প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এক জরিপ চালিয়ে দেখেছে, সারা দেশে সাত হাজারেরও বেশি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আছে৷ কিন্তু এর মধ্যে সংরক্ষণ করা হয়েছে মাত্র ১৭৬টি আর সংরক্ষণের জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে মাত্র ৪৬২টি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন৷
বিজ্ঞাপন
এ সব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মধ্যে দু'টি আবার বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ৷ আরো পাঁচটি নিদর্শন বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ইউনেস্কোর তালিকাভূক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে৷ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. আতাউর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের মূল সংকট লোকবল৷ মাত্র ৪৩০ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারি নিয়ে কাজ করছি আমরা৷ তাই কোনো কোনো নিদর্শন রক্ষায় আমরা মাত্র একজন লোক নিয়োগ করেছি এমন উদাহরণও আছে অনেক৷ বাংলাদেশে এখন তালিভুক্ত যেসব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আছে তা সংরক্ষণেই কমপক্ষে পাঁচ হাজার কর্মকর্তা কর্মচারী প্রয়োজন৷''
আর মাটির নীচে যেসব নিদর্শন আছে সেগুলোর সম্পর্কে ধারণা করা যায়, কিন্তু প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণ প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ছাড়া সম্ভব নয়৷ লোকবল সংকটের কারণে অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এখনো চিহ্নিত করা যায়নি৷
প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে বাংলাদেশে প্রত্নতত্ত্বের সংক্ষিপ্ত বিবরণ আছে৷ তার ভূমিকায় বলা হয়েছে, ‘‘বাংলাদেশ অত্যন্ত গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যের অধিকারী৷ আড়াই হাজার বছরেরও বেশি সময়ে এ দেশে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী, শাসক শ্রেণি গড়ে তোলে অসংখ্য ইমারত, নগর , প্রাসাদ, দুর্গ, মন্দির, মসজিদ, বিহার স্তূপ ও সমাধি সৌধ৷ এ সব ঐতিহ্যের অধিকাংশই কালের গর্ভে বিলীন হলেও উল্লেখেযোগ্য সংখ্যক সংস্কৃতি চিহ্ন এ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আজো টিকে আছে, যা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে সমধিক পরিচিত৷''
এই ওয়েবসাইটে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় কয়েকটি পুরাকীর্তির নাম উল্লেখ করা হয়েছে – মহাস্থানগড়, ময়নামতি, পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার, সীতাকোট বিহার, কান্তজীর মন্দির, ছোট সোনা মসজিদ, ষাটগম্বুজ মসজিদ, ভাসুবিহার, বিহার ও বারবাজার, লালবাগ দুর্গ৷
DR Ataur Rahman - MP3-Stereo
বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মধ্যে বৌদ্ধ, মুসলিম এবং হিন্দু শাসনামলের পুরার্কীর্তিই প্রাধান্য বিস্তার করে আছে৷ তবে খননের অভাবে আরো অনেক নিদর্শন সম্পর্কে এখনো বিস্তারিত জানা যাচ্ছে না৷ তবুও অধিদপ্তর সীমিত অর্থ কাজে লাগিয়ে প্রতি বছরই খনন কাজ করছে৷ চলতি বছরেও খনন কাজ চলছে৷ প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে সুলতানী আমলের ৪২ গম্বুজ মসজিদ আবিষ্কার করা হয়েছে৷ নরসিংদির উয়ারী বটেশ্বরে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে দু'টি অতি প্রাচীন গ্রাম আবিষ্কারের ঘটনা বাংলদেশে বেশ আলোচিত৷ দু'টি গ্রামেই খননের পরে প্রায় দুই হাজার বছর আগের স্থাপনা ও প্রত্নসম্পদ পাওয়া গেছে৷ যার মধ্যে রয়েছে ছাপযুক্ত মুদ্রা, মূল্যবান পাথরের গুটিকা, পুঁতি, লোহার তৈরি হাতকুড়াল ইত্যাদি৷
বিশ্ব ঐতিহ্য
বাংলাদেশের যে দু'টি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ সে দু'টি পুরার্কীর্তি হলো পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার এবং বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ৷
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের দেয়া তথ্য মতে, পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার পাল বংশের দ্বিতীয় রাজা শ্রী ধর্মপালদেব অষ্টম শতকের শেষের দিকে বা নবম শতকে এই বিহার তৈরি করছিলেন৷ ১৮৭৯ সালে স্যার কানিংহাম এই কীর্তি আবিষ্কার করেন৷ ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মর্যাদা দেয়৷ পাহাড়পুর পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বৌদ্ধবিহার৷ আয়তনে এর সাথে ভারতের নালন্দা মহাবিহারের তুলনা হতে পারে৷ এটি ৩০০ বছর ধরে বৌদ্ধদের ধর্মচর্চার কেন্দ্র ছিল৷ শুধু উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকেই নয়, চীন, তিব্বত, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ আরো অনেক দেশের বৌদ্ধরা এখানে ধর্মচর্চা ও ধর্মজ্ঞান অর্জন করতে আসতেন৷ খ্রিষ্ট্রীয় দশম শতকে বিহারের আচার্য ছিলেন অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান৷
কেমন আছে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো
ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে আছে বেশ কিছু ঐতিহাসিক স্থাপনা৷ তবে বেশিরভাগ স্থাপনাই যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে৷ আর যেগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে, সেগুলো নিয়েও আছে বিস্তর অভিযোগ৷
ছবি: DW/M. Mamun
রূপলাল হাউস
ঊনিশ শতকের গোড়ার দিকে বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে তৈরি হওয়া সুরম্য এই অট্টালিকাটি এখন খুঁজে পাওয়াই কষ্টকর৷ পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীদের দখলে যাবার পর রূপলাল হাউস ধ্বংসের গোড়ায় পৌঁছেছে৷ ফরাশগঞ্জের স্বরূপ চন্দ্রের দুই পুত্র রূপলাল দাস এবং রঘুনাথ দাস ১৮৪০ সালে এক আর্মেনীয় ব্যবসায়ীর কাছ থেকে পুরোনো একটি ভবন কেনেন৷ পরে কলকাতার স্থপতি নিয়োগ করে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে রূপলাল হাউসের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেন তাঁরা৷
ছবি: DW/M. Mamun
আহসান মঞ্জিল
পুরান ঢাকার আরেক ঐতিহাসিক স্থাপনা আহসান মঞ্জিলকে এখন বুড়িগঙ্গা থেকে দেখাই যায় না৷ এর সামনে বসে ফলের বাজার৷ সম্মুখভাগে তাই টিনের বেড়া দিয়ে দেয়া হয়েছে৷ ১৮৩০ সালে ঢাকার নবাব খাজা আলিমুল্লাহ ফরাসিদের কাছে থেকে পুরনো একটি ভবন কিনে নেন৷ ১৮৭২ সালে নবাব আব্দুল গণি এটিকে নতুন করে নির্মাণ করে তাঁর ছেলে খাজা আহসান উল্লাহর নামে এর নামকরণ করেন৷
