নিউজ ইন দ্য টাইম অব করোনা
৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০সেদিন চোখে পড়লো আমার এক ফেসবুক বন্ধু একটি সংবাদ শেয়ার করেছেন৷ সংবাদে বলা হয়েছে ভারতের কেরালায় কয়েক হাজার নভেল করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ায় সেখানে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে৷ আমি তো রীতিমতো আঁতকে উঠলাম৷ সত্যিই এমন হলে তো এটি অনেক বড় খবর৷
নিজেকে সামলে উঠে যখন একটু খেয়াল করলাম, দেখলাম সেটি একেবারেই নামের শেষে ২৪ যোগ করা একটি অপরিচিত অনলাইন পোর্টাল৷ একটু খুঁজতেই পেলাম, জরুরি অবস্থা জারি হয়েছে বটে, কিন্তু আক্রান্তের সংখ্যাটা আসলে তিন৷ কিন্তু ততক্ষণে আমার ‘বন্ধুর' শেয়ার করা সংবাদ আরো অনেকে শেয়ার করেছেন৷ অনেকে কমেন্ট করছেন এটা ‘ভারতের ওপর গজব' বলে৷
কোনো কিছু ঘটলেই সেটা থেকে নিজেরা কিভাবে ফায়দা লোটা যায়, সে ধান্দায় ব্যস্ত সবাই৷ বাংলাদেশে হঠাৎ মাস্কের দাম বেড়ে গেছে, কিন্তু এই মাস্ক দিয়ে যে ভাইরাস তো দূরের কথা রাস্তার ধুলাও ঠিকমতো ঠেকানো যায় না, সেটা ভাবারও প্রয়োজন মনে করছেন না কেউ৷
কে জানে রাস্তায় ক্যানভাসাররা কদিন পরে ঠেলাগাড়িতে করোনা ভাইরাসের ওষুধ বিক্রি শুরু করবেন কিনা৷ ভারতে দেখলাম এক ধর্মব্যবসায়ী গরুর গোবর ভাইরাস দূর করবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন৷ বাংলাদেশেও কিছু ভিডিওতে করোনা ভাইরাস ঠেকানোর দোয়া শেখাতে দেখলাম৷
তো এই যখন অবস্থা, সংবাদ ব্যবসায়ীরাই বা পিছিয়ে থাকবেন কেনো? যারা শুধু মার্কেটে ‘খাবে ভালো' বিবেচনায় সংবাদ প্রকাশ করেন, তাদের সঙ্গে মাস্ক বিক্রেতাদের তেমন ফারাক দেখি না৷ ফলে ‘কী খায় চীনারা', ‘চীন থেকেই কেনো ভাইরাস ছড়ায়' ‘সবই কী ষড়যন্ত্র?' শিরোনামের তথ্য নাম না জানা পোর্টালে শোভা পাচ্ছে, ফাঁকফোঁকরে ঢুকে পড়ছে মূলধারার গণমাধ্যমেও৷
এই লেখা লিখতে গিয়ে বিশ্বে কী ঘটছে খুঁজতেই দেখলাম ভুয়া নিউজের বন্যায় ভাসছে পৃথিবী৷ কেমন সেসব নিউজ? পড়ুন:
* চীনারা নিয়মিত বাদুড় আর সাপ খায়, এজন্যই এখান থেকে সব ভাইরাস ছড়ায়৷ (অথচ ভাইরাস যেকোনো স্থান থেকেই ছড়াতে পারে৷ যেমন করোনা ভাইরাসের আরেক প্রজাতি মার্স ছড়িয়েছিল উট থেকে সৌদি আরবে৷)
* উইগুরদের ওপর নির্যাতনের গজব পড়েছে চীনের ওপর৷ (অথচ কদিন আগে বাংলাদেশে প্রতিদিন শত শত মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ায় আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছিল৷)
* চীন নিজেই ভাইরাস তৈরি করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক চাপ থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে সরাতে৷ (অথচ কদিন আগেই চীন আর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নতুন চুক্তি হয়েছে৷)
* চীনা সরকার জনসংখ্যা কমাতে এ ভাইরাস নিজেই ছড়িয়ে দিয়েছে৷ (এ নিয়ে কী বলবো খুঁজে পাচ্ছি না৷)
* চীন আসলে বায়োলজিক্যাল ওয়েপন অর্থাৎ জীবাণু অস্ত্র তৈরি করতে চাইছিল, দুর্ঘটনায় এটা ছড়িয়ে পড়েছে৷ (এতো বড় ঘটনা চীনের বৈশ্বিক শত্রু দেশগুলোর গোয়েন্দারাও জানতে পারলো না, জানলাম শুধু আমরা ফেসবুক গোয়েন্দারা৷)
শুধু ফেসবুক নয়, ইসলামোফোবিয়ার মতো করে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে সিনোফোবিয়া (চীনাবিদ্বেষ)৷ ইসলামবিদ্বেষের মতো এই নয়া জাতিবিদ্বেষ রুখতেও মূলধারার গণমাধ্যম ব্যর্থ৷
