অবধারিতভাবে প্রতিদিন যে দুটি প্রশ্ন আমাকে কয়েকবার করে শুনতে হয় সেটা হচ্ছে—‘ভাই, নির্বাচন কী হবে? ফেব্রুয়ারিতেই হবে?' এই সন্দেহগুলো যে একেবারে ভিত্তিহীন তাও কিন্তু নয়।
বিজ্ঞাপন
এখন প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে ড. ইউনূসের দেওয়া আগামী নির্বাচনে সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ কি সম্ভব হবে? আওয়ামী লীগকে হিসেবের বাইরে রাখলে, বড় দলের মধ্যে আর যারা থাকল, তারা সবাই কি এই মুহূর্তে ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে? সেটাও বোধ করি বলা যাবে না। ঠিক এই জায়গাতেই নির্বাচন নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তার।ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
অথচ এ প্রশ্নটা ওঠারই কথা ছিল না। হাসিনা সরকার পতনের ঠিক একবছর পর, গত ৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ড. ইউনূস প্রথমবারের মতো জাতীয় নির্বাচনের একটা সুনির্দিষ্ট সময় ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, ২০২৬ এর ফেব্রুয়ারিতে, রমজানের আগে, হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তিনি কেবল একথা বলেই চুপ থাকেননি। এর পরপরই নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য প্রধান উপদেষ্টার অফিস থেকে চিঠি পাঠানো হয় নির্বাচন কমিশনে। তার কিছুদিন পরই নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে জাতীয় নির্বাচনের একটা রোডম্যাপও ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে দেখা যায়, সংসদীয় আসনগুলোর সীমানা নির্ধারণ নিয়ে যে বিতর্ক, তা নিয়েও শুনানি করছে নির্বাচন কমিশন। কবে নাগাদ নির্বাচনের শিডিউল ঘোষণা করা হবে, সেটাও জানিয়ে দেয় কমিশন। যে আইনের অধীনে নির্বাচন হয়, সেই আরপিও তে কিছু পরিবর্তন আনা দরকার, তাই নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে কিছু সংশোধনী প্রস্তাবও পাঠানো হয় সরকারের কাছে।
এই যে কর্মকাণ্ডের কথা বললাম, এর সবই তো একটা নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিমূলক কাজ। সবকিছুই ঠিকঠাক মতো চলছে। তারপরও সন্দেহ কেন? এমন সন্দেহ বা দ্বিধা থাকা স্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু আছে যে, এটাই বাস্তবতা। আবার অন্যভাবে বললে, এই সন্দেহগুলো যে একেবারে ভিত্তিহীন তাও কিন্তু নয়। নির্বাচনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর একটা সম্পর্ক রয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে আমরা দেখেছি, বড় একটি দল না এলে সেই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। দেড় শতাধিক আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে গেছে। বলা যায়, কোন ভোট ছাড়াই তারা এত বেশি আসনে বিজয়ী হয়েছে যে, তা দিয়েই সরকার গঠন করা সম্ভব। ২০২৪ সালেও একই ঘটনা একটু অন্যভাবে হয়েছে। এবার আর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কেউ নির্বাচিত হয়নি। বরং সব আসনেই ডামি প্রার্থীকে দাঁড় করানো হয়েছে। ফলে সেই নির্বাচন হয়ে গেছে ‘আমি আর ডামি'র নির্বাচন।
নির্বাচন নিয়ে জনমনে শঙ্কা-সংশয়
ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য ও সার্বিক প্রস্তুতি নিয়েও মানুষের মধ্যে শঙ্কা রয়েছে। এসব বিষয়ে ডয়চে ভেলের সাথে কথা বলেছেন রাজনীতিবিদ, বিশ্লেষক, সাংবাদিক ও শিক্ষার্থীরা।
জনমনে স্বস্তি ফেরেনি, নির্বাচন হবে কীভাবে?: রুহিন হোসেন প্রিন্স, সাধারণ সম্পাদক, সিপিবি
