২০১৯ সালের ১৫ মার্চ নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ শহরের দুটি মসজিদে সশস্ত্র হামলায় প্রাণ হারান ৫১জন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Baker
বিজ্ঞাপন
মঙ্গলবার ক্রাইস্টচার্চ হামলার তদন্ত শুরু হয় নিউজিল্যান্ডে৷ শুরুতেই দেখানো হয় নিহতদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে একটি ভিডিও৷
ছয় সপ্তাহব্যাপী এই তদন্তে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ডেপুটি চিফ করোনার ব্রিগিটে উইন্ডলি৷ সেদিন কী ঘটেছিল, তা খতিয়ে দেখার পাশাপাশি নজর দেওয়া হবে জরুরি পরিষেবার তৎপরতা, মসজিদের ইমারজেন্সি এক্সিটের কার্যকারিতার দিকেও৷
রেডিও নিউজিল্যান্ডকে ব্রিগিটে উইন্ডলি জানান যে এই তদন্ত ‘মৃত্যুর কারণ ও অবস্থার' দিকে আলোকপাত করবে৷ সাথে, ‘ভবিষ্যতে এভাবে প্রাণনাশের ঝুঁকি' কীভাবে কমানো যায়, সেবিষয়ে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় পন্থা অবলম্বন করার পরামর্শ দেবে৷
তদন্তের লক্ষ্য
উইন্ডলি জানান যে এই তদন্তের মূল উদ্দেশ্য ফাঁক খোঁজা নয়, বরং এই তদন্ত চিহ্নিত করবে নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের, যাদের এই ঘটনার ক্ষেত্রে কোনো গাফিলতি হয়ে থাকতে পারে৷
পাঁচ হাজারেরও বেশি ছবি, তিন হাজারেরও বেশি অডিও, ৮০ ঘন্টারও বেশি সময়ের ভিডিও খুঁটিয়ে দেখবে তদন্তকারীরা৷ আগামী ছয় সপ্তাহ ধরে প্রায় ছয়শ মানুষ শুনবেন এই তদন্তের কাজ৷
ক্রাইস্টচার্চ হামলায় বেঁচে যাওয়ারা যেমন আছেন
১৫ মার্চের ক্রাইস্টচার্চ হামলার দুঃসহ স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছেন এই ঘটনার আহতরা৷ প্রিয়জন হারানোর শোক সামলে উঠার চেষ্টা করছেন নিহতদের পরিবারের সদস্যরা৷ কিন্তু তা কি এত সহজে সম্ভব!
ছবি: Reuters/E. Su
আল নূর মসজিদ
জুম্মার নামাজ পড়তে আসা মুসুল্লিদের উপর চালানো হামলাটি শুরু হয়েছিল এই মসজিদ থেকে দুপুর ১ টা ৪০ মিনিটে৷ হামলাকারীর এলোপাথাড়ি গুলিবর্ষণে মোট ৪০ জন নিহত হয়েছিলেন৷ ঘটনার পরে মসজিদের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে৷ ছবিতে অস্ত্র হাতে দুজন পুলিশ সদস্যকে মসজিদের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Reuters/E. Su
বাবার স্মৃতি
ওমরের বয়স যখন ১১ তখন বাবার সাথেই প্রথম ভেড়া জবাইয়ের অভিজ্ঞতা হয়েছিল তাঁর৷ ক্রাইস্টচার্চের হামলায় নিহত হয়েছেন হাজী দাউদ নবী৷ পিতার জন্য শান্তি কামনা করে সম্প্রতি ভেড়া জবাই করেছেন ওমর৷ দাউদ নবীর ইচ্ছা ছিল ক্রাইস্টচার্চে নিজের এক খন্ড জমিতে একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করার৷ বাবার সেই স্বপ্ন এখন পূরণ করতে চান ৪২ বছরের ওমর৷
