বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনায় তাঁদের ক্ষতিপূরণ ও নিরাপত্তায় কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, তা জানতে চেয়েছে হাইকোর্ট৷ ৭ দিনের মধ্যে এ ব্যাপারে প্রতিবেদন দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে৷ এদিকে সংখ্যালঘুদের মধ্যে আতঙ্ক এখনও কমেনি৷
বিজ্ঞাপন
৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের পর সাতক্ষীরা, যশোর, ঠাকুরগাঁও, নাটোর, দিনাজপুর, মাগুরা, নেত্রকোনা, জয়পুরহাট, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রামে সংখ্যালঘুদের বাড়ি-ঘরে হামলা হয়৷ তাঁদের বাড়ি-ঘর ছাড়াও দোকান-পাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা হয় এবং তা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়৷ এই হামলায় আহত-নিহতের ঘটনা ছাড়াও ধর্ষণের শিকার হন সংখ্যালঘু নারীরা৷ সারা দেশে এর ব্যাপক প্রতিবাদ ও নিন্দা হলেও সংখ্যালঘুরা তারপরও আক্রান্ত হয়েছেন৷ আক্রান্ত হয়েছেন ঝালকাঠি, চাঁদপুর, পিরোজপুরের সংখ্যালঘু পরিবার৷
সংখ্যালঘু নির্যাতন ও তাঁদের নিরাপত্তার বিষয়টি বুধবার আদালতের নজরে আনেন আইনজীবী পরিমল চন্দ্র গুহ৷ বিষয়টি আমলে নিয়ে হাইকোর্টের বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি এবিএম আলতাফ হোসেনের বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সরকারের ওপর রুল জারি করে৷ রুলে আদালত সংখ্যালঘুদের নিরপত্তা এবং ক্ষতিপূরণের কেন নির্দেশ দেয়া হবে না – তা জানতে চেয়েছে৷ সাত দিনের মধ্যে এই রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে৷ স্বরাষ্ট্রসচিব, পুলিশের মহাপরিচালক, ব়্যাবের মহাপরিচালক, সংশ্লিষ্ট জেলার ডিসি ও পুলিশ সুপারদের ওপর এই রুল জারি করা হয়৷ একই সঙ্গে আদালত জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের সাত দিনের মধ্যে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা এবং কী ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে তার প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেছে৷
ব়্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান ডয়চে ভেলেকে জানান, তারা সংখ্যালঘুদের বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছেন৷ এছাড়া, অপরাধীদের গ্রেপ্তারের জন্য অভিযানও পরিচালনা করছেন তারা৷ তারা পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশনা মেনে যৌথভাবে কাজ করছেন৷ পুলিশ সদর দপ্তর জানায়, ক্ষতিপূরণের বিষয়টি সরকার এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় দেখছে৷ পুলিশের মহাপরিদর্শক বেশ কয়েকটি আক্রান্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন৷ আর পুলিশ সুপাররা ঘটনাস্থল পরিদর্শন এবং সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছেন৷ সরকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে এসব অপরাধের বিচার করবে৷
তবে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক নূর খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার ব্যাপারে সরকার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিয়েছে বলে তাঁর মনে হয় না৷ তিনি বলেন, তাঁরা যে আক্রান্ত হতে পারে তা সবারই জানা ছিল৷ তারপরও তাঁদের আগাম নিরাপত্তা দেয়া হয়নি৷ আবার হামলার পর, সরকার এর প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য যেন কিছুটা সময় নিয়েছে৷ তিনি বলেন, এখনো হামলা হচ্ছে এবং আতঙ্কও কাটেনি৷ এমনকি, তাঁরা সাময়িক কিছু সহায়তা ছাড়া ক্ষতিপূরণ পাননি৷
নূর খান বলেন, ২০০১ সালেও শত শত সংখ্যালঘু পরিবার নির্যাতনের শিকার হন৷ কিন্তু বিচার হয়েছে মাত্র তিনটি ঘটনার৷ তাঁর কথায়, ‘‘এবার যেন সেরকম না হয়৷''
মালোপাড়ার হিন্দুদের কান্না থামেনি
বাংলাদেশের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দেয়াকে ঘিরে যশোরের অভয়নগর উপজেলার মালোপাড়ায় ৫ জানুয়ারি সন্ধ্যায় হিন্দুদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়ার পাশাপাশি লুটপাটও করা হয়৷