নির্বাচন নিয়ে শঙ্কার তিনটি কারণ আছে। প্রথমত, জনজীবনে স্বস্তি ফেরেনি, এর মধ্যে নির্বাচন হবে কীভাবে? দ্বিতীয়ত, সরকার ও নির্বাচন কমিশনের আরও কিছু দৃশ্যমান পদক্ষেপ দরকার ছিল। যেমন, রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনি যাত্রায় শামিল করার দরকার ছিল, যেটা তারা করেনি। তৃতীয়ত, সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনবিরোধী অবস্থান নিয়েই কথা বলছে। ফলে মানুষের মধ্যে সংশয় তৈরি হওয়াটাই স্বাভাবিক।
ছবি: DW
রাজনৈতিক অনৈক্য ও নিরাপত্তাহীনতা নির্বাচনে বাধা : মনিরা শারমিন, যুগ্ম আহবায়ক, এনসিপি
মানুষের মধ্যে শঙ্কার অনেক কারণ আছে। মূলত দলগুলোর মধ্যে ঐক্য তৈরি হয়নি। এটা নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে বড় প্রভাবক। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হলে এখন তো সবার মাঠে থাকার কথা। বিশেষ করে একটি দল যারা শুরু থেকেই নির্বাচনের কথা বলছে তারাও কিন্তু মাঠে নামেনি। তারাও জানে, রাজনৈতিক ঐক্য ছাড়া নির্বাচন সম্ভব না৷ মানুষ গত তিনটা নির্বাচনে ভোট দিতে পারেনি। নির্বাচনহীনতার একটা সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে।
ছবি: Privat
জামায়াত-এনসিপির শর্ত শঙ্কা তৈরি করেছে : ডা. জাহেদ উর রহমান, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
কতগুলো যৌক্তিক কারণেই সংশয় তৈরি হয়েছে। এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগ মাঠে নেই। মূল দল জামায়াত ও এনসিপি নানা ধরনের শর্ত দিচ্ছে নির্বাচন নিয়ে। যেগুলো দেখে মনে হতে পারে তারা নির্বাচন চায় না। এটাই মানুষের মধ্যে সংশয় তৈরি করেছে। এই মুহূর্তে সবার নির্বাচনের মাঠে থাকার কথা। কিন্তু জামায়াত-এনসিপি যেসব শর্ত দিচ্ছে সেগুলো পূরণ না হলে তারা নির্বাচন করবে না। ফলে আদৌ নির্বাচন হবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কা তো আছেই।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
নির্বাচন ছাড়া সরকারের বিকল্প নেই : রোকসানা খন্দকার, আইনজীবী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের অভাব দেখা যাচ্ছে। কয়েকটি দল শর্ত দিচ্ছে, এটা না হলে, ওটা না হলে তারা নির্বাচনে যাবে না। এই শর্তের কারণে মানুষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। তবে যতই শঙ্কা থাক, বর্তমান সরকার কিন্তু বুঝতে পেরেছে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, বিনিয়োগ নেই, কর্মসংস্থান নেই এতে মানুষ দারুনভাবে ক্ষুব্ধ। ফলে যত শঙ্কাই থাক না কেন, নির্বাচন দেওয়া ছাড়া এই সরকারের কোন বিকল্প নেই।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
আইন শৃঙ্খলা হচ্ছে বড় চ্যালেঞ্জ: মোস্তফা ফিরোজ, সিনিয়র সাংবাদিক
তিনটা দলকে গুরুত্ব দেন ড. ইউনূস। এর মধ্যে জামায়াত ও এনসিপি পিআর সিস্টেমে নির্বাচন চায়। তাদের এই দাবির কারণে এক ধরনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। আর বিএনপিও অগোছালো। তারেক রহমান দেশে নেই, প্রার্থী বাছাই করে যে তারা মাঠে নামবে সেটাও দেখা যাচ্ছে না। এসব কারণে অনিশ্চয়তা। আর আইনশৃঙ্খলা হচ্ছে বড় চ্যালেঞ্জ। পুলিশ আসলে প্রস্তুত না। সেনাবাহিনী দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না। এই কারণেও শঙ্কা বেড়েছে।
ছবি: Privat
নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে : সাইদুর রহমান, রাজনীতি ও নির্বাচন বিষয়ক সম্পাদক, ইত্তেফাক
ভোট ব্যবস্থাপনার প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা আছে। ভোটারদের কেন্দ্রে উপস্থিত নিশ্চিত করার পাশাপাশি আরেকটি চ্যালেঞ্জ নির্বাচন কমিশনকে কঠিন সংকটের মুখোমুখী ফেলতে পারে। সেটি হল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিস-ইনফরমেশন এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দিয়ে ছবি বা ভিডিও বানিয়ে ছড়িয়ে দেয়া। ভোট না হওয়া পর্যন্ত শঙ্কা থাকবে। এখনো নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার সুযোগ চাই : অর্পিতা সাহা, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
