ফুটবল খেলার মধ্যে দিয়ে চেতনার মুক্তি ঘটেছে ওদের৷ পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলার মেয়েদের৷ লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধেও ওদের লড়াইয়ের হাতিয়ার হয়েছে ফুটবল৷
বিজ্ঞাপন
পশ্চিমবঙ্গের উত্তরে, আসাম সীমান্তের আলিপুরদুয়ার নারী পাচারের অন্যতম ঘাঁটি হিসেবে কুখ্যাত৷ প্রান্তবর্তী এই জেলার আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিই এর জন্য মূলত দায়ী৷ এখানকার বাসিন্দারা মূলত আদিবাসী, যাঁদের অন্নসংস্থান হয় স্থানীয় চা বাগানগুলির কুলি-কামিন হিসেবে৷ এদের উপার্জন খুবই কম, ফলে সারা জীবন পরিশ্রম করেও নিজেদের আর্থিক সঙ্গতি বলে এঁদের কিছু তৈরি হয় না৷ ফলে অভাবের তাড়নাতেই এঁদের ঘরের মেয়েরা বেহাত হয়ে যায়৷ আড়কাঠিদের পাল্লায় পড়ে পাচার হয়ে যায় ভিনরাজ্যে৷
‘জবালা’ নামে এক বেসরকারি সেবা সংগঠন এই নারী পাচার চক্রের বিরুদ্ধে এক প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে গ্রামের মেয়েদের সচেতন করে, সংগঠিত করে৷ কলকাতার জার্মান কনসুলেটের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতায় পশ্চিমবঙ্গের চার জেলায় নারী পাচারের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন সংগঠিত করছে জবালা৷ আলিপুরদুয়ার সেই চার জেলার একটি৷ কাজ করতে গিয়ে জবালার যা অভিজ্ঞতা, মেয়েদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে পারলে তাদের মধ্যে থেকেই প্রতিরোধ গড়ে উঠতে পারে৷ একটি মেয়ের আত্মবিশ্বাস ছড়িয়ে যেতে পারে আরও অনেকের মধ্যে৷ এবং মেয়েদের মধ্যে সেই আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিস্ময়কর ভূমিকা নেয় ফুটবল! কারণ, ফুটবল খুব চট করে একজন ভালো খেলোয়াড়কে পরিচিতি এনে দেয়৷ পাড়ায়, স্কুলে৷ ফলে সেই মেয়েটির স্কুলছুট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও অনেকাংশে কমে যায়৷ নেতৃত্ব দেওয়ার সহজাত ক্ষমতাও শনাক্ত করা যায় ফুটবল দলের মধ্যে৷
আলিপুরদুয়ারে কিশোরী-তরুণী মেয়েদের এরকমই দুটি ফুটবল দল গড়ে তুলেছে জবালা৷ নভেম্বর ২০১৬ থেকে এই দুটি দল নিয়মিত ফুটবল খেলছে, প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে৷ জার্মানির বিদেশ মন্ত্রকের আন্তর্জাতিক ক্রীড়া উন্নয়ন কর্মসূচির অংশ হিসেবে সম্প্রতি মেয়েদের এই দু'টি ফুটবল দলের সদস্যদের হাতে খেলার পোশাক, জুতো এবং বল তুলে দিলেন কলকাতার জার্মান কনসাল জেনারেল ডঃ মিশায়েল ফাইনার৷ তারপর একটি প্রীতি ম্যাচে অংশ নেয় দু'টি দল৷
‘এই মেয়েদের জন্যে ফুটবল খেলাটা এক ধরনের মানসিক চিকিৎসারও কাজ করেছে’
কিন্তু ফুটবল ঠিক কীভাবে বদলে দিচ্ছে আলিপুরদুয়ারের মেয়েদের? এর শুরুটা হয়েছিল মুর্শিদাবাদে, ডয়চে ভেলেকে জানালেন জবালা সংস্থার পক্ষ থেকে বৈতালী গাঙ্গুলি৷ মুর্শিদাবাদও পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী আরেকটি জেলা, যেখানে নারী পাচারের হার বেশি৷ সেখানে একটি নাচের স্কুলে বাগড়া দিয়েছিলেন স্থানীয় মৌলভীরা৷ হতাশ হয়েছিল সেই মেয়েরা, যারা ভালোবেসে নাচ শিখছিল৷ তখনই জবালা'র মাথায় আসে এই সামাজিক অনুশাসনের শেকলগুলো ভাঙার কথা৷ ফুটবল ছেলেদের খেলা, মেয়েরা পুতুল খেলবে— এমন লিঙ্গভিত্তিক বিভাজনের প্রচলিত ধারণাকেও তাঁরা ধাক্কা দিতে চেয়েছিলেন৷ এবং সেই কাজটা করতে গিয়ে আরও নানা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছিল জবালা’র কর্মীদের৷ যেমন একটি মেয়ে জানিয়েছিল, সে আগে দু–একবার ফুটবল খেলেছে৷ বাড়িতে যখন কেউ ছিল না, দরজা বন্ধ করে ভাইয়ের ফুটবলে লাথি কষিয়েছে৷ বৈতালী গাঙ্গুলি জানাচ্ছেন, এই মেয়েদের জন্যে ফুটবল খেলাটা এক ধরনের মানসিক চিকিৎসারও কাজ করেছে৷ ওদের বলা হতো, যে লোকটির কাছে কখনও নিগৃহিত হতে হয়েছে, অথবা যে লোকটি ভুলিয়ে নিয়ে গিয়ে পাচার করে দিতে চেয়েছিল, তাদের মুখ মনে করে ফুটবলে লাথি মারো!
