জামায়াতে ইসলামীর আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ মামলার রায় হবে যে কোনো দিন৷ সোমবার ট্রাইব্যুনালে মামলার যুক্তি-তর্ক শেষ হয়েছে৷ বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে ট্রাইব্যুনাল মামলাটির রায় দেবে৷
বিজ্ঞাপন
২০১০ সালের ২৯শে জুন মতিউর রহমান নিজামীকে আলাদা একটি মামলায় গ্রেপ্তার করার পর, একই বছরের ২রা আগস্ট তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আবারো গ্রেপ্তার দেখানো হয়৷ তাঁর বিরুদ্ধে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, লুট, ধর্ষণ, উস্কানি ও সহায়তা, পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার মতো ১৬টি অভিযোগ রয়েছে৷ এ সব ঘটনায় অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে গত বছরের ২৮শে মে নিজামীর বিচার শুরু হয়৷ এই মামলায় আগে একবার যুক্তি-তর্ক শেষ হলেও বিচারক অবসরে যাওয়ায় নতুন করে আবারো যুক্তি-তর্কের সুযোগ দেয়া হয়৷
এই মামলার প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলি জানান, ‘‘তারা নিজামীর বিরুদ্ধে সব অভিযোগ প্রমাণে সক্ষম হয়েছেন৷ তাই তারা নিজামীর সর্বোচ্চ শাস্তি আশা করছেন৷'' অন্যদিকে নিজামীর আইনজীবী তাজুল ইসলাম দাবি করেন, ‘‘প্রসিকিউশন নিজামীর বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ এনেছে, তা ভিত্তিহীন ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত৷ প্রতিহিংসার কারণে তাঁর বিরুদ্ধে এ সব অভিযোগ আনা হয়েছে৷ আশা করি, এ সব অভিযোগ থেকে তিনি খালাস পাবেন৷''
নিজামীর বাড়ি পাবনার সাথিয়া এলাকায়৷ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক জানান, নিজামীর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো – একাত্তরের ডিসেম্বরে পাবনার বেড়া থানার বৃশালিকা গ্রাম ঘেরাও করে ৭০ জনকে গুলি করে হত্যা ও ৭২টি বাড়িতে আগুন দেয়া, ডেমরা ও বাউশগাড়ী গ্রামে ৪৫০ জনকে গুলি করে হত্যা, সাঁথিয়া উপজেলার করমচা গ্রামে মন্দিরের সামনে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাটের ঘটনা৷ এছাড়া বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গেও তিনি জড়িত ছিলেন৷
তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের আদেশে বলা হয়, ১৯৪৩ সালে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার মোহাম্মদপুর প্রামে জন্ম নেয়া নিজামী ১৯৬৩ সালে কামিল পাস করেন৷ জামায়াতের তখনকার ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের পূর্ব পাকিস্তান শাখার প্রধান হিসাবে একাত্তরে তিনি ছিলেন আলবদর বাহিনীরও প্রধান৷ আলবদর বাহিনী একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যায় নেতৃত্ব দেয়৷
নিজামীর বিরুদ্ধে রায়ের মধ্য দিয়ে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার দশম রায় হবে৷ এর আগের নয়টি মামলায় জামায়াতের সাবেক ও বর্তমান আটজন এবং বিএনপির দুই নেতাকে দণ্ড দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল৷
জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংগঠন জামায়েত ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করেছেন হাইকোর্ট৷ জামায়াত এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের ঘোষণা দিয়েছে৷ এদিকে দাবি উঠেছে, জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার৷ এই বিষয়ে আমাদের ছবিঘর৷
ছবি: Strdel/AFP/Getty Images
‘‘জামায়াত একটি সন্ত্রাসী দল’’
বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার (০১.০৮.১৩) বিকেলে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করেছেন হাইকোর্ট৷ বিচারপতি এম মোয়াজ্জেম হোসেন, ইনায়েতুর রহিম এবং কাজী রেজা-উল-হকের সমন্বয়ে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ তাদের রায়ে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করেন৷ রায়ে বলা হয়, ‘‘জামায়াতের গঠনতন্ত্র শুধু সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিকই নয়, জামায়াত একটি সন্ত্রাসী দল৷’’
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
২০০৯ সালের রিটের রায়
রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে কয়েকটি সংগঠন ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা হাইকোর্টে রিট করেন ২০০৯ সালে৷ রিটে জামায়াতের গঠনতন্ত্র সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে উল্লেখ করা হয়, জানান ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর৷ সেই রিটের প্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার রায় ঘোষণা করলেন আদালত৷
ছবি: Reuters
জামায়াতের প্রতিক্রিয়া
আদালতের রায়ের পর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এবং এই মামলার আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক জানান, রায়ের বিরুদ্ধে তারা আপিল করবেন৷ সেজন্য ইতিমধ্যে রায়ের কার্যকারিতার স্থগিতাদেশ চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করা হয়েছে৷
ছবি: Strdel/AFP/Getty Images
স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান
১৯৭১ সালে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর চূড়ান্ত স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশ৷ বার্তাসংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, ‘‘জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিল৷ তবে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সেদলের কিছু নেতার হত্যা, ধর্ষণ এবং নির্যাতনের মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে জামায়াত৷’’
ছবি: AP
ট্রাইব্যুনালে বিচার
জামায়াত যুদ্ধাপরাধের দায় অস্বীকার করলেও ২০১০ সালে গঠিত ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একের পর এক জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ প্রমাণ হচ্ছে৷ এই ছবিঘর তৈরির দিন (০১.০৮.১৩) অবধি ছয়জনের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করেছেন ট্রাইব্যুনাল৷ সর্বশেষ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফাঁসির রায় দেয়া হয়েছে৷
ছবি: Reuters
ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ২০১০ সালে ঢাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করে৷ তবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল বিএনপি মনে করে, সরকার বিরোধী দলকে দুর্বল করতে এই ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করেছে৷ আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এই ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক রয়েছে৷
ছবি: AP
জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি
এদিকে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের রায়ের পর দলটির রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি আরো জোরালো হয়েছে৷ অধ্যাপক মুনতাসির মামুন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানালেও সরকার এতটা সাহসী হবে বলে আশা করেন না৷ মুনতাসির মামুনের কথায়, ‘‘জামায়াত একটি যুদ্ধাপরাধী দল৷ ট্রাইব্যুনালের একাধিক রায়ে তা বলাও হয়েছে৷ তাই যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবেও জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা সম্ভব৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa
ব্লগারদের সতর্ক প্রতিক্রিয়া
বৃহস্পতিবার আদালত রায় ঘোষণার আগেই ফেসবুকে আরিফ জিবতেক লিখেছেন, ‘‘হাইকোর্টের রায়টা কিন্তু জামায়াত নিষিদ্ধ নিয়া মামলা না৷ মামলাটা হচ্ছে নির্বাচন কমিশনে জামায়াত আইনসিদ্ধভাবে নিবন্ধিত হয়েছে কিনা, সেটা নিয়ে বিবেচনা৷’’ এই ব্লগার লিখেছেন, ‘‘যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার চাই, নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন নিয়া আমার মাথাব্যথা নাই৷’’
ছবি: privat
এই দাবি নতুন নয়
পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৪১ সালে জামায়াত প্রতিষ্ঠার পর মোট তিনবার দলটি নিষিদ্ধ হয়েছে৷ ১৯৫৯ এবং ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানে এবং ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে৷ ১৯৭৯ সালের ২৫শে মে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো জামায়াত প্রকাশ্যে রাজনীতি করার সুযোগ পায়৷