1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

নিজের স্বার্থ রক্ষা করতেই ভারত ‘নিরপেক্ষ’ নীতি নিয়েছে

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি গৌতম হোড়৷
গৌতম হোড়
৪ মার্চ ২০২২

রাশিয়া-ইউক্রেন নিয়ে সরু দড়ির উপর কূটনৈতিক ভারসাম্যের নীতি নিয়ে চলেছে ভারত৷ একটু বেহিসাবী হলেই পতন৷

গত ডিসেম্বরে নতুন দিল্লিতে পুটিনকে স্বাগত জানান মোদীছবি: Money Sharma/AFP/Getty Images

রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত নিয়ে ভারতের ঘোষিত নীতি হলো, তারা কোনোপক্ষেই নেই৷ প্রবল চাপ সত্ত্বেও অ্যামেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলির সঙ্গে হাত মিলিয়ে তারা রাশিয়ার বিরুদ্ধাচরণ ও পুরোপুরি ইউক্রেনের পাশে দাঁড়াবার নীতি নেয়নি৷ আবার ইউক্রেনকে আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়াকে খোলাখুলি সমর্থনও করেনি৷ তবে এখনো পর্যন্ত জাতিসংঘে রাশিয়ার বিরুদ্ধে একাধিকবার ভোটাভুটি হয়েছে৷ ভারত কোনো পক্ষকেই ভোট দেয়নি, বরং ভোটদান থেকে বিরত থেকেছে৷ এক্ষেত্রে ঘোষিত শত্রু চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে থেকেছে ভারত৷ চীন ও পাকিস্তানও রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভোটদানে বিরত থেকেছে৷ তবে ভারত যে কারণে এই নীতি নিয়েছে, তার সঙ্গে চীন ও পাকিস্তানের কারণকে এক করে দেখা ঠিক হবে না৷ খুব সাবধানে একটা কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করতে চাইছে ভারত৷

পশ্চিমা দেশগুলির কাছে ভারতের এই নীতি হলো, রাশিয়াকে পরোক্ষে সমর্থন করা৷ যেখান থেকে সরে আসার জন্য ভারতের উপর তারা চাপ কম দিচ্ছে না৷ কিন্তু এখনো পর্যন্ত সেই চাপে কাজ হয়নি৷ বরং বহুদিন পর একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংঘাতের ক্ষেত্রে ভারত নিজের স্বার্থের সঙ্গে মানানসই নীতি নিয়ে চলছে৷ 

বেশ কিছু বছর ধরে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি স্পষ্টভাবে অ্যামেরিকাপন্থি ছিল৷ সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের দশ বছর এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রথম ছয় বছরে ক্রমাগত অ্যামেরিকার কাছাকাছি এসেছে ভারত৷ তার প্রভাব ভারতের পররাষ্ট্র নীতির উপরেও পড়েছে৷ আগের তুলনায় অনেক বেশি অ্যামেরিকা-নির্ভর হয়ে পড়েছিল নতুন দিল্লি৷ মনমোহন সিং অ্যামেরিকার সঙ্গে পরমাণু-সমঝোতা করতে গিয়ে তাদের বিশ্বাসযোগ্য সহযোগী বামেদের সমর্থন হারিয়ে সরকারের বিপদ পর্যন্ত ডেকে এনেছিলেন৷

নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদীও পিছিয়ে ছিলেন না৷ 'বন্ধু’ ডনাল্ড ট্রাম্প যাতে মার্কিন প্রবাসী ভারতীয় মূলের মানুষদের ভোট পান, তার জন্য গুজরাটে 'নমস্তে ট্রাম্প’ নামক মেগা ইভেন্টের আয়োজন পর্যন্ত করেছিলেন৷ কিন্তু জো বাইডেন অ্যামেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে প্রধানমন্ত্রী মোদীর অনেক অঙ্কই বিগড়ে গেছে৷ ট্রাম্পের মতো বাইডেন বা ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস ভারতপন্থি নীতি নিয়ে চলছেন না৷ বরং তারা ভারতের অনেক বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন৷ এমনকি করোনার প্রবল আঘাতে যখন ভারত জর্জরিত, তখনো সাহায্য পাঠানোর ক্ষেত্রে তারা উদারহস্ত হননি৷ বরং অনেক দেরি করে সাহায্য পাঠিয়ে বাইডেন তার মনোভাবের কথা বুঝিয়ে দিয়েছেন৷ তারপর থেকে অ্যামেরিকার কাছ থেকে যে সাহায্য ও সমর্থন ভারত প্রত্যাশা করে, সেটা পায়নি৷