যে কারণে ওরা এই ফুটবলের নাম দিয়েছেন ‘ফুটবল ফর ফ্রিডম’। স্বাধীনতার জন্য ফুটবল৷ যে খেলা প্রান্তিক এলাকার মেয়েদের জন্যে উন্মোচিত করে দিয়েছে এক স্বাধীন আকাশ৷
২০১৫ সালের এই ছবিঘরটি দেখুন...
জবরদস্তির পতিতাবৃত্তি থেকে জীবনের আনন্দে
প্রতি বছর নেপালের কয়েক হাজার মেয়েকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে বেছে নিতে হয় যৌনকর্মীর জীবন৷ শারীরিক নির্যাতন, ধর্ষণ – সবই সইতে হয় তাঁদের৷ চাকরির আশায় ঘর ছেড়ে অন্ধকার গলিতে ঢুকে পড়া এমন মেয়েদেরই জীবনের আনন্দে ফেরায় ‘মাইতি নেপাল’৷
ছবি: Gábor Halász
ঘর ছেড়ে আঁধারের পথে
মানবপাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে প্রতি বছর নেপালের অন্তত দশ হাজার মেয়ে ঘর ছাড়ে৷
ছবি: DW/E. Felden
যেখানে নরক
পরিবারে অভাব৷ তাই ভালো চাকরির আশ্বাসে মানবপাচারকারীদের বিশ্বাস করে ঘর ছাড়ে মেয়েরা৷ কিন্তু আশা অনুযায়ী চাকরি জোটে না৷ বেশির ভাগ মেয়েকেই ভারতে নিয়ে জোর করে নামানো হয় পতিতাবৃত্তিতে৷ অত্যাচার, নির্যাতন তো আছেই, ধীরে ধীরে এইডসসহ অনেক জটিল রোগ বাসা সচ্ছল জীবনের ঠিকানা খুঁজতে গিয়ে অন্ধকার গলিতে ঢুকে পড়া মেয়েদের শরীরে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
তাঁদের পাশে ‘মাইতি নেপাল’
অনেক বছর ধরেই দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে নেপালেের মেয়েদের যৌনকর্মী হতে বাধ্য করছে মানবপাচারকারীরা৷ একবার যৌনকর্মী হলে আর নিস্তার নেই – এমন যাঁরা ভাবতেন, অত্যাচার-নির্যাতন সইতে সইতে যাঁরা স্বপ্ন দেখতে ভুলে গিয়েছিলেন, তাঁদের অনেককেই ২২ বছর ধরে স্বপ্ন দেখাচ্ছে মাইতি নেপাল৷ ১৯৯৩ সালে এই সংগঠনটি গড়েছিলেন অনুরাধা কৈরালা৷ সেই থেকে বাধ্য হয়ে যৌনকর্মীর জীবন মেনে নেয়া মেয়েদের জীবনের পথে ফেরাচ্ছে মাইতি নেপাল৷
ছবি: Gábor Halász
মঞ্চে জীবনের অভিনয়
যৌনপল্লি থেকে নিয়ে এসে মেয়েদের জীবনে আনন্দও এনে দেয় মাইতি নেপাল৷ সে আনন্দ ধরে রাখার উপায়ও শেখায়৷ মঞ্চনাটক করে মেয়েরা৷ সেই নাটকেও থাকে মানবপাচারকারী এবং তাদের দুরভিসন্ধির কথা৷ সেই নাটকে অভিনয় করেন যৌনপল্লিফেরত মেয়েরা৷ এভাবে অন্য মেয়েদের যৌনপল্লি থেকে দূরে থাকার উপায়ও জানায় যৌনকর্মীর জীবনকে পেছনে ফেলে আসা মেয়েরা৷