এতোকিছু দেখার পর আমার হতাশা কিছুটা কমেছে৷ যাক, ফেসবুকে যা দেখি বিশ্বাস করাটা তাহলে শুধু আমাদের ট্রেন্ড না৷ দুঃখবিলাস বলে একটা শব্দ অনেক আগে থেকেই বাংলায় চালু আছে৷ বাংলা একাডেমির সময় এসেছে ভয়বিলাস বা গুজববিলাস শব্দ অভিধানে অন্তর্ভুক্ত করার৷
আমরা ভয় পেতে ভালোবাসি৷ ফলে সংবাদমাধ্যমও ‘এতো ভয় পাওয়ার কিছু নেই' বলে পাঠক-দর্শক হারাতে চায় না৷ সবার জন্যই একটা উইন-উইন সিচুয়েশন৷ বাংলাদেশের রোগতত্ত্ব ইনস্টিটিউট- আইইডিসিআর যত বলছে চীনের উহান থেকে ফেরা বাংলাদেশিদের মধ্যে করোনা ভাইরাস পাওয়া যায়নি, তত সবাই সন্দেহ প্রকাশ করছেন করোনা শনাক্ত করার সক্ষমতা নিয়ে৷ সরকার কিছু একটা ‘লুকাতে চাচ্ছে' বলেও মনে করছেন কেউ কেউ৷
এদিকে, মালয়েশিয়ায় নভেল করোনা ভাইরাস নিয়ে মিথ্যা সংবাদ প্রকাশ করায় ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ জেনেশুনে মিথ্যা তথ্য ফেসবুকে ছড়ানোর অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এক সাংবাদিককেও৷ দেশটির কমিউনিকেশন ও মাল্টিমিডিয়া কমিশন এক বিবৃতিতে জনগণকে আহ্বান জানিয়েছে যেকোনো কিছু শেয়ার করার আগে সে তথ্য যেন যাচাই করে নেয়৷
এ ইস্যুতে মালয়েশিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল টান শ্রী টমি টমাসের বক্তব্য আমার খুবই মনে ধরেছে৷ দেশটির দ্য স্টার পত্রিকায় ছাপা হয়েছে তার এই বক্তব্য৷ তিনি বলেন, ‘‘বিশ্বজুড়ে করোনা ভাইরাস নিয়ে যে পরিমাণ মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হচ্ছে তাতে আকৃষ্ট হচ্ছেন মালয়েশিয়ানরাও৷ যেকোনো সমাজে যখন মহামারি ছড়ায় তখন স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের উচিত নিয়মিত সঠিক তথ্য সরবরাহ করা৷''
করোনা ভাইরাসের উৎসকে জড়িয়ে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে হেয় করার চেষ্টাকেও কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেছেন তিনি৷ বলেছেন, ‘‘ইন্টারনেটে করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে বিশেষ কোনো ধর্মের বা জাতির মানুষকে ছোট করার চেষ্টা কেবল নিন্দনীয়ই নয় একটি বহুজাতিক সমাজের জন্য ভয়াবহ ক্ষতিকর৷''
২০১৯ সালে বাংলাদেশে ৫ হাজার ৫১৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৮৫৫ জন নিহত হয়েছেন৷ জাতীয় ও আঞ্চলিক সংবাদপত্র এবং অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এই তথ্য জানায় বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি৷
আরেক বেসরকারি সংস্থা রোড সেফটি ফাউন্ডেশন জানিয়েছে শুধু এ বছরের জানুয়ারিতে ৩৪০টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন অন্তত ৪৪৫ জন৷
করোনা ভাইরাস আক্রান্ত হলেই মারা যাবেন, এমন কথা চিকিৎসকরাও বলছেন না৷ বরং অনেক আক্রান্তই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছেন৷ গুজব না ছড়িয়ে, ভয় না ছড়িয়ে, আসুন চিকিৎসকদের কথা শুনি৷ কী কী সাবধানতা অবলম্বন করলে শুধু করোনা নয়, যেকোনো রোগের সঙ্গে লড়াই করে স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন করা যাবে, সেদিকে লক্ষ্য দেই৷
২০১৬ সালে প্রকাশ করা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বলছে, ১৫ বছর ধরে পৃথিবীতে মানবমৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ হৃদরোগ৷ শুধু ২০১৬ সালেই নানা ধরনের হৃদরোগে মারা গেছেন দেড় কোটিরও বেশি মানুষ৷
তাই বলি, শান্ত থাকুন৷ গুজবে কান দিয়ে, বিদ্বেষ ছড়িয়ে আসুন কোমল হৃদয়ে আর চাপ না বাড়াই৷
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