ছবি: DW/M. Mamun
বড় কাটরা
পুরান ঢাকার চকবাজারে মুঘল আমলের গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থাপনাও সংরক্ষণের অভাবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে৷ সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজার নির্দেশে ১৬৪১ খ্রিষ্টাব্দে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে এই ইমারতটি নির্মাণ করা হয়৷ বর্তমানে একটি মাদ্রাসা হয়েছে৷ বেশ কিছু ব্যবসায়ী এ ভবনটি দখল করে আছে৷ স্থাপত্য সৌন্দর্যের বিবেচনায় একসময়ে বড় কাটরার সুনাম থাকলেও বর্তমানে এর ফটকটি যেন ভগ্নাবশেষ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
ছোট কাটরা
ঢাকার চকবাজারে বড় কাটরার কাছেই আরেক ঐতিহাসিক স্থাপনা ছোট কাটারা৷ শায়েস্তা খানের আমলে আনুমানিক ১৬৬৩ থেকে ১৬৬৪ সালের দিকে এই ইমারতটির নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং তা শেষ হয় ১৬৭১ সালে৷ দেখতে অনেকটা বড় কাটরার মতো হলেও এটি আকৃতিতে বড় কাটরার চেয়ে ছোট এবং এ কারণেই হয়তো এর নাম হয়েছিল ছোট কাটরা৷ সংরক্ষণের অভাবে বর্তমানে মুঘল আমলের এ স্থাপনাটিও ধ্বংসপ্রায়৷
ছবি: DW/M. Mamun
হাজী শাহবাজ মসজিদ
ঢাকার রমনা এলাকায় হাইকোর্টের পিছনে হাজী শাহবাজ মসজিদ সরকার ঘোষিত সংরক্ষিত পুরাকীর্তি৷ কিন্তু এর পেছনের অংশে আলাদা লোহার ফ্রেম বসানো হয়েছে ছাউনি দেওয়ার জন্য৷ যার ফলে স্থাপনাটির সৌন্দর্য হানি হয়েছে৷ মুঘল শাসনামলে শাহজাদা আযমের সময়কালে ১৬৭৯ খ্রিষ্টাব্দে এ মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন কাশ্মীর থেকে বাংলায় আসা ধনাঢ্য ব্যবসায়ী হাজী শাহবাজ৷
ছবি: DW/M. Mamun
গোয়ালদী শাহী মসজিদ
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে গোয়ালদী শাহী মসজিদের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণার পিলারটি ভবন থেকে খেসে পড়ার উপক্রম হলেও দীর্ঘ দিন চোখ পড়েনি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের৷ সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহের আমলে মোল্লা হিজাবর খান ১৫১৯ খ্রিষ্টাব্দে নির্মাণ করেছিলেন এক গম্বুজ বিশিষ্ট এ মসজিদটি৷
ছবি: DW/M. Mamun
পানাম নগর
নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁওয়ে অবস্থিত প্রাচীন বাংলার রাজধানী ঐতিহাসিক পানাম নগর৷ ১৫ শতকে ঈসা খাঁ বাংলার প্রথম রাজধানী স্থাপন করেছিলেন এই সোনারগাঁওয়ে৷ প্রায় ৫ মিটার চওড়া এবং ৬০০ মিটার দীর্ঘ একটি সড়কের দু’পাশে সুরম্য ৫২টি বাড়ি প্রাচীন এই নগরের অন্যতম আকর্ষণ৷ কিন্তু সঠিক সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ না করায় ঐতিহাসিক এ শহরটি ধ্বংস হতে চলছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
ষাট গম্বুজের মসজিদ
ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য স্থাপনা বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদের অভ্যন্তরের পাথরের তৈরি পিলারগুলো ১৯৯৮ থেকে ২০০২ সালের এক সংস্কার কাজের সময় সুরক্ষার কথা বলে পলেস্তারার প্রলেপে ঢেকে দেয়া হয়েছিল৷ তবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের বোধোদয় হওয়ায় সাম্প্রতিক সংস্কারের সময়ে পিলারগুলোর পাথরের উপর থেকে পলেস্তারা তুলে ফেলা হয়েছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