ছবি: Gábor Halász
নজরদারি
আর কোনো মেয়ে যাতে মানবপাচারকারীদের পাল্লায় পড়ে দেশ না ছাড়ে সেদিকে সবসময় নজর রাখে মাইতি নেপাল৷ বিশেষ করে ভারত সংলগ্ন সীমান্তে গিয়ে বাসগুলোর ওপর কড়া নজর রাখেন সংস্থার কর্মীরা৷ কোনো মেয়ে এবং তার সঙ্গের কোনো পুরুষকে দেখে সন্দেহ হলেই তাঁরা পুলিশ ডাকেন৷
ছবি: Gábor Halász
নয় বছরের সেই মেয়েটি
গীতা নামের এই নারীকে মানবপাচারকারী যখন যৌনপল্লিতে নিয়ে যায়, তখন তাঁর বয়স মাত্র নয়৷ সেখান থেকে যখন ফিরলেন তখন এইচআইভি-র সংক্রমণে তাঁর শরীর কাহিল, বেঁচে থাকার আশাও প্রায় শেষ৷ একে তো যৌনকর্মী তার ওপর এইচআইভি-র রোগী –তাই অনেক সমাজসেবকও তখন গীতার কাছেই ঘেঁষতেন না৷ তখনই তাঁর পাশে দাঁড়ায় মাইতি নেপাল৷
ছবি: AP
নতুন ঠিকানা
নেপালের সীমান্ত এলাকায় ১১টি গৃহ নির্মাণ করেছে মাইতি নেপাল৷ যৌনপল্লি থেকে ফেরা মেয়েদের জন্য ঘর৷ মেয়েদের ভোকেশনাল ট্রেনিং বা বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণও দেয়া হয় সেখানে৷
ছবি: Gereon Wagener
দুঃসহ স্মৃতি ভুলতে...
কাঠমান্ডুর মাইতি নেপাল সেন্টারের উঠোনে প্রতিদিন বসে নাচের আসর৷ মেয়েরা যাতে অতীত ভুলে আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে সুন্দর আগামীর পথ রচনা করতে পারে সেজন্যই নাচ শেখানো হয় তাদের৷ এ পর্যন্ত ১২ হাজার শিশু ও নারী মাইতি নেপালের সহায়তায় যৌনপল্লি ছেড়েছে৷ সীমান্ত থেকে বাঁধা পেয়ে অল্পের জন্য যৌনকর্মী হওয়া থেকে বেঁচেছে প্রায় ৩০ হাজার জন৷
ছবি: Gábor Halász
জার্মানিতে মাইতি নেপালের মেয়েরা
মাইতি নেপাল-এর কয়েকজন এখন জার্মানিতে৷ কোলন শহরের এলি হয়েস রেয়ালশুলে-তে সেদিন নেপালি নাচই নাচলেন৷
ছবি: DW/E. Felden
যেন প্রজাপতি...
কোলনে মাইতি নেপালের মেয়েরা যেন প্রজাপতির মতো উড়ছিলেন৷ তাঁদের জীবনও তো প্রজাপতির মতোই৷ শৈশব থেকে জীবনের একটা সময় পর্যন্ত শুঁয়োপোকার মতো তাঁদেরও অনেক কষ্ট সইতে হয়েছে৷ কষ্টের সময় কেটে যাওয়ার পর এখন প্রজাপতির মতোই যেন ডানা মেলে উড়ছে৷
ছবি: DW/E. Felden
ইউরোপ সফর
নভেম্বর পর্যন্ত ইউরোপের বিভিন্ন শহরে অনুষ্ঠান করবে মাইতি নেপালের মেয়েরা৷ এ সময়ে জার্মানি, অস্ট্রিয়া এবং সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন শহরে হবে তাঁদের অনুষ্ঠান৷