ক্রাইস্টচার্চের দু'টি মসজিদে গত শুক্রবারের হামলায় ৫০ জন নিহত হওয়ার পর দেশটির প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আর্দার্নের নেয়া বিভিন্ন উদ্যোগ ও সিদ্ধান্ত প্রশংসিত হচ্ছে৷ তবে এবার তিনি হুমকি পেলেন৷
বিজ্ঞাপন
দেশটির পুলিশ শুক্রবার জানিয়েছে, তারা টুইটারে প্রধানমন্ত্রীকে দেয়া হুমকির তদন্ত করছে৷
নিউজিল্যান্ড হেরাল্ড পত্রিকা জানিয়েছে, একটি টুইটার পোস্টে একটি বন্দুকের ছবির সঙ্গে ‘এরপর আপনি’ ক্যাপশন লিখে সেটি প্রধানমন্ত্রীকে পাঠানো হয়েছে৷ এরপর ঐ টুইটার অ্যাকাউন্ট সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বলেও পত্রিকাটি জানিয়েছে৷
তবে বার্তা সংস্থা রয়টার্স স্বাধীনভাবে এর সত্যতা যাচাই করে দেখতে পারেনি৷
অস্ট্রেলিয়ার ২৮ বছর বয়সি ব্রেন্টন টেরান্ট গত শুক্রবার ক্রাইস্টচার্চের আল-নূর মসজিদসহ আরেকটি মসজিদে জুম্মার নামাজের সময় হামলা চালিয়ে ৫০ জনকে হত্যা করেন৷
এই ঘটনার এক সপ্তাহ পর আজ শুক্রবার আল নূর মসজিদের সামনে জুম্মার নামাজের সময় প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আর্দার্ন ও মন্ত্রিসভার কয়েকজন সদস্যসহ দেশটির অনেক সাধারণ নাগরিক উপস্থিত ছিলেন৷ হেডস্কার্ফ ও কালো পোশাক পরিহিত আর্দার্ন সেই সময় দেয়া এক সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বলেন, ‘‘নিউজিল্যান্ড আপনাদের সাথে একসঙ্গে শোক প্রকাশ করছে৷ আমরা এক৷’’
এই সময় কড়া নিরাপত্তা প্রহরার ব্যবস্থা করা হয়েছিল৷ নারী পুলিশ সদস্যরাও হেডস্কার্ফ পরে ছিলেন৷ আর তাঁদের পোশাকে লাল গোলাপ লাগানো ছিল৷
নামাজের সময় উপস্থিত সাধারণ নাগরিকদের অনেকেও হেডস্কার্ফ পরেছিলেন৷ নিহতদের স্মরণে দুই মিনিট নীরবতা পালন করা হয়৷
দেশব্যাপী টিভি ও বেতারে জুম্মার নামাজ সরাসরি সম্প্রচার করা হয়৷
আল-নূর মসজিদ ছাড়াও পুরো দেশেই হাজার হাজার মানুষ নিহতদের প্রতি সম্মান জানিয়েছেন৷ অনেকে মসজিদের সামনে মানববন্ধনও তৈরি করেছেন৷
নামাজের আগে আল-নূর মসজিদের ইমাম গামাল ফুদা প্রায় ২০ মিনিট বক্তব্য দেন৷ তিনি বলেন, ‘‘আমাদের হৃদয় ভেঙে গেছে৷ কিন্তু আমরা ভেঙে পড়িনি৷ আমরা বেঁচে আছি৷ আমরা একসঙ্গে আছি৷ আমরা কাউকে আমাদের মাঝে বিভক্তি তৈরি করতে দেব না৷’’
নিহতদের আত্মীয়স্বজনদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘‘আপনাদের ভালোবাসার মানুষদের হত্যা বিফলে যায়নি৷ তাঁদের রক্ত দিয়ে আশার বীজে পানি দেয়া হয়েছে৷’’
উল্লেখ্য, মসজিদে হামলার ঘটনায় দেশটির অস্ত্র বিক্রি আইনে পরিবর্তন আনার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী আর্দার্ন৷ বৃহস্পতিবার তিনি জানান, এবার থেকে সামরিক-শৈলীর সেমি-অটোম্যাটিক ও অটোম্যাটিক অস্ত্র আর বিক্রি করা হবে না দেশটিতে৷
জেডএইচ/ডিজি (রয়টার্স)
বিশ্ব নেতৃত্বের আদর্শ এখন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী
জাসিন্ডা আর্ডার্ন৷ নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী থেকে তিনি এখন পরিণত হয়েছেন বিশ্বকে শান্তির পথে নেতৃত্ব দেয়ার দূত হিসেবে৷ তার উত্থানের গল্প থাকছে এই ছবিঘরে৷
ছবি: Reuters/A. Wiegmann
যোগাযোগের ছাত্রী
১৯৮০ সালে জন্ম নেয়া আর্ডার্নের বেড়ে ওঠা মুরুপাড়া নামে নিউজিল্যান্ডের মাউরি আদিবাসী অধ্যুষিত একটি ছোট্ট শহরে৷ যেখানে শিশুদের পায়ে দেয়ার মতো জুতা ছিল না, এমনকি দুপুরে তারা খাবারও পেত না৷ এই ঘটনাই তাকে রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ করে৷ উচ্চ মাধ্যমিক শেষে আর্ডার্ন পড়াশোনা করেন যোগাযোগ বিদ্যায়৷ তার আগে ১৭ বছর বয়সেই যুক্ত হন নিউজিল্যান্ডের লেবার পার্টির রাজনীতিতে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Baker
বিশ্ব রাজনীতির পাঠ
স্নাতক শেষ করে আর্ডার্ন নিউজিল্যান্ডের লেবার পার্টির একজন সংসদ সদস্যের অধীনে গবেষক হিসেবে কাজ করেন৷ ২০০৫ সালে পাড়ি জমান ব্রিটেনে৷ আড়াই বছর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের মন্ত্রীসভার দপ্তরে চাকরি করেন৷ ২০০৭ সালে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব সোশ্যালিস্ট ওয়েলথের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘুরে বেড়িয়েছেন আলজেরিয়া, চীন, ভারত, ইসরায়েল, জর্ডার্ন ও লেবাননে৷
ছবি: Reuters/A. Wiegmann
জাতীয় রাজনীতির পথ চলা
২০০৮ সালে আর্ডার্ন লেবার পার্টির সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়েও ১৩,০০০ ভোটে হেরে যান৷ কিন্তু দেশটির সংবিধানিক নিয়মে তিনি সংসদে যাওয়ার সুযোগ পান৷ ২৮ বছর বয়সে সর্বকনিষ্ঠ রাজনীতিবিদ হিসেবে জায়গা করে নেন হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভে৷
ছবি: Getty Images/P. Walter
‘জাসিডামেনিয়া’
২০১৭ সালে লেবার পার্টির উপ প্রধান নির্বাচিত হন আর্ডার্ন৷ নির্বাচনের দু’মাস আগে দলটির প্রধান পদত্যাগ করলে সেই ভারও চাপে তার কাঁধে৷ নির্বাচনি প্রচারে তরুণদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় হন আর্ডার্ন৷ তাকে নিয়ে এসময় দেশটিতে জনপ্রিয়তার যে ঢেউ উঠে, তা পরিচিত ‘জাসিডামেনিয়া’ নামে৷
ছবি: Getty Images/P. Walter
বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ নারী প্রধানমন্ত্রী
মাত্র দু’মাসের নেতৃত্বে অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাই দলকে নির্বাচনে বিজয়ী করেন আর্ডার্ন৷ ২০১৭ সালে ৩৮ বছর বয়সে বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন৷ নিউজিল্যান্ডের ১৫০ বছরের ইতিহাসেও তিনি সবচেয়ে কম বয়সি সরকার প্রধান৷
ছবি: picture-alliance/Zumapress
প্রভাবশালী নারী