অযোধ্যার মঠ
বাগেরহাটের যাত্রাপুরে সরকার ঘোষিত সংরক্ষিত পুরাকীর্তি ‘অযোধ্যার মঠ’ কিংবা ‘কোদলা মঠ’৷ মঠের গায়ে গজিয়ে ওঠা বড় বড় পরগাছাগুলোই সংরক্ষিত এ পুরাকীর্তিটির প্রতি সরকারের অবহেলার বড় প্রমাণ৷
ছবি: DW/M. Mamun
চুনাখোলা মসজিদ
বাগেরহাটের বিশ্ব ঐতিহ্য স্থাপনার অংশ চুনাখোলা মসজিদের দেয়ালের ইট খসে পড়ার উপক্রম, দরজা-জানালার গ্রিলও মরিচা ধরে খুলে পড়েছে৷ দীর্ঘদিন সংরক্ষণের ছোঁয়া লাগেনি প্রাচীন এ স্থাপনাটিতে৷
ছবি: DW/M. Mamun
গোকুল মেধ
বগুড়ার মহাস্থানগড়ের কাছে ঐতিহাসিক ‘গোকুল মেধ’৷ বেহুলার বাসরঘর নামেও এটি পরিচিত৷ বাতি ঝুলানোর জন্য ঐতিহাসিক এ প্রত্নস্থলটির চারপাশ ঘেঁষে বাঁশ বসানো হয়েছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
বড় বাড়ি
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার হরিপুর গ্রামে তিতাস নদীর তীরে জমিদার কৃষ্ণপ্রসাদ রায় চৌধুরীর সুরম্য প্রাসাদ বড়বাড়িতেও সংস্কারের হাত পড়েনি কখনো৷ ফলে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় এ বাড়িটি দখল করে আছে ৪০টিরও বেশি পরিবার৷
ছবি: DW/M. Mamun
চার আনি জমিদার বাড়ি
কোনো রকম সংরক্ষণ না করায় প্রায় ধ্বংসই হয়ে গেছে নাটোরের পুঠিয়ার চার আনি জমিদার বাড়ি৷ পুঠিয়া রাজবাড়ীর শ্যাম সরোবরের দক্ষিণ পাশের এ চার আনি জমিদার বাড়ি ছাড়াও চার আনি কাছারি বাড়িও ধ্বংসের শেষ প্রান্তে৷
ছবি: DW/M. Mamun
বড় সর্দার বাড়ি
ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর ধ্বংসের মহোৎসবের মাঝেও দু-একটি স্থাপনা খুব ভালোভাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে৷ যেমন ধুরণ সোনারগাঁওয়ের ঐতিহাসিক বড় সর্দার বাড়ি৷ অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে এ বাড়িটি সংস্কার করে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে৷ কোরীয় বহুজাতিক কোম্পানি ইয়ংওয়ান কর্পোরেশনের প্রায় দুই মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সহায়তায় করা হয়েছে এ সংস্কার কাজ৷
ছবি: DW/M. Mamun
এবং প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সাইনবোর্ড
বাংলাদেশের যে কোনো সংরক্ষিত পুরাকীর্তি যারা দেখেছেন, এই সাইনবোর্ডটি তাঁদের কাছে বেশ পরিচিত৷ মূল্যবান এই পুরাকীর্তিটি নষ্ট বা ধ্বংস করলে কী শাস্তি হতে পারে তা লিপিবদ্ধ আছে এখানে৷ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এ সাইনবোর্ডটি বসিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ করেছে৷ প্রতিটি স্থাপনাতেই সংরক্ষণে অবহেলার ছাপ চোখে পড়ে সহজেই৷
ছবি: DW/M. Mamun
15 ছবি1 | 15