ছবি: Reuters/E. Su
অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ
ছবির ডান পাশের ব্যক্তির নাম মার্ক রাঙ৷ তিনি অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক৷ এক আত্মীয়ের সাথে দেখা করার পর প্রথমবারের মতো আল নূর মসজিদে নামাজ পড়তে আসেন৷ হামলায় দুই পা জখম হয়৷ অস্ত্রোপচারের পর হাঁটতে সক্ষম হয়েছেন ঠিকই কিন্তু সিডনি বিমানবন্দরে ব্যাগ উঠা নামানোর চাকরিতে আর ফিরতে পারবেন কিনা তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় তিনি৷
ছবি: Reuters/E. Su
প্রিয়জন শুধুই ছবি
প্রায়ই আল নূর মসজিদে সময় কাটাতেন হোসেন মোস্তফা৷ সেখানে ধর্মীয় একটি লাইব্রেরি গড়ে তোলার পাশাপাশি মসজিদের খোলা জায়গায় সবজি বাগান গড়ে তোলার পরিকল্পনা ছিল তাঁর৷ স্ত্রী জাহরা ফাতির কাছে এখন এই ছবির অ্যালবামই তাঁর সবচেয়ে মূল্যবান স্মৃতি৷ প্রিয়জন হারানোর বেদনা ভুলতে জাহরা এবারের রমযান কাটাতে চান মিশরে স্বজনদের কাছে৷
ছবি: Reuters/E. Su
ভালবাসার বার্তা
ক্রাইস্টচার্চে বসবাসরত বাংলাদেশি ফরিদ আহমেদ হারিয়েছেন তাঁর স্ত্রীকে৷ হত্যাকারীকে ক্ষমা করে দিয়ে মানবতার বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছেন তিনি গোটা বিশ্বে৷ দুঃসময়ে পাশে থাকার জন্য গত রোববার প্রতিবেশীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন তিনি৷ ছবিতে তাঁদের কয়েকজনের সাথে প্রার্থনারত অবস্থায় দেখা যাচ্ছে ফরিদ আহমেদকে৷
ছবি: Reuters/E. Su
এখনও শোনেন গুলির শব্দ
ক্রাইস্টচার্চের হামলার ঘটনায় বেঁচে যাওয়াদের একজন সর্দার ফয়সাল৷ সেদিন তিনি মসজিদে কিছুটা দেরিতে গিয়েছিলেন৷ নামাজের জন্য তিনি যখন ওযু করছিলেন তখনই হামলার ঘটনা ঘটে৷ লুকিয়ে থেকে বেঁচে যান ফয়সাল৷ কিন্তু প্রতিটি গুলির আওয়াজ এখনও যেন তাঁর কানে বাজে৷ ঘটনার পরে আর কাজে ফেরেননি ফয়সাল৷ নিহতদের পরিবার আর আহতদের জন্য খাবারের যে আয়োজন রয়েছে রাতদিন তার সমন্বয় করছেন তিনি৷
ছবি: Reuters/E. Su
বেদনা আর আনন্দের অশ্রু
ক্রাইস্টচার্চে হামলাকারীর ঠিক সামনেই ছিলেন হাজেম মোহাম্মদ৷ কিন্তু শুয়ে পড়ে মারা যাওয়ার অভিনয় করেন তিনি৷ তাঁর আশেপাশে তখন মৃত আর আহতদের দেহ৷ হাজেম মোহাম্মদ বলেন, ‘‘আমি দুটি কারণে কাঁদছিলাম৷ প্রথমত বন্ধুদের হারিয়েছি এজন্য৷ দ্বিতীয়ত ১৫ মার্চ ২০১৯ তারিখে আমার পুনর্জন্মের আনন্দের জন্য৷’’
ছবি: Reuters/E. Su
শান্তির ধর্ম ইসলাম
