ভার্চুয়াল রিয়ালিটি শুধু ভিডিও গেম বা মনোরঞ্জনের জন্যই উপযুক্ত নয়, চিকিৎসার ক্ষেত্রেও এর গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োগের উদ্যোগ চলছে৷ অপারেশনের আগে অথবা সময় লাইভ থ্রিডি প্রতিচ্ছবির ভিত্তিতে সার্জেন আরও নিরাপদে কাজ করতে পারবেন৷
বিজ্ঞাপন
গত কয়েক বছরে ভার্চুয়াল রিয়ালিটি প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতি হয়েছে৷ এই প্রযুক্তি বিজ্ঞানীদের জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিচ্ছে৷ বিশেষ করে চিকিৎসাবিদ্যার ক্ষেত্রে এমনটা দেখা যাচ্ছে৷ জার্মানির ড্রেসডেন শহরে জাতীয় টিউমার রোগ গবেষণা কেন্দ্রের একদল বিশেষজ্ঞ এমন এক সফটওয়্যার তৈরি করেছেন, যার সাহায্যে ভার্চুয়াল রিয়ালিটির মাধ্যমে আরও ভালোভাবে রোগীর যকৃতের মধ্যে টিউমার দূর করার পরিকল্পনা করা যায়৷
এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত শল্যচিকিৎসক ড. ইয়ুর্গেন ভাইৎস বলেন, ‘‘অপারেশনের নিখুঁত পরিকল্পনা একটা বড় সমস্যা৷ ঠিক কী অপারেশন হবে, তা আগে থেকে জানা যায় না৷ অ্যানাটমি বা দেহতত্ত্ব সম্পর্কে জ্ঞানের ভিত্তিতে আমাকে টিউমার ও বেঁচে থাকার জন্য জরুরি রক্তনালীর অবস্থান জানতে হবে৷ সেইসঙ্গে জানতে হবে, কত পরিমাণ স্বাভাবিক লিভার টিস্যু আমি দূর করতে পারি৷ ভুললে চলবে না, রোগীর শরীরে যকৃতের যে অংশ থেকে যাবে, তা যেন তাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে৷ অতিরিক্ত টিস্যু দূর করলে রোগীর ক্ষতি হবে৷''
স্টেফানি স্পাইডেলের তৈরি সফটওয়্যার ভবিষ্যতে পরিকল্পনার সময়ই এই ঝুঁকি যতটা সম্ভব কম রাখতে সাহায্য করবে বলে আশা করা হচ্ছে৷ কারণ সার্জেন এক ভারচুয়াল মডেলের মধ্যেই নিপূণভাবে রোগীর যকৃৎ বিশ্লেষণ করতে পারবেন৷ ড. ইয়ুর্গেন ভাইৎস বলেন, ‘‘স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, যে এই রোগীর যকৃৎ রক্তনালীতে ভরা এবং হলুদ রংয়ের টিউমার মাঝামাঝি জায়গায় রয়েছে৷ এই রক্তনালী অবশ্যই অক্ষত রাখতে হবে৷ অতএব প্রত্যেক মিলিমিটার অংশের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে৷ টিউমারে পৌঁছতে মাত্র ২ মিলিমিটার জায়গা রয়েছে৷ সবকিছু ভালোভাবে দেখে আগে থেকে সব পরিকল্পনা করার এই ক্ষমতা সত্যি এই প্রণালীর বিশাল সুবিধা৷''
যকৃতের থ্রিডি ছবির পাশাপাশি এই ভার্চুয়াল স্পেসে সিটিস্ক্যানের প্রত্যেকটি স্তর ও রোগের ইতিহাসের মতো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও পাওয়া যায়৷ ভিআর সফটওয়্যার ডেভেলপার ইয়ুলিয়ানে স্পাইডেল বলেন, ‘‘বলতে গেলে এক ভার্চুয়াল হলোডেক পাওয়া যায়৷ এই স্পেসের মধ্যে নড়াচড়া করে প্রয়োজনমতো একাধিক তথ্য পাওয়া সম্ভব৷''
২০১৭ সালে বিজ্ঞানের জগতের নানা চমক
২০১৭ সালে বিজ্ঞানের জগতের কোন ঘটনাগুলি বিজ্ঞানীদের সবচেয়ে অনুপ্রাণিত করেছে? শনিগ্রহে ক্যাসিনি মহাকাশযানের অন্ত, নাকি নতুন এক্স-রে লেজারের উদ্বোধন, নাকি বনমানুষদের একটি তৃতীয় প্রজাতি? ছবিঘরে পাবেন তার কিছু উত্তর৷
ছবি: picture-alliance/dpa/C. Gateau
‘মার্চ ফর সায়েন্স’
২২শে এপ্রিল তারিখে সারা বিশ্বের ৬০০টি শহরে নাগরিকরা বিজ্ঞানের স্বাধীনতার জন্য মিছিল করেন৷ এই ‘মার্চ ফর সায়েন্স’-এর উদ্যোক্তা ছিলেন গবেষকরা স্বয়ং৷ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গবেষণায় রাষ্ট্রীয় অর্থানুকুল্যের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে চান, তারই বিরুদ্ধে ছিল এই বিক্ষোভ৷ জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ভিত্তি বৈজ্ঞানিক তথ্য হওয়া উচিত, বলে আন্দোলনকারীরা দাবি করেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Edelson
অতিকায় টেলিস্কোপ
মে মাসে চিলিতে একটি ‘এক্সট্রিমলি লার্জ টেলিস্কোপ’ নির্মাণ শুরু হয়৷ সেজন্য আটাকামা মরুভূমিতে ৩,০৬০ মিটার উঁচু সেরো আমাজোনেস পাহাড়ের চুড়া ডাইনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিতে হয়৷ সেই সমতলের উপর ৪০ মিটার ব্যাসের টেলিস্কোপটি বসানো হচ্ছে, যা হবে কিনা বিশ্বের বৃহত্তম টেলিস্কোপ৷ এই টেলিস্কোপ দিয়ে ২০২৪ সাল থেকে সুদূর জ্যোতির্পুঞ্জের গ্রহ পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হবে৷
ছবি: ESO/L. Calçada
হোমো সেপিয়েন্স-রা কতদিন ধরে পৃথিবীতে আছে?
