1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

নিয়োগে রাজনৈতিক প্রভাবের ইঙ্গিত সিবিআইয়ের তদন্তে

১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

রাজনৈতিক নেতাদের সুপারিশেই প্রাথমিক স্কুলে অনেকের চাকরি হয়েছিল৷ আদালতে পেশ করা নথিতে এমনই দাবি করেছে সিবিআই৷

শিক্ষকদের প্রতিবাদ সমাবেশ৷
(ফাইল ছবি) ২০২৩ সালেও ৩৬ হাজার শিক্ষক নিয়োগ বাতিল করেছিল কলকাতা হাই কোর্ট৷ছবি: Payel Samanta/DW

২০১৪ সালের প্রাথমিকের পরীক্ষার ভিত্তিতে যে মেধা তালিকা প্রকাশিত হয়, তা নিয়ে উঠেছে দুর্নীতির অভিযোগ৷ তাই ২০২২ সাল থেকে তদন্তে নেমেছে সিবিআই৷ প্রথম থেকেই অভিযোগ ছিল, প্রাথমিকে চাকরি দেওয়ার জন্য সুপারিশ করেছিলেন একাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তি৷ সিবিআইয়ের নথিতে উঠে এসেছে তাদের নাম৷

সিবিআই নথি

শুক্রবার আদালতে সিবিআই বেশ কিছু নথি জমা দিয়েছে৷ এই নথি বিকাশ ভবনে তল্লাশি চালিয়ে উদ্ধার করেছিল কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাটি। ২০২৪ সালের ২৮ জুনের তল্লাশিতে যে নথি পাওয়া যায়, তাতে অনেক নেতা ও জনপ্রতিনিধির নাম ছিল। সেই নথি প্রকাশ্যে এসেছে৷

প্রভাবশালীদের নামের তালিকা একেবারে ছোটো নয়৷ নথি অনুযায়ী প্রায় ২০ জন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব প্রাথমিকে চাকরির জন্য সুপারিশ করেছিলেন৷ এর মধ্যে রয়েছে বর্তমানে বিজেপি সাংসদ দিব্যেন্দু অধিকারী, সাবেক তৃণমূল সাংসদ মমতাবালা ঠাকুর, বিজেপি নেত্রী ভারতী ঘোষ, তৃণমূল বিধায়ক শওকত মোল্লার নাম৷

কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে খবর, ২০ জনের চাকরির জন্য সুপারিশ করেছিলেন তমলুকের তৎকালীন তৃণমূল সাংসদ দিব্যেন্দু অধিকারী৷ ২০১৪ সালের প্রাথমিকের টেট পরীক্ষার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বেরিয়েছিল ২০১৬ সালে৷ সেই বছরেই তমলুক থেকে উপনির্বাচনে জিতে সংসদে যান তৃণমূলের দিব্যেন্দু অধিকারী৷ শুভেন্দু অধিকারীর ছেড়ে যাওয়া আসনে জিতেছিলেন তিনি৷ এখন বিজেপির টিকিটে জিতে দিল্লিতে গিয়েছেন দিব্যেন্দু৷

ঠাকুরনগরের ঠাকুরবাড়ির সদস্য মমতাবালা ঠাকুর তৃণমূল সাংসদ ছিলেন৷ কপিলকৃষ্ণ ঠাকুরের মৃত্যুর পর ২০১৫ সালে লোকসভা উপনির্বাচনে বনগাঁ থেকে জিতে সাংসদ হয়েছিলেন মমতাবালা। পরে তিনি হেরে যান। মমতাবালা চারটি নামের সুপারিশ করেছিলেন বলে উল্লেখ রয়েছে সিবিআই নথিতে।

সাবেক আইপিএস তথা বর্তমানে বিজেপি নেত্রী ভারতী ঘোষের নাম রয়েছে নথিতে। ভারতী ২০১৩-১৭ সালে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার পুলিশ সুপার ছিলেন। তিনি পরবর্তীতে বিজেপিতে যোগ দেন। একাধিকবার লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন তিনি, যদিও জিততে পারেনি।