ছবি: DW
নেই নিরাপত্তাকর্মীর সাড়া
যশোরের অভয়নগরের চাপাতলী গ্রামের প্রবেশপথে পুলিশের সতর্ক অবস্থান৷ গত ৫ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচনের দিন এই গ্রামের নিম্নবর্ণের হিন্দু অধ্যুষিত মালোপাড়ায় বসবাসরতদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটে৷ আক্রান্তরা জানান, ঘটনাস্থলের মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে থানার অবস্থান হলেও অনেক ফোন করেও সে সময়ে পুলিশ কিংবা কোনো নিরাপত্তাকর্মীর সাড়া মেলেনি৷
ছবি: DW
‘নদী ঠাকুর’
দুর্বৃত্তদের হামালায় লণ্ডভণ্ড মায়া রানি বিশ্বাসের একমাত্র মাথা গোঁজার ছোট্ট নিবাস৷ সেদিন হামলা শুরু হলে পাশের বুড়ি ভৈরব নদীতে ঝাঁপ দিয়ে ওপারে উঠে প্রাণে বেঁচে যান বিধবা এই নারী৷ তাঁর ভাষায় ‘নদী ঠাকুর’ সেদিন না থাকলে জানটা হয়ত থাকতো না৷
ছবি: DW
প্রাণ বাঁচাতে নদীতে
নিজের ঘরের ভাঙা আসবাব, টেলিভিশনের পাশে মালোপাড়ার গৃহবধু উজ্জ্বলা বিশ্বাস৷ হামলাকারীদের ভয়াবহ রূপ সামান্য দেখেছিলেন তিনি৷ প্রাণ বাঁচাতে তিনিও ঝাঁপ দেন বুড়ি ভৈরবে৷ হামলার সময়ে তাঁর মনে হয়েছিল যে ভগবান সেদিন পাশে ছিলেন না৷
ছবি: DW
বই-পত্র পুড়িয়ে দিয়েছে
কলেজ পড়ুয়া মঙ্গলা বিশ্বাসের বই-পত্র, এমনকি সার্টিফিকেটও পুড়িয়ে দিয়েছে হামলাকারীরা৷
ছবি: DW
সুন্দর স্বপ্নে চির
হামলাকারীদের ভেঙে দেয়া আয়নায় কলেজ পড়ুয়া মঙ্গলা বিশ্বাসের প্রতিবিম্ব৷ বাড়ির দেয়ালে টাঙানো এই ভাঙা আয়নার মতোই মঙ্গলার সুন্দর স্বপ্নেও চির ধরিয়েছে হামলাকারীরা৷ মঙ্গলার আক্ষেপ, তাঁর বই-পত্র আর সার্টিফিকেট কী দোষ করলো?
ছবি: DW
আত্মীয়দের বাড়িতে আশ্রয়
হামলার ছয় দিন পরে এঁরা ফিরছেন বাড়িতে৷ হামলার সময় পার্শ্ববর্তী গ্রামে আত্মীয়দের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন তাঁরা৷
ছবি: DW
হামলার প্রত্যক্ষদর্শী
৮৬ বছর বয়সি মৃত্যুঞ্জয় সরকার সেদিনের হামলার প্রত্যক্ষদর্শী৷ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ও দেশ ছাড়েননি তিনি৷ কিন্তু হামলার পর তাঁর মনে হচ্ছিল যে, সে সময়ে ছেড়ে যাওয়াটাই উচিত ছিল তাঁর৷
ছবি: DW
গাছও রেহাই পায়নি
বাড়ি-ঘরের পাশাপাশি মালোপাড়ার গাছও জ্বালিয়ে দিয়েছিল দুর্বৃত্তরা৷
ছবি: DW
পলাতক জামায়াত নেতা
মালোপাড়ায় হামলার পরে চাপাতলী গ্রামের পার্শ্ববর্তী গ্রাম বালিয়াডাঙ্গায় স্থানীয় জামায়াতে ইসলামীর থানা আমীর মাওলানা আব্দুল আজিজের বাড়ি ভাঙচুর করে যৌথবাহিনী৷ ঘটনার আগে থেকেই পলাতক রয়েছেন এ জামায়াত নেতা৷
ছবি: DW
আক্রান্তদের অভিযোগ
জাতীয় সংসদের সাবেক হুইপ আওয়ামী লীগ নেতা শেখ আব্দুল ওহাব৷ মালোপাড়ায় সাম্প্রদায়িক হামলার জন্য জামায়াত শিবির ছাড়াও স্থানীয় আওয়ামী লীগের দলীয় কোন্দলকেও দায়ী করেছেন অনেকে৷ সাবেক এই সাংসদ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেতে ব্যর্থ হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে লড়েছেন৷ সেখানে নতুন প্রার্থী হিসেবে রণজিৎ রায় মনোনয়ন পাওয়ায় এই দুই জনের সমর্থকদের মাঝে বেশ উত্তেজনা ছিল পুরো নির্বাচনের সময়টায়৷
ছবি: DW
গণধর্ষণ
যশোরের আরেক ভয়াল জনপদ মনিরামপুর উপজেলার হাজরাইল গ্রামের দাসপাড়ার বাসিন্দা অনারতী দাস৷ ৭ জানুয়ারি রাতে তাঁর সামনেই অস্ত্রের মুখে একদল দুবৃত্ত গণধর্ষণ করে পুত্রবধু মনিমালা দাস আর ভাতিজি রূপালী দাসকে৷
ছবি: DW
ভয়াবহ দৃশ্যের প্রত্যক্ষদর্শী
কার্তিক দাসকেও সেদিন রাতে সেই ভয়াবহ দৃশ্যের প্রত্যক্ষদর্শী হতে হয়েছিল৷ দাসপাড়ায় গণধর্ষণের শিকার নিম্নবর্ণের হিন্দু মনিমালা দাসের শ্বশুর ও রূপালী দাসের চাচা তিনি৷
ছবি: DW
বাড়িঘর ছেড়েছেন
দাসপাড়ায় গণধর্ষণের শিকার হওয়া পরিবার দুটি আতঙ্কে বাড়িঘর ছেড়েছেন৷
ছবি: DW
শুধুই আতঙ্ক
দাসপাড়ার এক নারী৷ দাসপাড়ার নারীদের এখন নির্ঘুম রাত কাটে আতঙ্কে৷