আর্ডার্ন সমকামী বিবাহের সমর্থক৷ জলবায়ু পরিবর্তন, শিশু দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে তিনি উচ্চকিত৷ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, নিউজিল্যান্ডের সরকার হবে সহানুভূতিশীল৷ ২০১৮ সালে ‘ফোর্বসের পাওয়ার উইমেনের’ তালিকায় জায়গা করে নেন তিনি৷ আছেন টাইম ম্যাগাজিনে সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তির তালিকাতেও৷
ছবি: Reuters/A. Wiegmann
সন্তান জন্ম
টিভি উপস্থাপক ক্লার্ক গেফোর্ডকে বেছে নিয়েছেন তিনি সঙ্গী হিসেবে৷ ২০১৮ সালের ২২ জুন বেনজির ভুট্টোর পর বিশ্বের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বকালে সন্তানের জন্ম দেন আর্ডার্ন৷ এজন্য মাত্র ছয় সপ্তাহের মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়েছিলেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Office of the Prime Minister of New Zealand/D. Henderson
সন্তান কোলে জাতিসংঘে
বিশ্বে প্রথমবার কোনো প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের কক্ষে সন্তান নিয়ে বক্তৃতা দিতে যান৷ তিনি জাসিন্ডা আর্ডার্ন৷ গত বছর নেলসন ম্যান্ডেলা পিস সামিটে অংশ নিয়ে আর্ডার্ন বিশ্ব গণমাধ্যমে খবরের শিরোনাম হয়েছেন৷ বক্তৃতা দেয়ার সময় সন্তান ছিল সঙ্গী ক্লার্ক গেফোর্ডের কোলে৷
ছবি: Reuters/C. Allegri
ক্রাইস্টচার্চের ঘটনায় প্রতিক্রিয়া
ক্রাইস্টচার্চে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ৫০ জনকে হত্যার পর জাসিন্ডা আর্ডার্নকে নতুন করে চেনে বিশ্ব৷ এই ঘটনার অভিযুক্তকে কোনো কার্পণ্য না করেই সন্ত্রাসী ও জঙ্গি হিসেবে অভিহিত করেন তিনি৷ দ্রুত অস্ত্র আইন পরিবর্তনের ঘোষণা দেন৷ মুসলমানদের উদ্দেশ্যে জানান, নিউজিল্যান্ড মোটেও এমনটা নয়৷ এই দেশে তারা স্বাধীনভাবেই থাকতে পারবে৷
ছবি: Reuters/E. Su
হিজাবে আর্ডার্ন
জাসিন্ডা আর্ডার্ন ক্রাইস্টচার্চের ঘটনার পর ছুটে যান নিহতদের স্বজনদের কাছে৷ তাদের জড়িয়ে ধরেন, সমবেদনা প্রকাশ করেন৷ শুধু তাই নয়, মুসলমানদের সাথে একত্মতার প্রকাশ হিসেবে তিনি একাধিক দিন হিজাব পরে বেরিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/TVNZ
সংসদে আরবি ভাষা
২০১৯ সালে ১৯ মার্চ সংসদে বক্তব্য দেন আর্ডার্ন৷ শুরুতেই সবাইকে ‘আস সালামু আলাইকুম’ বলে সম্বোন্ধন করেন তিনি৷ জানান ক্রাইস্টচার্চের ঘটনায় অভিযুক্তের নামও তিনি কখনও মুখে আনবেন না৷
ছবি: Getty Images/M. Tantrum
করোনার বিরুদ্ধে লড়াই
করোনা প্রতিরোধে বিশ্বে যে কয়টি দেশ সাফল্য পেয়েছে তার একটি নিউজিল্যান্ড৷ আর্ডার্নের নেতৃত্বে দেশটির সরকার করোনা ভাইরাসকে কখনো হুমকি হতে দেয়নি৷ শুরুতেই সীমান্ত বন্ধ করে কড়াকড়ি আরোপ করে সরকার৷ সামাজিক দূরত্ব, কোয়ারান্টিন, আইসোলেশনসহ বিভিন্ন নিয়মগুলো সুচারুভাবে পালন করা হয়৷ চলে বিস্তৃত পরিসরে করোনার পরীক্ষা৷ ফলাফল অন্য দেশগুলো যখন হিমশিম পরিস্থিতিতে তখন অনেকটাই নির্ভার নিউজিল্যান্ড৷