‘‘মৃত্যুদণ্ডই হতে পারে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর একমাত্র শাস্তি৷ একাত্তরে তার নৃসংশতা যে কী ভয়াবহ ছিল, তা যারা দেখেছে শুধু তারাই জানে৷’’ ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপকালে কথাগুলো বলছিলেন মুক্তিযোদ্ধা জহির উদ্দিন আহমেদ জালাল৷
বিজ্ঞাপন
সবাই তাঁকে ‘বিচ্ছু জালাল' হিসেবে চেনেন৷ কমান্ডার খালেদ মোশাররফ মুক্তিযুদ্ধকালে তাঁকে এই উপাধি দিয়েছিলেন৷ নিজামীর মামলায় আদালতে যাঁরা সাক্ষী দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে জহির উদ্দিন অন্যতম৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি জানা, ‘‘চোখের সামনে এক হিন্দু নারীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করে ঐ নিজামী৷ ওই নারীর চিৎকার এখনো যেন কানে ভেসে আসে আমার৷ শুধু তাই নয়, আমাকে তেজগাঁওয়ের এমপি হোস্টেলের পেছনে ধরে নেয়ার পর, টেবিলের দু'দিকে বসে আমি আর নিজামী কথা বলছিলাম৷ আমার হাত ছিল টেবিলের উপর৷ এক পর্যায়ে একটি ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপ দিয়ে আমার একটি আঙুল কেটে ফেলে সে৷ এরপর রাইফেলের বাট দিয়ে মাথায় আঘাত করলে মুহূর্তে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই৷''
অপেক্ষার দীর্ঘ প্রহর শেষে জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার অপেক্ষমাণ রায় বুধবার ঘোষণা করা হচ্ছে৷ বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ১ মঙ্গলবার এই দিন ধার্য করেন৷ এই রায়ের মধ্য দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সময় ধরে চলা মামলাটির নিষ্পত্তি হবে৷ গত ২৪শে জুন এই মামলার অপেক্ষমাণ রায় ঘোষণার তারিখ ধার্য ছিল৷ কিন্তু ওই দিন কারা কর্তৃপক্ষ নিজামীকে হাজির না করে তিনি অসুস্থ বলে ট্রাইব্যুনালে প্রতিবেদন পাঠায়৷
ট্রাইব্যুনালে সবচেয়ে বেশি সময়, প্রায় আড়াই বছর ধরে চলা মামলা এটি৷ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ১-এ ২০১২ সালের ২৮শে মে নিজামীর বিরুদ্ধে ১৬টি অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এ মামলার বিচার শুরু হয়৷ সাক্ষ্যগ্রহণ ও যুক্তি উপস্থাপন শেষে গত বছরের ১৩ই নভেম্বর মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখা হয়৷ তবে রায় ঘোষণার আগেই, অর্থাৎ ৩১শে ডিসেম্বর অবসরে যান ট্রাইব্যুনাল ১-এর তত্কালীন চেয়ারম্যান বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীর৷ এর প্রায় দু'মাস পর বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমকে চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়ার পর, পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনাল ১ দ্বিতীয় দফায় মামলার সমাপনী যুক্তি শোনে৷ ২৪শে মার্চ মামলাটি দ্বিতীয় দফায় রায়ের জন্য অপেক্ষায় রাখা হয়৷ এর তিন মাস পর, গত ২৪শে জুন, মামলাটির রায় ঘোষণার তারিখ ধার্য ছিল৷
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে নিজামীর সর্বোচ্চ সাজা আশা করছে রাষ্ট্রপক্ষ৷ রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোখলেসুর রহমান বাদল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘নিজামীর বিরুদ্ধে গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগের মতো অভিযোগ রয়েছে৷ একাত্তরে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার দু'টি গ্রামের প্রায় সাড়ে ৪শ' মানুষকে হত্যা ও রাজধানীর নাখালপাড়ায় পুরাতন এমপি হোস্টেলে আটক মুক্তিযোদ্ধা রুমী, বদি, জালাল, সুরকার আলতাফ মাহমুদ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে নিজামীর সংশ্লিষ্টতা ছিল৷ এছাড়া মোহাম্মদপুরের শারীরিক শিক্ষা কলেজে স্থাপিত রাজাকার-আলবদরের ক্যাম্পে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের যে নীলনকশা বাস্তবায়িত হয়, তার সঙ্গে নিজামীর সম্পৃক্ততা ছিল৷ নিজামীর বিরুদ্ধে আনা সবকটি অভিযোগই আমরা সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি৷''
জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংগঠন জামায়েত ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করেছেন হাইকোর্ট৷ জামায়াত এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের ঘোষণা দিয়েছে৷ এদিকে দাবি উঠেছে, জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার৷ এই বিষয়ে আমাদের ছবিঘর৷
ছবি: Strdel/AFP/Getty Images
‘‘জামায়াত একটি সন্ত্রাসী দল’’
বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার (০১.০৮.১৩) বিকেলে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করেছেন হাইকোর্ট৷ বিচারপতি এম মোয়াজ্জেম হোসেন, ইনায়েতুর রহিম এবং কাজী রেজা-উল-হকের সমন্বয়ে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ তাদের রায়ে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করেন৷ রায়ে বলা হয়, ‘‘জামায়াতের গঠনতন্ত্র শুধু সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিকই নয়, জামায়াত একটি সন্ত্রাসী দল৷’’
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
২০০৯ সালের রিটের রায়
রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে কয়েকটি সংগঠন ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা হাইকোর্টে রিট করেন ২০০৯ সালে৷ রিটে জামায়াতের গঠনতন্ত্র সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে উল্লেখ করা হয়, জানান ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর৷ সেই রিটের প্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার রায় ঘোষণা করলেন আদালত৷
ছবি: Reuters
জামায়াতের প্রতিক্রিয়া
আদালতের রায়ের পর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এবং এই মামলার আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক জানান, রায়ের বিরুদ্ধে তারা আপিল করবেন৷ সেজন্য ইতিমধ্যে রায়ের কার্যকারিতার স্থগিতাদেশ চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করা হয়েছে৷
ছবি: Strdel/AFP/Getty Images
স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান
১৯৭১ সালে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর চূড়ান্ত স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশ৷ বার্তাসংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, ‘‘জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিল৷ তবে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সেদলের কিছু নেতার হত্যা, ধর্ষণ এবং নির্যাতনের মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে জামায়াত৷’’
ছবি: AP
ট্রাইব্যুনালে বিচার
জামায়াত যুদ্ধাপরাধের দায় অস্বীকার করলেও ২০১০ সালে গঠিত ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একের পর এক জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ প্রমাণ হচ্ছে৷ এই ছবিঘর তৈরির দিন (০১.০৮.১৩) অবধি ছয়জনের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করেছেন ট্রাইব্যুনাল৷ সর্বশেষ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফাঁসির রায় দেয়া হয়েছে৷
ছবি: Reuters
ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ২০১০ সালে ঢাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করে৷ তবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল বিএনপি মনে করে, সরকার বিরোধী দলকে দুর্বল করতে এই ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করেছে৷ আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এই ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক রয়েছে৷
ছবি: AP
জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি
এদিকে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের রায়ের পর দলটির রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি আরো জোরালো হয়েছে৷ অধ্যাপক মুনতাসির মামুন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানালেও সরকার এতটা সাহসী হবে বলে আশা করেন না৷ মুনতাসির মামুনের কথায়, ‘‘জামায়াত একটি যুদ্ধাপরাধী দল৷ ট্রাইব্যুনালের একাধিক রায়ে তা বলাও হয়েছে৷ তাই যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবেও জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা সম্ভব৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa
ব্লগারদের সতর্ক প্রতিক্রিয়া
বৃহস্পতিবার আদালত রায় ঘোষণার আগেই ফেসবুকে আরিফ জিবতেক লিখেছেন, ‘‘হাইকোর্টের রায়টা কিন্তু জামায়াত নিষিদ্ধ নিয়া মামলা না৷ মামলাটা হচ্ছে নির্বাচন কমিশনে জামায়াত আইনসিদ্ধভাবে নিবন্ধিত হয়েছে কিনা, সেটা নিয়ে বিবেচনা৷’’ এই ব্লগার লিখেছেন, ‘‘যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার চাই, নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন নিয়া আমার মাথাব্যথা নাই৷’’
ছবি: privat
এই দাবি নতুন নয়
পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৪১ সালে জামায়াত প্রতিষ্ঠার পর মোট তিনবার দলটি নিষিদ্ধ হয়েছে৷ ১৯৫৯ এবং ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানে এবং ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে৷ ১৯৭৯ সালের ২৫শে মে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো জামায়াত প্রকাশ্যে রাজনীতি করার সুযোগ পায়৷
তবে নিজামীর আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম বলেছেন, ‘‘কথায় কথায় মৃত্যুদণ্ড চাওয়াটা প্রসিকিউশনের ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে৷ আসলে নিজামী জামায়াতের আমির না হলে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই উঠতো না৷ নিজামীর বিরুদ্ধে আনিত একটি অভিযোগও প্রসিকিউশন সঠিকভাবে প্রমাণ করতে পারেনি৷'' তাই আদালত যদি সব কিছু বিবেচনা করে রায় দেন, তবে নিজামী বেকসুর খালাস পাবে বলেও দাবি করেন এই আইনজীবী৷
প্রসঙ্গত, ১৯৪৩ সালে পাবনার সাঁথিয়ার মোহাম্মদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণকারী নিজামী একাত্তরে নিখিল পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘের (জামায়াতের তত্কালীন ছাত্র সংগঠন, বর্তমানে ইসলামী ছাত্রশিবির) সভাপতি ছিলেন৷ ২০১০ সালের ২৯শে জুন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে করা মামলায় নিজামীকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ এরপর ২রা আগস্ট তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়৷ এর আগে গত ৩০শে জানুয়ারি চট্টগ্রামের আলোচিত ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায়ে নিজামীসহ ১৪ জনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছে আদালত৷