ক্রাইস্টচার্চ হামলার ঘটনার পর নিউজিল্যান্ডে ধর্মীয় সম্প্রীতির অনন্য নজির গড়ে উঠেছে৷ বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষ যেমন মুসলমানদের পাশে দাঁড়িয়েছেন তেমনি মুসলিমরাও ভালোবাসা আর শান্তির বাণী ছড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্বে৷ আল নূর মসজিদের ঘড়িতে কোরআনের বাণীও তারই অনুপ্রেরণা দিচ্ছে, ‘‘আল্লাহ ধৈর্য্যশীলদের সাথে রয়েছে৷’’
ছবি: Reuters/E. Su
8 ছবি1 | 8
আল নূর মসজিদ ও লিনউড ইসলামিক সেন্টারে অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক ব্রেন্টন টারান্ট সেমি অটোমেটিক অস্ত্র হাতে যখন হামলা করে, সেই ঘটনা সরাসরি ইন্টারনেটে সম্প্রচারও করে সে৷ হামলার আগে তার চিন্তাধারা বিষয়ে একটি ইস্তাহার প্রকাশ করেছিল সে৷
৫১টি খুন, ৪০টি খুনের চেষ্টা ও একটি সন্ত্রাসবাদের ধারার সকল অভিযোগ মেনে নেওয়ার পর ২০২০ সালের আগস্ট মাসে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয় তাকে৷
টারান্টকে কেউ বাইরে থেকে সাহায্য করেছে কি না, তাও তদন্তের অংশ হবে বলে জানা গেছে৷
যা বলছে নিহতদের পরিবার
নিহতদের পরিবারের সদস্যদের সংস্থা ‘১৫ মার্চ হোয়ানাউ ট্রাস্ট'৷ তার মুখপাত্র মাহা গালাল জানান যে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পাওয়া উচিত ‘সত্যকে খুঁজে বের করে আনা'৷
তিনি বলেন যে, তাদের প্রিয়জনদের বেঁচে থাকার কোনো উপায় ছিল কি না, সেবিষয়ে বিস্তারিত তদন্ত হোক, এবিষয়ে নিহতদের পরিবারের সদস্যরা একমত৷
এই তদন্ত সেদিনের ঘটনাবলী ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপকে খতিয়ে দেখলেও নতুন করে ক্ষতিপূরণ বা জরিমানার সম্ভাবনা নেই৷
ক্রাইস্টচার্চ শহরের ঘটনার পর নিউজিল্যান্ডে বন্দুক বিষয়ে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়, ক্রাইস্টচার্চ কল নামের একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম তৈরি হয় যার কাজ অনলাইনে চরমপন্থি ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপের দিকে নজর রাখা৷
নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে দুইটি মসজিদে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হন ৫০ জন৷ স্থানীয় মুসলমানরা এই ঘটনায় যাতে আতঙ্কিত না হন সেজন্য তাদের দিকে সহানুভূতির হাত বাড়িয়েছেন অন্য ধর্মাবলম্বীরা৷
ছবি: Reuters/J. Silva
মসজিদে হামলা
শুক্রবার নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ শহরে জুম্মার নামাজের সময় মসজিদে ঢুকে এলোপাথাড়ি গুলি চালায় ডানপন্থি এক জঙ্গি৷ এতে ৫০ জন নিহত হন৷ আহত হয়েছেন আরো অনেকে৷ হামলার খবর ছড়িয়ে পড়লে বিশ্বের বিভিন্ন সম্প্রদায় থেকে আসতে থাকে সমবেদনার বার্তা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Matrixpictures
নিহতদের মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশিরাও...