উলঘ খান-ই-জাহান ১৫ শতকের দিকে বাগেরহাটে ষাটগম্বুজ মসজিদ নির্মাণ করেন৷ এই প্রত্নস্থানটি ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্র হিসেবে অন্তর্ভূক্ত হয়৷ ওই এলাকায় বেশ কিছু মসজিদ, স্থাপনা, সমাধি, পুকুর ও ঢিবি পাওয়া গেছে৷ ষাটগম্বুজ মসজিদ এদের মধ্যে অন্যতম৷ মসজিদটিতে ৮১টি গম্বুজ রয়েছে৷ মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণে বাইরের দিকে প্রায় ১৬০ ফুট ও ভিতরের দিকে প্রায় ১৪৩ ফুট লম্বা এবং পূর্ব-পশ্চিমে বাইরের দিকে প্রায় ১০৪ ফুট ও ভিতরের দিকে প্রায় ৮৮ ফুট চওড়া৷ দেয়ালগুলো ৮.৫ ফুট পুরু৷ জনশ্রুতি আছে, হযরত খানজাহান (র.) ষাটগম্বুজ মসজিদ নির্মাণের সব পাথর সুদূর চট্টগ্রাম, মতান্তরে ভারতের উড়িষ্যার রাজমহল থেকে তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা বলে জলপথে ভাসিয়ে এনেছিলেন৷
ইমারতটির গঠন বৈচিত্রে তুঘলক স্থাপত্যের বিশেষ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়৷ এ বিশাল মসজিদের চারদিকে প্রাচীর ৮ ফুট চওড়া, এর চার কোণে চারটি মিনার আছে৷ দক্ষিণ দিকের মিনারের শীর্ষে কুঠিরের নাম ‘রোশনাই কুঠির' এবং এ মিনারে উপরে ওঠার সিঁড়ি আছে৷ মসজিদটি ছোট ইট দিয়ে তৈরি৷ এর দৈর্ঘ্য ১৬০ ফুট, প্রস্থ ১০৮ ফুট, উচ্চতা ২২ফুট৷ মসজিদের সামনের দিকের মাঝখানে একটি বড় খিলান এবং তার দুই পাশে পাঁচটি করে ছোট খিলান আছে৷ মসজিদের পশ্চিম দিকে প্রধান মেহরাবের পাশে একটি দরজাসহ মোট ২৬টি দরজা আছে৷
এছাড়া মাহাস্থানগড়, লালমাই ময়নামতি গ্রুপ অফ মনুমেন্টস, লালবাগ দুর্গ, হলুদ বিহার ও জগদ্দল বিহারকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ করার জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে৷
ড. আতাউর রহমান বলেন, ‘‘এই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের প্রত্যেকটিই বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হওয়ার যোগ্য৷ মধ্যযুগের মহাস্থানগড়ে আমরা আড়াই হাজার বছর আগের লিখিত দলিল পাচ্ছি৷ ব্রাহ্মীলিপির নিদর্শন এখানে রয়েছে৷''
‘মহাস্থান' শব্দের আভিধানিক অর্থ বিখ্যাত স্থান৷ কেউ কেউ মনে করেন যে, স্থানটির আসল নাম ‘মহাস্নান' বিখ্যাত স্থানের জায়গা৷ প্রাচীন পুন্ড্রনগর আজ মহাস্থানগড়ের ভূ-গর্ভে প্রোথিত৷ এ স্থান বাংলাদেশের সর্বপ্রাচীন নগরীর ধ্বংসাবশেষ৷ প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য থেকে জানা যায় যে, খ্রিষ্টপূর্ব ৪র্থ শতক থেকে খ্রীষ্টিয় ১৫শ' শতকের মধ্যে এই নগর এক সমৃদ্ধশালী জনপদ হিসেবে গড়ে উঠেছিল৷ করতোয়া নদীর পশ্চিম তীরের এই প্রাচীন নগরের ধ্বংসাবশেষ বর্তমান বগুড়া জেলার এক গৌরবোজ্জ্বল কীর্তি৷
Sufi Mostafizur Rahman - MP3-Stereo
বিশ্ব ঐতিহ্যের আরেক নিদর্শন ঢাকার লালবাগ কেল্লার নাম ছিল কেল্লা আওরঙ্গবাদ৷ এই কেল্লার নকশা করেন শাহ আজম৷ মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের তৃতীয় পুত্র আজম শাহ ১৬৭৮ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকার সুবেদারের বাসস্থান হিসেবে এ দুর্গের নির্মাণ কাজ শুরু করেন৷ ১৬৮৮ সালে শায়েস্তা খাঁ অবসর নিয়ে আগ্রা চলে যাবার সময় দুর্গের মালিকানা উত্তরাধিকারীদের দান করে যান৷ ১৯১০ সালে লালবাগ দুর্গকে প্রাচীন সংরক্ষিত স্থাপত্য হিসেবে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনে আনা হয়৷ নির্মাণের ৩০০ বছর পর গত শতকের আশির দশকে লালবাগ দুর্গের যথাসম্ভব সংস্কার করে এর আগের রূপ ফিরিয়ে আনা হয়৷
