বড়ই নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন৷ ক্ষমতায় আসার পর তাঁকে শুধু ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ব্রিটিশ সংসদে বিরোধী ও বিদ্রোহী পক্ষ এবং আদালত সামাল দিতে হচ্ছিল৷ টোরি দলের মধ্যে বিপুল সমর্থন পেয়ে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ায় অন্তত অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের আশঙ্কা ছিল না৷ এবার মন্ত্রিসভা ও সংসদীয় দলের মধ্যে তীব্র অসন্তোষের ফলে ঠিক সেটাই ঘটতে চলেছে বলে আশঙ্কা বাড়ছে৷ বুধবার দ্য টাইমস সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী চুক্তিহীন ব্রেক্সিট হলে মন্ত্রিসভা ও সংসদীয় দলের অনেক সদস্য পদত্যাগ করতে চলেছেন৷ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে দ্য টাইমস এই দাবি করেছে৷
দলের মধ্যে সত্যি এমন বিদ্রোহ ঘটলে বরিস জনসনের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খা বড় ধাক্কা খেতে পারে৷ প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী যে কোনো মূল্যে ৩১শে অক্টোবর ব্রেক্সিট কার্যকর করে আগাম নির্বাচনে বিপুল জনসমর্থনের আশায় রয়েছেন তিনি৷ কিন্তু দলের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ তাঁর সঙ্গ ত্যাগ করলে নির্বাচনে সাফল্য অনিশ্চিত হয়ে উঠবে৷ বিরোধীদের মধ্যে বেড়ে চলা ঐক্যও টোরি দলের জয়ের সম্ভাবনা কমিয়ে আনতে পারে৷
এদিকে আর মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে ব্রেক্সিট কার্যকর করার সম্ভাবনাও কমে চলেছে৷ মঙ্গলবার জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল-এর সঙ্গে টেলিফোনে আলোচনার পর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর দফতর শেষ মুহূর্তে বোঝাপড়ার আশা কার্যত ছেড়ে দিয়েছে৷ দফতরের এক কর্মকর্তা সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, ম্যার্কেল নাকি এমন উত্তর আয়ারল্যান্ড সম্পর্কে এমন দাবি করেছেন যা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়৷ ‘গোপন' এই সংলাপ সম্পর্কে জার্মান চ্যান্সেলরের দফতর এখনো মুখ খোলে নি৷ তবে জার্মান সংসদে পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির প্রধান নর্বাট ব়্যোটগেন এক টুইট বার্তায় স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, যে জার্মানির অবস্থানে কোনো রদবদল ঘটে নি৷ শুরু থেকেই জনসনের প্রস্তাবের ভিত্তিতে চুক্তির সম্ভাবনা অবাস্তব ছিল৷ তা সত্ত্বেও ইইউ সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে৷ এমন পরিস্থিতির জন্য অন্যদের দায়ী করা মোটেই ‘ফেয়ার প্লে' নয়৷
কূটনৈতিক শিষ্টাচারের তোয়াক্কা না করে ইইউ সরকারগুলির পরিষদের প্রধান ডোনাল্ড টুস্ক সরাসরি বরিস জনসনের তীব্র সমালোচনা করেছেন৷ এক টুইট বার্তায় তিনি জনসনের উদ্দেশ্যে দোষ চাপানোর ‘বোকা' খেলা ছেড়ে ব্রিটেন ও ইউরোপের স্বার্থে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেবার ডাক দিয়েছেন৷ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে তাঁর সরাসরি প্রশ্ন, ‘‘আপনি চুক্তি চান না, ব্রেক্সিটের সময়সীমা বাড়াতে চান না, ব্রেক্সিটের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে চান না, কী চান আপনি?''
ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রধান ডাভিড সাসোলি আরও এক ধাপ এগিয়ে বরিস জনসনের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন৷ মঙ্গলবার লন্ডনে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর তিনি বলেন, ৫ দিন আগে জনসন ইইউ মধ্যস্থতাকারী মিশেল বার্নিয়ে-র কাছে যে প্রস্তাব পেশ করেছেন তাঁর আইডিয়া যদি শুধু সেটুকুর মধ্যেই সীমিত হয়, তার অর্থ জনসন আদৌ কোনো চুক্তি চাইছেন না৷
এমন নেতিবাচক পরিবেশ সত্ত্বেও ব্রাসেলসে ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে জোরালো আলোচনা চলছে৷ আয়ারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী লিও ভারাদকরের সঙ্গে বরিস জনসনের টেলিফোন সংলাপের পর সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইমন কোভেনি শেষ মুহূর্তে বোঝাপড়া সম্পর্কে আশা প্রকাশ করেছেন৷
এলেমেলো চুল, ব্যতিক্রমী চাহনি আর ঝাজালো বক্তব্যের জন্য খ্যাতিমান নয়া ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন৷ সাংবাদিকতা ছেড়ে রাজনীতির মাঠে আসা জনসনের বেড়ে ওঠার গল্পও বিচিত্র রকম৷
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সাবেক কনজারভেটিভ সাংসদ স্ট্যানলি জনসন ও তার প্রথম স্ত্রী চিত্রকর শার্লট ফসেটের সন্তান আলেক্সান্ডার বরিস দে পিফেল জনসনের জন্ম ১৯৬৪ সালের জুনে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে৷ তাঁর দাদার বাবা আলি কামাল একজন তুর্কি৷ একারণে নিজেকে মুসলিম উত্তরাধিকারী হিসাবে বলে থাকেন জনসন৷
চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় জনসনের শৈশব কেটেছে নিউ ইয়র্ক, লন্ডন ও ব্রাসেলসে৷ কম শুনতেন তিনি৷ এ কারণে শৈশবেই তাকে বেশ কয়েকবার অপারেশনের টেবিলে যেতে হয়েছিল; জনসন সেসময় তুলনামূলক চুপচাপ ছিলেন বলে তার আত্মীয়স্বজন জানিয়েছেন৷
ছবি: Getty Images/D. Kitwoodকিংস স্কলারশিপ নিয়ে বার্কশায়ারের ইটন কলেজে পড়ার পর অক্সফোর্ডের বেলিওল কলেজ থেকে ল্যাটিন ও প্রাচীন গ্রীক ক্ল্যাসিকসে ডিগ্রি নেন জনসন। তিনি বিতর্ক সংগঠন অক্সফোর্ড ইউনিয়নেরও প্রেসিডেন্ট ছিলেন; ছিলেন বুলিনডং ক্লাবের সদস্য, যেখানে তার সঙ্গী ছিলেন ডেভিড ক্যামেরনও।
ছবি: Getty Images/L. Drayব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর জনসনের সাংবাদিকজীবন শুরু হয়। ১৯৮৭ সালে টাইমসে প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর একজনের উদ্ধৃতি জাল করায় চাকরি হারাতে হয় তাকে। ডেইলি টেলিগ্রাফে জনসন ইউরোপ বিষয়ক সংবাদদাতা ছিলেন ৫ বছর। পরে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিনি একই প্রতিষ্ঠানের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯-২০০৫ সাল পর্যন্ত ‘দ্য স্পেকটেটর’ ম্যগাজিনের সম্পাদক ছিলেন৷
ছবি: Getty Images/M. Cardyটেলিগ্রাফে থাকার সময় ১৯৯৭ সালে ক্লয়েড সাউথ এলাকা থেকে হাউস অব কমন্সে নির্বাচন করেন জনসন। এরপর ২০০১ সালেহেনলি অন টেমস আসনে বিজয়ী হন৷ সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে ২০০৭ ও ২০১২ সালে দুই মেয়াদে লন্ডনের মেয়র হন জনসন৷ ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোটের পর আসা প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন তিনি৷ এরপর ব্রেক্সিট নিয়ে বিরোধের জেরে পদত্যাগ করেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/PA Wire/J. Stillwellটেলিভিশন ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত হলেও জনসনের রাজনৈতিক উত্থান মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। স্পেকটেটরের একটি সম্পাদকীয় প্রকাশের জেরে তাকে লিভারপুল সিটির কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল; এক সাংবাদিকের সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জনে ছায়া শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকেও তাকে সরিয়ে দেয়া হয়।
ছবি: Imago Images/PA/I. Infantesযুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কিনা, তা নিয়ে গণভোটের প্রচারে জনসনকে দেখা যায় ‘ব্রেক্সিটপন্থিদের’ অন্যতম প্রভাবশালী মুখপাত্র হয়ে উঠতে। ২০১৬ সালের বেক্সিটের পক্ষে গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আসার পর তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভাবা হয়েছিল৷ কিন্তু মাইকেল গোভসহ ঘনিষ্ঠ অনেকে দূরে সরে যাওয়ায় সেবার ডাউনিং স্ট্রিট যাওয়া হয়নি জনসনের৷
ছবি: Reuters/P. Nichollsজনসন প্রথম ১৯৮৭ সালে অ্যালেগ্রা মস্টিন ওয়েনকে বিয়ে করলেও তাদের সংসার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৯৩ সালে জনসন আইনজীবী মেরিনা-হুইলারের (ছবিতে বামে) সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন। জনসন-হুইলার দম্পতির দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে৷ দুই যুগ পর গত বছর এই দম্পতি বিচ্ছেদ হয়৷ এখন তিনি বিয়ে না করেই বসবাস করছেন প্রায় ২৫ বছর কম বয়সি বান্ধবী ক্যারি সিমন্ডসের সঙ্গে৷
ছবি: picture-alliance/AP Images/D.L. Olivasপ্রবন্ধ সংকলন ‘লেন্ড মি ইউর ইয়ারস’ ছাড়াও জনসন উপন্যাস ‘সেভেন্টি টু ভার্জিনস’ ও রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে ‘দ্য ড্রিম অব রোম’ লিখেছেন। ২০১৪ সালে ঝুলিতে যুক্ত করেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে নিয়ে লেখা ‘দ্য চার্চিল ফ্যাক্টর: হাউ ওয়ান ম্যান মেইড হিস্টরি’ বইটিও।
ছবি: Getty Images/AFP/T. Akmenবাচনভঙ্গি, শব্দের ক্ষুরধার ব্যবহার, চাহনি, মজা করে কথা বলার অসামান্য ক্ষমতা, এলোমেলো চুল, ব্যক্তিগত জীবন- এসবের বিতর্কের কেন্দ্রে থাকেন বরিস জনসন৷ কিন্তু জনপ্রিয়তা কীভাবে অর্জন করতে হয়, তিনি সেটা অনেকের চেয়ে ভালো জানেন৷ যেমন, সর্বশেষ টোরি দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী পদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী জেরেমি হান্টের চেয়ে দ্বিগুণ ভোট পেয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/empics/B. Kendall এসবি/কেএম (রয়টার্স, ডিপিএ)