সিবিআইয়ের নথি অনুযায়ী, নাম রয়েছে তৃণমূল বিধায়ক বীণা মণ্ডল, নির্মল ঘোষ, শওকত মোল্লা, গুলশান মল্লিকের। এছাড়া সাবেক বিধায়ক শ্যামল সাঁতরা এবং রমেন্দ্রনাথ বিশ্বাস, কোচবিহার জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদ (ডিপিএসসি)-এর চেয়ারম্যান কল্যাণী পোদ্দারের নামও রয়েছে বলে সূত্রের খবর।

চাকরি বা কোনো কাজের জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা উপরমহলের সুপারিশ কোনো নতুন বিষয় নয়। এ ক্ষেত্রেও তেমনই হয়েছিল বলে অনুমান। যাদের নাম সুপারিশকারী হিসেবে নথিতে দেখা যাচ্ছে, তারা সকলে এই তথ্য খারিজ করছেন, এমন নয়।

বিজেপি নেত্রী ভারতী ঘোষ বলেন, "আমি বিষয়টায় খুব বিরক্ত। যদি কিছু প্রশ্ন থাকে, তা হলে আমার সঙ্গে কথা বলুন। চাকরিজীবনে বহু মানুষের অনেক উপকার করেছি। মানুষের উপকার করতে গিয়ে চার্জশিটে নাম ঢুকিয়ে দেবে, এটা তো ভাবিনি কখনো।"

মমতাবালার ভাষায়, ''আমার সততা নিয়ে প্রশ্ন তুলে আমাকে কলুষিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সামনেই বিধানসভা নির্বাচন। তার আগে আমাকে দমানোর চেষ্টা করছে। যারা সিবিআইকে পরিচালনা করে, এটা তাদেরই কাজ।"

সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্র ডিডাব্লিউকে বলেন, "এতে বোঝা যাচ্ছে যে, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ হয়েছিল নিয়োগের ক্ষেত্রে। দিব্যেন্দু অধিকারী, মমতাবালা ঠাকুর বা ভারতী ঘোষের নাম বেরিয়ে আসার পর সেই সম্ভাবনাটা অনেক স্পষ্ট লাগছে। বিষয়টা সুপারিশেই শেষ নয়, তার মানে আরো অনেক প্রভাব খাটানো হয়ে থাকতে পারে। আরো অনেক কিছু ঘটে থাকতে পারে। সুপারিশ পদ্ধতিটা চালু ছিল।

সুপারিশের তালিকা দেখে বোঝা যাচ্ছে, প্রভাবশালীরা নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করেছিলেন।"

মূল উৎসে পার্থ?

২০২২ সালের ২৩ জুলাই গভীর রাতে রাজ্যের তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে তল্লাশি চালায় কেন্দ্রীয় সংস্থা। পরে তাকে গ্রেপ্তার করেছিল সিবিআই। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বান্ধবী অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের হরিদেবপুর ও বেলঘরিয়ার দু'টি ফ্ল্যাটে তল্লাশি চালিয়ে নগদ ৫১ কোটি টাকা-সহ প্রচুর সোনা এবং বিদেশি মুদ্রা বাজেয়াপ্ত করেন তদন্তকারীরা।

সাবেক শিক্ষামন্ত্রী পার্থের তৎকালীন ওএসডি প্রবীর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে অনেক তথ্য পেয়েছিল সিবিআই। প্রবীর তদন্তকারীদের কাছে দাবি করেছিলেন, রাজনৈতিক নেতারা প্রায়ই পার্থের সঙ্গে দেখা করতে তার অফিসে যেতেন। তাদের মধ্যে বৈঠক হত। এই অফিসে সুপারিশের তালিকা নিয়ে আলোচনা হতো, নাম চূড়ান্ত করা হতো বলে সূত্রের খবর।

কেন্দ্রীয় সংস্থার নথি অনুযায়ী, প্রবীরের দাবি, ২০১৭ সালের মার্চ মাসে সুপারিশ করা চাকরিপ্রার্থীদের নামের তালিকা পার্থ তার হাতে তুলে দেন। সঙ্গে দেন নাম সম্বলিত একটি সিডি। এটা তৎকালীন পর্ষদ সভাপতি মানিক ভট্টাচার্যের হাতে তুলে দিতে বলেন পার্থ। তৃণমূল বিধায়ক মানিকও নিয়োগ দুর্নীতিতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। এখন তিনি জামিনে মুক্ত।