বাংলাদেশের জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্নতত্ত্ব একটি বিষয় হিসেবে পড়ানো হয়৷ এই বিভাগের অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বেই ২০০০ সালে উয়ারি বটেশ্বরের খনন কাজ শুরু হয়৷ এখনো চলছে৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের জন্য খনন কাজ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷ বাংলাদেশে যে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজ হয় তা অনেকাংশেই বৈজ্ঞানিকভাবে হয় না৷ আর এ কাজের জন্য দক্ষ এবং বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের লোকবলও আমাদের নেই৷''
তিনি জানান, ‘‘বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নিয়ে গ্রহণযোগ্য কোনো জরিপ এখনো হয়নি৷ তবে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হওয়ার যোগ্য অনেক নিদর্শন আমাদের আছে৷ ময়নামতি, পাহাড়পুর, উয়ারি বটেশ্বর এর মধ্যে অন্যতম৷ আর পাহাড়পুর এবং ষাটগম্বুজ মসজিদ এরইমধ্যে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ৷ আরো অনেক নিদর্শন আছে যা আমরা বিশ্বকে দেখাতে পারি, জানাতে পারি, কিন্তু দুঃখের বিষয় বাংলাদেশে একটি মনুমেন্টও বৈজ্ঞানিক উপায়ে সংরক্ষণ করা হয়নি৷ শুধু আমরা উয়ারি বটেশ্বরে লোটাস ট্যাম্পেলকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে সংরক্ষণ করছি৷''
অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. আতাউর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এর জন্য প্রচুর অর্থ প্রয়োজন৷ পুরাকীর্তি সংস্কার ও সংরক্ষণের কাজ ব্যয়বহুল৷ তবুও আমরা আমাদের সাধ্যের মধ্যে চেষ্টা করছি৷ তবে সেটা কোনোভাবেই সন্তোষজনক তা আমি বলবো না৷''
মসজিদের শহর বাগেরহাটের বিশ্ব ঐতিহ্য
খুলনার প্রচীন মসজিদের শহর বাগেরহাটের নাম ছিল খলিফাতাবাদ৷ শহরটির প্রতিষ্ঠাতা খান-ই-জাহান ছিলেন এক সাধক পুরুষ৷ ষাট গম্বুজ মসজিদসহ এখানকার নানা প্রাচীন স্থাপনা ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পায় ১৯৮৫ সালে৷
ছবি: DW/M. Mamun
নির্মাণ কাল ১৪৫৯
খান জাহান আলীর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য কীর্তি ষাট গম্বুজ মসজিদ৷ ঐতিহাসিকদের মতে, এই ষাট গম্বুজ মসজিদটি তিনি নির্মাণ করেছিলেন ১৪৫৯ খ্রিষ্টাব্দেরও কিছু আগে৷
ছবি: DW/M. Mamun
একাশিটি গম্বুজ
নাম ষাট গম্বুজ হলেও মসজিদটিতে মূলত একাশিটি গম্বুজ আছে৷ মসজিদের ছাদে ৭৭টি এবং চারকোণার টাওয়ারে চারটি৷ তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, মসজিদের অভ্যন্তরে ষাটটি স্তম্ভ থাকার কারণে এর নাম হয়ত ষাট গম্বুজ৷
ছবি: DW/M. Mamun
অভ্যন্তর ভাগ
ষাট গম্বুজ মসজিদের ভেতরের অংশ৷ এই অংশ অতীতে চুন-শুরকির মিশ্রণে লাল রঙের হলেও, পরবর্তীতে তা পলেস্তরা আরা সাদা রঙের প্রলেপে ঢাকা হয়েছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
ঢেকে ফেলা হয়েছে কালো পাথর
ষাট গম্বুজ মসজিদের ভেতরের স্তম্ভগুলো ছিল মূলত কালো পাথরের তৈরি৷ উত্তর দিকের একটি স্তম্ভ খালি দর্শনার্থীদের দেখার জন্য রেখে বাকি স্তম্ভগুলোর মূল্যবান কালো পাথর ঢেকে ফেলা হয়েছে সিমেন্টের পলেস্তারার প্রলেপে৷ বাংলাদেশের অনেক প্রাচীন স্থাপনাই এরকম অদক্ষ সংস্কারের নামে ধ্বংস করেছে খোদ সরকারেরই প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর!