মে মাসে নৃতত্ত্বের জগতে হুলুস্থুল৷ দেখা যাচ্ছে, ১৯৬১ সালে মরক্কোয় খুঁজে পাওয়া একটি মানুষের মাথার খুলির বয়স নাকি দু’লাখ নয়, তিন লাখ বছর! তার অর্থ, হোমো সেপিয়েন্স – আমরা যাদের বংশধর – তারা অনেক বেশিদিন ধরে ধরাধামে রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/MPI EVA Leipzig/Philipp Gunz
বৃহস্পতির ঘূর্ণি
জুলাই মাসে জুনো মহাকাশযান বৃহস্পতি গ্রহের যতো কাছ দিয়ে যায়, এর আগে কোনো মহাকাশযান তা করতে পারেনি৷ গ্যাসের গ্রহটির বিষুবরেখার কাছে যে একটি রহস্যময় লাল দাগ আছে – আসলে একটি ঘূর্ণি – তার ছবি পাঠায় জুনো৷ ঐ ঘূর্ণিতে গ্যাসের গতি ঘণ্টায় ৫০০ কিলোমিটারের বেশি৷ ঘূর্ণিটির ব্যাস ১৬,০০০ কিলোমিটার৷ তবে ঘূর্ণিটা নাকি কমে আসছে৷
‘ক্লাস্টার্ড রেগুলারলি ইন্টারস্পেস্ড শর্ট প্যালিনড্রমিক রিপিটস’-এর আদ্যক্ষর মিলিয়ে পদ্ধতিটির নাম সিআরআইএসপিআর/কাস-মেথড৷ বায়োকেমিস্ট্রির এই পদ্ধতিটি দিয়ে পরিকল্পিতভাবে ডিএনএ কাটা বা পরিবর্তন করা যায় (জেনোম এডিটিং)৷ ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে যুক্তরাষ্ট্রে এই পদ্ধতি ব্যবহার করে ভ্রুণের মধ্যে হৃদরোগের একটি জিন মেরামত করা সম্ভব হয় – যদিও মার্কিন আইনের কারণে তা সংশ্লিষ্ট মহিলার জরায়ুতে বসানো সম্ভব হয়নি৷
২১শে আগস্ট তারিখে উত্তর অ্যামেরিকার লক্ষ লক্ষ মানুষ একটি পূর্ণ সূর্যগ্রহণ দেখেন – যার বৈজ্ঞানিক মূল্য খুব বেশি না হলেও, সাধারণ মানুষের মধ্যে জ্যোতির্বিদ্যা ও নক্ষত্রলোক সম্পর্কে কৌতূহল সৃষ্টি করায় সূর্যগ্রহণের জুড়ি নেই৷
ছবি: Reuters/B. McDermid
বিশ্বের বৃহত্তম এক্স-রে লেজার কাজ শুরু করল
হামবুর্গের কাছে এই গবেষণাকেন্দ্রটি তৈরি করতে আট বছর সময় লেগেছে৷ ‘এক্স-রে ফ্রি-ইলেকশন লেজার’ বলতে বোঝায় একটি ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার লম্বা সুড়ঙ্গ, যার মধ্যে প্রতি সেকেন্ডে ২৭,০০০ এক্স-রে’র ঝলক সৃষ্টি করা হয়৷ এই পন্থায় গবেষকরা বিভিন্ন পদার্থ ও বায়োমলিকিউলের কাঠামো ও প্রতিক্রিয়া যাঁচ করতে পারেন৷ এক্সএফইএল তৈরি করতে ১২০ কোটি ইউরো খরচ হয়েছে৷
ছবি: European XFEL
ক্যাসিনি, বিদায়!
