাঁসির আদেশ হওয়ায় দেশমাতৃকা কিছুটা পাপমুক্ত হয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির জন্য ৪২ বছরের অপেক্ষার অবসান হতে চলেছে৷’
ছবি: DW/Harun Ur Rashid
আরো রায় বাকি
এখন পর্যন্ত তিন যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল৷ বাকি আছে আরো যুদ্ধাপরাধীর বিচার৷ মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি অপেক্ষায় আছে সব যুদ্ধাপরাধীর বিচার দেখার৷ বর্তমান তরুণ প্রজন্মও তাই জেগে আছে প্রজন্ম চত্বরে৷
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
অথচ ঘটনার পর যত আশ্বাস পেয়েছেন তার কিয়দংশ সত্যি হলেও স্বচ্ছল জীবনে হয়ত ফিরতে পারতেন অমিয় দাশ৷ কিছুই যে পাননি তা নয়৷স্থানীয় এএমপি ধোপাপাড়ার ছয়টি পরিবারকে দিয়ে এসেছিলেন ১৫ হাজার টাকা৷ অমিয় ভাগে পেয়েছেন আড়াই হাজার৷ ব্যাস৷ বিগত সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ‘অহঙ্কার' নিয়ে দেশ শাসন করছে আওয়ামী লীগ সরকার, সংখ্যালঘু এই পরিবারগুলোর জন্য তিন মাসেও কিছু করতে পারেনি৷
অমিয় শুনেছেন, ছয়টি পরিবারকে ঘর তোলার জন্য কিছু টিন দিয়েছে সরকার৷ স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে গিয়ে জেনেছেন শোনা কথা সত্য৷ তারপর? সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার কাছে ধর্ণা দেয়া চলছে৷ ভদ্রলোক শুনে বারবার বলছেন, ‘‘আমার একটু ঝামেলা রয়েছে, কয়েকদিন যাক, ঝামেলাটা সারি...৷''
অমিয় দাশরা এক দিনের বর্বরোচিত হামলায় যে ‘ঝামেলায়' পড়লেন তা কি আদৌ কোনোদিন সারবে? কে সারবেন? কবে?