এর মধ্যে চীনের সঙ্গে লাদাখে ভারতের রক্তাক্ত সংঘর্ষ হয়েছে৷ চীন পুরোপুরি পাকিস্তানের সঙ্গে আছে৷ চীন-পাকিস্তান বন্ধুত্ব ভারতকে চিন্তায় রাখার পক্ষে যথেষ্ট৷ ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে ভারতকে কোণঠাসা করতে চাইছে চীন, এটা আর নতুন কোনো কথা নয়৷ আর চীনের সঙ্গে এই সংঘাতের ক্ষেত্রে অ্যামেরিকার কাছ থেকে প্রত্যাশিত সাহায্য ও সমর্থন ভারত পায়নি৷ ফলে তার একটা হতাশা আছে৷  ভারতের সামনে প্রশ্ন হলো, ভবিষ্যতে চীন বা পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘাতে তারা এই সাহায্য পাবে কি?

ফলে রাশিয়া-ইউক্রেন নিয়ে ভারতের অবস্থান বুঝতে গেলে এই প্রেক্ষাপট মনে রাখা জরুরি৷

কেন এই সিদ্ধান্ত?

একটা সময় ভারত বিদেশ থেকে যে অস্ত্র কিনত, তার ৭০ শতাংশ আসত সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পরে রাশিয়া থেকে৷ এখনো ভারতে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র আসে রাশিয়া থেকেই৷ কিছুদিন আগেই রাশিয়া থেকে এস ৪০০ মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম কিনছে ভারত৷ চীন ও পাকিস্তানের থেকে বিপদের কথা মাথায় রাখলে এই মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম ভারতের কাছে খুবই জরুরি৷ তাই অ্যামেরিকার নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকি মাথায় নিয়েই ভারত এই অস্ত্র কিনছে৷ কারণ, ভারত মনে করছে, তাদের স্বার্থের জন্য এই অস্ত্র খুবই জরুরি৷

তাছাড়া ভারত এখন পাইপলাইনের মাধ্যমে রাশিয়ার কাছ থেকে গ্যাস পেতে আগ্রহী৷ সাবেক পররাষ্ট্রসচিব শশাঙ্ক বলেছেন, তুর্কমেনিস্তান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান হয়ে ভারতে গ্যাস পাইপলাইন পুনর্জীবীত করা দরকার, যাতে সস্তায় ভারত গ্যাস পেতে পারে৷ ভারতের স্বার্থে এটা জরুরি৷

আদতে যে সমর্থন ও সাহায্য অ্যামেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলির কাছ থেকে পাওয়ার প্রত্যাশা ভারতীয় কূটনীতিকদের ছিল,  বাস্তবে তা পূরণ হয়নি৷ পুরোপুরি অ্যামেরিকাপন্থি নীতি নেয়ার পরেও নয়৷ বরং কিছুদিন আগে জাতিসংঘে যখন পাকিস্তান নিয়ে প্রস্তাব এসেছে, তখন রাশিয়াই তাতে ভেটো দিয়েছে৷ সোভিয়েত ইউনিয়ন ও রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের একটা ইতিহাস আছে৷ ঠান্ডা যুদ্ধের পুরো সময়টা রাশিয়া ভারতের পাশে থেকেছে৷ ৭১-এর যুদ্ধ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ের সময়ও তার অন্যথা হয়নি৷ পরে সোভিয়েতের পতনের পরেও রাশিয়ার সঙ্গে সেই সম্পর্ক আগের মতো না থাকলেও কখনোই বন্ধুত্বহীনতায় পরিণত হয়নি৷

এখন বিশ্বের সামনে তিনটি বড় শক্তি৷ অ্যামেরিকা, চীন এবং রাশিয়া৷ অ্যামেরিকার কাছ থেকে ভারতের প্রত্যাশাপূরণ হয়নি বা হচ্ছে না৷ বিশেষ করে বাইডেন জমানায়৷ চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের কথা সকলেরই জানা৷ এই অবস্থায় বাকি থাকছে শুধু রাশিয়া৷ ফলে এখন রাশিয়া-বিরোধী নীতি নিলে তো আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় ভারতের সাহারা বলতে কেউ থাকবে না৷ তাই এই ভারসাম্যের খেলায় নেমেছে ভারত৷