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পাঁচ জন বাংলাদেশির মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে৷ মোট দশ জন বাংলাদেশি এই হামলায় আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানিয়েছে তারা৷ যার মধ্যে কয়েকজন নিখোঁজ রয়েছেন৷ উপরের ছবিতে এক বাংলাদেশি নারীকে দেখা যাচ্ছে, শুক্রবারের পর থেকে তিনি তার স্বামীর সন্ধানে রয়েছেন৷
ছবি: Reuters/J. Silva
মানবিক ভূমিকায় নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী
হামলার খবর প্রকাশিত হবার পর থেকে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করছেন প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আর্ডার্ন৷ তিনি ক্রাইস্টচার্চের একটি মসজিদে নিহতদের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন, আক্রান্তদের পরিবারের সাথে সময় কাটান৷ তাদের আস্বস্ত করতে তিনি বলেন, ‘‘নিউজিল্যান্ড আসলে এমন নয়৷ আমার কাজ এখন আপনাদের ভালোবাসা, নিরাপত্তা আর সহযোগিতা দেওয়া, যাতে নির্দ্বিধায় আপনারা নিজেদের সংস্কৃতি আর ধর্মকে ধরে রাখতে পারেন৷’’
ছবি: Reuters/New Zealand Prime Minister's Office
‘মুসলমান ভাইদের পাশে’ পোপ
রোববারের প্রার্থনাসভায় নিউজিল্যান্ডের সন্ত্রাসী হামলায় নিহতদের আত্মার প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন পোপ ফ্রান্সিস৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি নতুন করে নিহতদের জন্য সবাইকে প্রার্থনা করতে আহবান জানাচ্ছি৷ আমরা মুসলমান ভাইয়েদের পাশে আছি এবং হিংসা ও সহিংসতার বিরুদ্ধে শান্তির বার্তা দিচ্ছি৷’’
ছবি: Imago/Zuma
‘পাহারায়’ অন্যান্য ধর্মের মানুষ
নিউজিল্যান্ডের স্থানীয় খ্রিস্টান ও অন্য ধর্মাবলম্বীরা আক্রান্তদের কাছে ছুটে যাচ্ছেন৷ মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের জন্য অনেকেই হালাল খাবার জোগাড় করে দিচ্ছেন৷ ভুক্তভোগীদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করছেন অনেকে৷ কেউ কেউ বলছেন যে, মুসলিমরা প্রার্থনা করার সময় প্রয়োজন হলে মসজিদের বাইরে থেকে তারা পাহারা দেবেন৷
ছবি: Reuters/J. Silva
পাশে দাঁড়িয়েছে ইহুদিরাও
তাহির নওয়াজ, নিউজিল্যান্ডের আন্তর্জাতিক মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রেসিডেন্ট৷ তিনি বলেন, ‘‘আমার ধর্মের মানুষ ছাড়াও অসংখ্য খ্রিষ্টান ও ইহুদি আমাকে সমবেদনা ও সাহায্যের বার্তা পাঠাচ্ছেন৷ অন্য ধর্মের বেশ কয়েকজন নেতাও আমার সাথে যোগাযোগ করেছেন৷’’ ওপরের ছবিতে এক ইহুদি নারীকে দেখা যাচ্ছে, যিনি তাঁর মুসলমান ভাইদের পাশে থাকার কথা বলছেন৷
ছবি: Reuters/R. U. Abbasi
আদিবাসীদের সমবেদনা
নিউজিল্যান্ডের অন্যতম আদিবাসী গোষ্ঠী মাওরি৷ শুক্রবারের হামলার পর, দেশের বিভিন্ন জায়গায় মৃতদের উদ্দেশ্যে শোক জানান তারাও৷ শুধু তাই নয়, আক্রান্তদের পাশে থাকার বহিপ্রকাশ হিসেবে নিজেদের ঐতিহ্যবাহী ‘হাকা’ নাচও পরিবেশন করেন তারা, যা মাওরি সংস্কৃতির অংশ৷ (প্রতীকী ছবি)
ছবি: Getty Images/H. Peters
ছোট থেকে বড়- সবার চোখে জল
ক্রাইস্টচার্চের ভয়াবহ হামলার ঘটনার পর থেকে নিউজিল্যান্ডের বিভিন্ন জায়গায় নিহতদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছেন সাধারণ মানুষ৷ মসজিদের সামনে জড়ো হয়ে ফুল দিয়ে বা মোমবাতি জ্বালিয়ে শ্রদ্ধা জানান তারা৷ বয়স, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেকের মুখে ছিল শোকের ছায়া৷