বিজেপি গোড়া থেকেই নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে তৃণমূলকে বিঁধছে। নথি অনুযায়ী সুপারিশকারী একাধিক নেতা এখন পদ্ম শিবিরে থাকায় তাদের অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। যদিও বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর বক্তব্য, "যাদের নাম আপনারা করছেন তারা শাসক দলের সাংসদ-বিধায়ক হয়ে থাকতে পারেন, সেই সুবাদে সুপারিশ করেছিলেন। তারা সেই সময়ে বিজেপিতে ছিলেন না। তাদের সুপারিশে যদি কোনো আত্মীয়ের চাকরি হয়ে থাকে, তাহলে তাদের ডেকে জের করা হোক। সেটা এখনো করা হয়নি।"

তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষের মন্তব্য, "যাদের নাম সামনে আসছে, যারা এই সুপারিশ করেছেন, তারা এখন বিজেপি করছেন। তারা ব্যাখ্যা দিন, কেন তারা সুপারিশ করেছিলেন। দায় তাদেরও নিতে হবে। সিবিআই তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করুক। সেক্ষেত্রে যদি তাদের সুপারিশ করা নামের সঙ্গে অনিয়মে চাকরি পাওয়া প্রার্থীদের নাম মিলে যায়, তাহলে এই জনপ্রতিনিধিদের মামলায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।"

সাবেক সিপিএম সাংসদ শমীক লাহিড়ী বলেন, "আমরা বারবারই বলেছি, এটা এ টিম আর বি টিমের ব্যাপার। সবার নাম পাবেন আপনি। তুমি চুরি কর, আমিও চুরি করি, এই বোঝাপড়া হয়ে গিয়েছে। নইলে কীভাবে ওরা এখনো জেলের বাইরে রয়েছেন।"

নথি থেকে বোঝা যায়, এটা সংগঠিত অপরাধ: আইনজীবী ফিরদৌস শামীম

This browser does not support the audio element.

স্বচ্ছ নিয়োগের অপেক্ষা

এই রাজনৈতিক তরজার ফলে দ্রুত নিয়োগের বিষয়টি লঘু হয়ে যাচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে, যারা যোগ্য প্রার্থীদের বঞ্চিত করে নিয়োগ পেলেন, তাদের ক্ষেত্রে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সিবিআইয়ের দাবি, বিভিন্ন নেতা, জনপ্রতিনিধি যাদের নাম সুপারিশ করেছিলেন, তাদের মধ্যে ১৩৪ জন স্কুলে নিয়োগ পেয়েছেন। যে যোগ্য প্রার্থীরা নিয়োগ পেলেন না, তারাই বা কবে সুবিচার পাবেন।

আইনজীবী ফিরদৌস শামীম বলেন, ‘‘এই নথি থেকে বোঝা যাচ্ছে, এটা একটা সংগঠিত অপরাধ। সেই সময়ে যারা শাসকদলের নেতা-নেত্রী ছিলেন, তারা আর্থিক কারণে হোক বা রাজনৈতিক বোঝাপড়ায়, নিজেদের পছন্দের প্রার্থীদের নাম সুপারিশ করেছিলেন। যে প্রার্থীরা সন্দেহের আওতায় রয়েছেন, তাদের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে প্রাপ্ত নম্বর কত, ওএমআর শিটে মার্কস কত, ইন্টারভিউয়ে কত পেয়েছেন, সব দিক খতিয়ে দেখে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করা উচিত সিবিআইয়ের।"

সুবিচারের অপেক্ষায় এখনো আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীরা। ৮৩০ দিনের মতো চলছে তাদের ধর্নামঞ্চ। ২০১৪ সালে উত্তীর্ণ প্রাথমিকের চাকরিপ্রার্থী অচিন্ত্য সামন্ত ডিডাব্লিউকে বলেন, "আমরা প্রত্যেকেই সাধারণ বাড়ির প্রার্থী। একটা চাকরি আমাদের বেকারত্ব ঘোচাতে পারে। কিন্তু, নেতা-মন্ত্রীদের হাত ধরে সুপারিশের মাধ্যমে চাকরি হয়ে যাচ্ছে। এটা সমাজের পক্ষে দারুণ ক্ষতিকর। ওয়ান থেকে ফোর পর্যন্ত যে সময়ে শিশুদের ভিত তৈরি হয়, সুপারিশে চাকরি পাওয়া মাস্টারমশাইদের কাছে তারা কী পড়াশোনা করবে?"

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