এমনিতে ভারত যে নীতি নিয়ে চলে, তাতে রাশিয়া যেভাবে ইউক্রেন আক্রমণ করেছে এবং যেভাবে লড়াই চলছে, সমানে ক্ষেপণাস্ত্র হানা হচ্ছে, বোমা ফেলা হচ্ছে, গোলায় বিধ্বস্ত হচ্ছে ইউক্রেনের শহরগুলি, তাতে ভারতের পক্ষে এর নিন্দা করাই স্বাভাবিক ছিল৷ কিন্তু ভারত এখনো পর্যন্ত রাশিয়ার নাম করে কোনোরকম নিন্দা করেনি৷ তারা রাশিয়ার পক্ষে বা বিপক্ষে কোনো মন্তব্যই করেনি৷ এর পাশাপাশি ইউক্রেনে ত্রাণসাহায্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী৷ অদূর ভবিষ্যতে এই নীতির পরিবর্তন হবে কি না, ভারত রাশিয়ার নিন্দা করবে কি না, নিরপেক্ষ অবস্থান, যা কিনা কার্যত রাশিয়ার দিকে হেলে থাকার নীতি, তার থেকে সরে এসে ইউক্রেনের পাশে থাকবে কি না, সেটা পরের প্রশ্ন, তবে আপাতত এবাবেই ভারসাম্যের খেলা চালিয়ে যাচ্ছে ভারত৷

সাবেক কূটনীতিকদের মত

কানোয়ালজিত সিবাল একসময় রাশিয়ায় ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিলেন৷ পরে তিনি পররাষ্ট্রসচিবও হন৷ লোকমতকে তিনি বলেছেন, অ্যামেরিকা ও ন্যাটোর নীতির জন্যই ইউক্রেন সংকট তৈরি হয়েছে৷ ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য করা মানে রাশিয়ার দোরগোড়ায় অ্যামেরিকার সেনার পৌঁছে যাওয়া৷ এটা তারা মেনে নিতে পারেনি৷ তার মতে, ভারত এই সংকটে কোনো ভূমিকা নিচ্ছে না৷ তার কোনো ভূমিকা নেয়ার নেই৷ সব গ্লোবাল এজেন্ডা এখন পশ্চিমা দেশগুলি তৈরি করে৷ তারা কেন একটা বিকল্প দৃষ্টিকোণ গ্রহণ করবে না?

গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলেছবি: privat

রাশিয়া, পাকিস্তান সহ বেশ কয়েকটি দেশে রষ্ট্রদূত ছিলেন জি পার্থসারথি৷ তিনি পিটিআইকে বলেছেন, ভারতকে এরকমই টাইটরোপ ওয়াক করতে হবে৷ একটা ভারসাম্যের নীতি নিয়ে চলতে হবে৷ এটা ভুলে গেলে চলবে না, অতীতে রাশিয়া বারবার ভারতকে সাহায্য করেছে৷ তারা ভারতের বন্ধু৷ আর অ্যামেরিকা ন্যাটোর মাধ্যমে রাশিয়াকে কোণঠাসা করতে গেছিল৷ তাই এই অবস্থা৷ পার্থসারথির মতে, ভারতের পক্ষে এই ভারসাম্যের নীতি নেয়াটা তাই জরুরি৷

আরেক অবসরপ্রাপ্ত ভারতীয় কূটনীতিক রাকেশ সুদও মনে করেন, রাশিয়া কয়েক দশক ধরে ভারতের

নির্ভরযোগ্য সঙ্গী৷ তাই ভারতের পক্ষে রাশিয়ার কাজের তীব্র সমালোচনা করাও সম্ভব নয়, আবার রাশিয়ার পাশে সোচ্চারে থাকাও সম্ভব নয়৷ তাছাড়া নীতিগতভাবে ভারত এই ধরনের একতরফা আগ্রাসন মেনে নেয় ন৷

তা সত্ত্বেও ভারত যে অ্যামেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলির সুরে সুর মিলিয়ে রাশিয়ার সমালোচনায় নামেনি৷ কারণ, ভারসাম্যের এই নীতি নিয়েই আপাতত ভারতের স্বার্থরক্ষা হচ্ছে৷ নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক কূটনীতিকের বক্তব্য, অ্যামেরিকা আগে এত বড় বড় কথা বলেছিল৷ দেখে মনে হচ্ছিল, রাশিয়া হামলা করলে তারা তা ঠেকাতে মাঠে নেমে পড়বে৷ কার্যকালে দেখা গেল, অ্যামেরিকা কিছু নিষেধাজ্ঞা জারি করা ছাড়া কিছুই করছে না৷ তাহলে তারা ইউক্রেনকে এতটা উসকানি দিয়ে গেল কেন? তারপর সংকটসময়ে তারা ইউক্রেনের জন্য কী করলো? চীনের সঙ্গে ভারতের সংঘাতের সময়ও মৌখিক আধা-সমর্থন ছাড়া অ্যামেরিকা কিছু করেনি৷ তুলনায় রাশিয়া অতীতে বহুবার ভারতের পাশে থেকেছে৷ তাই রাশিয়া-ইউক্রেন বিতর্কে প্রথম থেকে পুরোপুরি অ্যামেরিকার পাশে থেকে আম ও ছালা দুটোই বিসর্জন দিতে চায়নি ভারত৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