ছবি: DW/M. Mamun
সিংড়া মসজিদ
ষাট গম্বুজ মসজিদের দক্ষিণ পাশে সুন্দরঘোনা গ্রামে অবস্থিত প্রাচীন স্থাপনা সিংড়া মসজিদ৷ইট নির্মিত মসজিদের প্রাচীরগুলি প্রায় সাত ফুট প্রশ্বস্ত৷ মসজিদের পূর্ব দেয়ালে আছে তিনটি প্রবেশপথ৷ প্রবেশপথ বরাবর পশ্চিম দেয়ালে রয়েছে তিনটি অলংকৃত মিহরাব৷ তবে কেন্দ্রীয় মিহরাবটি অপেক্ষাকৃত বড় এবং সুসজ্জিত৷ এর নির্মাণ শৈলী বিবেচনা করে ঐতিহাসিকরা মনে করেন, সিংড়া মসজিদের নির্মাণকাল পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি৷
ছবি: DW/M. Mamun
হযরত খানজাহান আলীর সমাধিসৌধ
ষাট গম্বুজ মসজিদ থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে এক গম্বুজ বিশিষ্ট হযরত খানজাহান আলীর সমাধিসৌধ৷ কথিত আছে, হযরত খান জাহান আলী বাগেরহাটে এসেছিলেন ১৩৯৮ খ্রিষ্টাব্দের পরে৷ তিনি প্রথমে দিল্লির সুলতান এবং পরে বাংলার সুলতানের কাছ থেকে সুন্দরবন অঞ্চলের জায়গির লাভ করেন৷ এখানকার গভীর বন কেটে তিনি মুসলিম বসতি গড়ে তোলেন৷ ১৪৫৯ খ্রিষ্টাব্দের ২২ অক্টোবর খান জাহান আলীর মৃত্যু হলে, এখানেই তাঁকে সমাহিত করা হয়৷
ছবি: DW/M. Mamun
জিন্দাপীর মসজিদ
হযরত খানজাহান আলীর সমাধির পশ্চিম দিকে ঠাকুর দিঘির পশ্চিম পাড়ে সুন্দরঘোনা গ্রামে ইট নির্মিত এক গম্বুজ বিশিষ্ট জিন্দাপীর মসজিদ৷ মসজিদের পাশেই হযরত খানজাহানের অনুসারী জিন্দাপীরের সমাধি৷ তাঁর নামেই এ মসজিদের নামকরণ৷
ছবি: DW/M. Mamun
নয় গম্বুজ মসজিদ
খান জাহান আলীর সমাধির দক্ষিণ-পূর্ব দিকে, ঠাকুর দিঘীর পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত নয় গম্বুজ মসজিদ৷ ইটের তৈরি এ মসজিদের উপরে নয়টি গম্বুজ রয়েছে৷ পুরো মসজিদের গায়ে পোড়ামাটির কারুকাজ খচিত৷ মসজিদের ছাদ নয়টি নীচু অর্ধ বৃত্তাকার গম্বুজ দিয়ে ঢাকা৷
ছবি: DW/M. Mamun
নয় গম্বুজের মিহরাব
নয় গম্বুজ মসজিদের অভ্যন্তরভাগ৷ মসজিদের ভেতরের পশ্চিম দেয়ালে তিনটি মিহরাব আছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
রণবিজয়পুর মসজিদ