নাসার ক্যাসিনি স্পেস প্রোব বিশ বছর ধরে মহাশূন্যে ঘোরাফেরা করেছে৷ ২০০৪ সাল থেকে এই ২,১২৫ কিলোগ্রাম ওজনের মহাকাশযান শনিগ্রহের চারপাশে ঘুরছে৷ গত সেপ্টেম্বর মাসে ক্যাসিনিকে পরিকল্পিতভাবে শনিগ্রহের আবহাওয়ামণ্ডলে পুড়ে ছাই হতে দেওয়া হয়৷ সবশেষে ক্যাসিনি ২২ বার শনিগ্রহ ও তার চক্রগুলির ভিতর দিয়ে যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Nasa
মাধ্যাকর্ষণ তরঙ্গ শেষমেষ নোবেল পুরস্কার পেল!
মানে ঠিক মাধ্যাকর্ষণ তরঙ্গ নয়, তবে তার অস্তিত্বের প্রমাণ দেওয়ার জন্য ওয়াইস, থর্ন ও ব্যারিশ, এই তিন বিজ্ঞানী পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পেলেন ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে৷ এর কিছু পরেই বহুদূরের দু’টি নিউট্রন তারকার মধ্যে সংঘর্ষ থেকে আসা মাধ্যাকর্ষণ তরঙ্গ রেকর্ড করা সম্ভব হয় – শুধু তাই নয়, কোথায় সেই সংঘর্ষ ঘটেছে, তাও নির্ধারণ করা সম্ভব হয়৷
ছবি: picture-alliance/Photoshot/Shi Tiansheng
পোকামাকড় গেল কোথায়?
অক্টোবরের মাঝামাঝি একটি দীর্ঘমেয়াদি জরিপের ফলাফল বিজ্ঞানীদের সচকিত করে – শুধু বিজ্ঞানীদেরই নয়৷ জার্মানির বিভিন্ন স্থানে ২৭ বছর ধরে কীটপতঙ্গের পরিমাণ পরিমাপ করে দেখা গেছে যে, এই ২৭ বছরে প্রায় ৭৫ ভাগ পোকামাকড় উধাও হয়েছে! জরিপটি জার্মানি তথা ইউরোপের জন্য পুরোপুরি প্রতিনিধিত্বমূলক না হলেও, এই ফলাফল যে অশনি সংকেতের সামিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই৷
নভেম্বর মাসে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের গভীর জঙ্গলে ওরাংওটাং বা বনমানুষদের একটি তৃতীয় প্রজাতি আবিষ্কৃত হয় – যদিও সে প্রজাতির মাত্র ৮০০ নমুনা আজও বেঁচে আছে৷ তবে যে হারে অরণ্যনিধন চলেছে, তাতে মানুষের এই সদ্য আবিষ্কৃত সহোদররা ইতিমধ্যেই বিপন্ন বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে৷
চিকিৎসকরা গবেষণার ক্ষেত্রে এর মধ্যেই এই প্রণালী ব্যবহার করছেন৷ স্টেফানি স্পাইডেল তাঁর গবেষণাকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন৷ তিনি চান, সার্জেন যেন অপারেশন থিয়েটারেও হলোডেকে পরিকল্পিত অপারেশনের নাগাল পেতে পারেন৷ সে ক্ষেত্রে এক ‘বুদ্ধিমান' ন্যাভিগেশন সিস্টেমের সাহায্যে তিনি সরাসরি এবং নিরাপদে টিউমার দূর করতে পারবেন৷ অগমেন্টেড রিয়ালিটি চশমার সাহায্যে তিনি সেই কাজ করতে পারবেন৷ ইয়ুলিয়ানে স্পাইডেল বলেন, ‘‘এই চশমা অগমেন্টেড রিয়ালিটি দেখায়৷ অর্থাৎ চারিপাশের পরিবেশের পাশাপাশি টিউমার, ভাস্কুলার কাঠামো বা ইন্দ্রিয়ের অবস্থানের মতো গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও দেখা যায়৷ রোগীর শরীরে কার্যত উঁকি মারা যায়৷''
পুরোটাই লাইভ বা সঙ্গে সঙ্গে দেখা যায়৷ ভার্চুয়াল যকৃৎ যাতে সবসময়ে মূল যকৃতের হুবহু প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে, তা নিশ্চিত করতে ট্র্যাকার-সহ একটি স্টিরিও ক্যামেরা সর্বদা রোগী, সার্জেন ও তাঁর সরঞ্জামের অবস্থানের উপর নজর রাখে৷ ড. ইয়ুর্গেন ভাইৎস বলেন, ‘‘অপারেশনের সময় লাইভ ভিডিওর মতো শরীরের ভেতরের অংশ, রক্তনালী, টিউমারের অবস্থান দেখার সুযোগ সম্ভব করে তুলতে হবে৷ আমাদের এবং শরীরের অংশের নড়াচড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই ছবিও বদলে যাবে, অবস্থান নিয়ে কোনো ভুলত্রুটি থাকবে না৷ এটাই হলো স্বপ্ন৷''
এমন স্বপ্ন বাস্তব হতে আরও কিছুকাল সময় লাগবে৷ অপারেশন থিয়েটারে এই ন্যাভিগেশন সিস্টেম প্রয়োগ করতে ৫ থেকে ১০ বছর সময় লাগবে বলে ধারণা করা হচ্ছে৷ তবে ভারচুয়াল রিয়ালিটিরও প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা রয়েছে৷