বাগেরহাট শহরের উপকণ্ঠে রণবিজয়পুর গ্রামের ষাটগম্বুজ সড়কে এ মসজিদটি অবস্থিত৷ ফকিরবাড়ি মসজিদ নামেও এর পরিচিতি আছে৷ স্থাপত্যশৈলির বিচারে এটিকে হযরত খান জাহান আলীর সময়কালে (১৪৫৯ সাল) নির্মিত বলে মনে করা হয়৷ ইটের তৈরি এ মসজিদটি বর্গকারে নির্মিত এবং এক কক্ষ বিশিষ্ট৷ রণবিজয়পুর গ্রামের নামেই এ মসজিদের নামকরণ হয়েছে৷ রণবিজয়পুর মসজিদ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ৷
ছবি: DW/M. Mamun
চুনাখোলা মসজিদ
ষাট গম্বুজ মসজিদ থেকে প্রায় এক কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে ধান খেতের মধ্যে অবস্থিত চুনাখোলা মসজিদ৷ বর্গাকৃতির এ মসজিদটি বাইরের দিকে লম্বায় প্রায় ৪০ ফুট এবং ভেতরের দিকে ২৫ ফুট৷ দেয়ালগুলি প্রায় আট ফুট চওড়া৷ কেন্দ্রস্থলের উপরের দিকে রয়েছে বড় একটি গম্বুজ৷
ছবি: DW/M. Mamun
বিবি বেগনী মসজিদ
ষাট গম্বুজ মসজিদ থেকে প্রায় এক কিলোমিটার পশ্চিমে এক গম্বুজ বিশিষ্ট বিবি বেগনী মসজিদ৷ মসজিদটি সিংড়া মসজিদের অনুরূপ হলেও, এর পশ্চিম দেয়ালে মিহরাবের সংখ্যা তিনটি৷ মসজিদটির সঠিক নির্মাণকাল সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই৷
ছবি: DW/M. Mamun
সাবেকডাঙ্গা পুরাকীর্তি
খান জাহান আলীর স্থাপত্য শৈলীর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সাবেকডাঙ্গা পুরাকীর্তির অবস্থান বাগেরহাট শহরের উপকণ্ঠে সাবেকডাঙ্গা গ্রামে৷ লাল ইটের তৈরি আয়তকার এ ভবনটি একেক পাশে দৈর্ঘ্য ৭.৮৮ মিটার৷ ভবনটির দক্ষিণপাশে কেবল একটি প্রবেশপথ আছে৷ এর ভেতরে আর কোন দরজা, জানালা কিংবা মিহরাব নেই৷ তাই এটিকে মসজিদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়নি৷ জনশ্রুতি আছে খান জাহান আলী তাঁর বিশেষ প্রার্থনার জন্য এটি নির্মাণ করেছিলেন৷
ছবি: DW/M. Mamun
13 ছবি1 | 13
বাংলাদেশে পুরাকীর্তি জাদুঘরও আছে৷ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনে এ রকম জাদুঘর মোট ১৭টি৷ এ সব জাদুঘরের মাধ্যমে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন প্রদর্শিত হয়৷ আর জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ঢাকার অদূরে বিক্রমপুরে অতীশ দীপঙ্করের জন্মভূমি খনন কাজ শুরু করেছে৷ এখানে মৌর্য সভ্যতার অনেক নিদর্শন আছে বলে জানান সুফি মোস্তাফিজুর রহমান৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