জীবনের প্রথম ভোট হিসেবে আমি চাই পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে। এই নির্বাচন যেন সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক হয়। যেখানে প্রতিটি দল সমান সুযোগ পাবে। আমার প্রত্যাশা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এমন সরকার নির্বাচিত হবে, যারা সত্যি জনগণের আশা ও কল্যাণ বাস্তবায়নে এগিয়ে আসবে। বর্তমান সরকারের প্রতি জনগণের অনেক প্রত্যাশা ছিল, কিন্তু সেই প্রত্যাশাগুলো পূরণ হয়নি। তাই ফেব্রুয়ারির নির্বাচন অত্যন্ত জরুরি।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
নির্ভয়ে ভোট দিতে চাই : রাতুল হাসান রাফি, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
জনগণ ভেবেছিল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারই হবে পরিবর্তনের প্রতীক। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবে, দুর্নীতি কমাবে, উন্নয়নের গতি বাড়াবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল ব্যর্থতাই বেশি। জনগণের আস্থা টিকিয়ে রাখতে হলে আর সময়ক্ষেপণের সুযোগ নেই। ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হতে হবে। একেবারেই স্বচ্ছ ও প্রতিযোগিতামূলক, যেখানে কোনো দল বিশেষ সুবিধা না পায়। জীবনের প্রথম ভোট হিসেবে আমি নির্ভয়ে যোগ্য প্রার্থীকে ভোট দিতে চাই।
জাতীয় নির্বাচনে একজন তরুণ ভোটার হিসাবে আমার প্রধান প্রত্যাশা হলো সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব পাওয়া। আমি চাই শিক্ষা, কর্মসংস্থান প্রযুক্তিকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হোক। দুর্নীতি কমানোসহ নারী হিসাবে আমার সমান সুযোগ ও নিরাপদ পরিবেশ প্রত্যাশা করি। সবশেষে, আমি এমন নেতৃত্ব চাই যারা ন্যায়ভিত্তিক ও উন্নত বাংলাদেশ গড়বে।
ছবি: Privat
নির্বাচন যেন অবাধ সুষ্ঠু হয় : আবু বকর অনিক, শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
আমি এখনও কোন নির্বাচনে ভোট দেইনি। জীবনে প্রথম ভোট দেবো রাকসু নির্বাচনে। আর ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দিতে চাই। সেই নির্বাচনটি যেন যেন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হয়। যাতে জনগণ তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে নির্বাচিত করতে পারে এবং একজন প্রকৃত স্বদেশপ্রেমী প্রতিনিধির মাধ্যমে সংসদে তাদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হয়।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
10 ছবি1 | 10
এসব অভিজ্ঞতার পর এখন প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে ড. ইউনূসের দেওয়া আগামী নির্বাচনে সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ কি সম্ভব হবে? আওয়ামী লীগ যে থাকছে না, এটা একরকম ধরেই নেওয়া যায়। সরকারই এরকম একটা ব্যবস্থা করে রেখেছে। দলটির বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে, সেই মামলা যতদিন নিষ্পত্তি না হবে তারা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতে পারবে না। যে কোন রাজনৈতিক দলের জন্য নির্বাচন অতি অবশ্যই একটা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। সে বিবেচনায় বর্তমানের ধারা অব্যাহত থাকলে ধরেই নেওয়া যায়, আসন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিতে পারবে না। আওয়ামী লীগকে হিসেবের বাইরে রাখলে, বড় দলের মধ্যে আর যারা থাকল, তারা সবাই কি এই মুহূর্তে ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে? সেটাও বোধ করি বলা যাবে না। ঠিক এই জায়গাতেই নির্বাচন নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তার।
ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের বিষয়ে ড. ইউনূসের ঘোষণা, নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি—এসব নিয়ে যতটা সন্তুষ্টি বিএনপির মধ্যে দেখা যাচ্ছে ততটা কি আছে জামায়াতে ইসলামী বা এনসিপির মধ্যে? মনে হয় না। জামায়াতে ইসলামী বা জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এরই মধ্যে বেশ কিছু শর্ত দিয়েছে। জামায়াত বলছে পিআর পদ্ধতির কথা, আর এনসিপি বলছে সংস্কার কর্মসূচিগুলোর একটা সাংবিধানিক বৈধতা দেওয়ার কথা, সেগুলো বাস্তবায়নের কথা। এর পাশাপাশি আবার দুই দলেরই দাবি আছে—আগে শেখ হাসিনার বিচার করতে হবে, তারপর নির্বাচন। এসব দাবির যৌক্তিকতা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে জরুরি প্রশ্ন হচ্ছে, ফেব্রুয়ারির আগেই এসব করা অথবা শেষ করা সম্ভব কী-না। পিআর বা সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন করা নিয়ে বড় দল হিসেবে বিএনপির আপত্তি আছে। বিএনপির আপত্তিকে অগ্রাহ্য করে নতুন এই পদ্ধতির বাস্তবায়ন প্রায় অসম্ভব বলেই মনে হয়। সরকার এখনও জামায়াতের এমন দাবির বিষয়ে তেমন কোনও গুরুত্ব দিচ্ছে না। জামায়াত তাদের দাবি পূরণের সঙ্গে নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়াকে শর্ত হিসাবে উপস্থাপন করেনি। এ থেকে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, পিআর পদ্ধতি আসলে তাদের রাজনৈতিক দাবি। এ দাবিতে তারা রাজপথে থাকবে। হয়তো আগামী নির্বাচনে এই দাবিকে তারা রাজনৈতিক ইস্যু হিসাবে জনগণের সামনে নিয়ে আসবে। বিপরীত দিকে এনসিপি কিন্তু তাদের দাবি নিয়ে বেশ সিরিয়াস। তারা সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক কিছু সংস্কার বাস্তবায়নের লক্ষে গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি তুলেছে। এসবকে তারা নির্বাচনের পূর্বশর্ত হিসাবেও উল্লেখও করেছে।
সংস্কার কমিশন ও সংস্কারের প্রস্তাবনা
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই রাষ্ট্রযন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন অংশের সংস্কার কমিটি গঠন করেন। ছবিঘরে থাকছে সেসব সংস্কার প্রস্তাবনার সারসংক্ষেপ।
ছবি: bdnews24.com
নির্বাচন কমিশন সংস্কার
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের উদ্দেশ্যে প্রায় ১৫০টির কাছাকাছি সুপারিশ করেছে কমিশন। যার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য ডাকযোগে ভোট দেয়ার ব্যবস্থা, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ, উচ্চ কক্ষের জন্য নির্বাচন, বিরোধী দলকে ডেপুটি স্পিকারের পদ দেয়া ও জাতীয় নির্বাচনে কোন আসনে ৪০ শতাংশের কম ভোট হলে পুনরায় নির্বাচনের সুপারিশ করা হয়েছে।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
সংবিধান সংস্কার
সংবিধান সংস্কার কমিশনে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজকে প্রধান করা হয়। ক্ষমতার প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা কমানোসহ সংবিধানে আমূল পরিবর্তনের সুপারিশ করেছে কমিশন। দুই কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ, সংসদের আসন বাড়ানো, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, এক ব্যক্তির দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে না পারার সুপারিশ করা হয়েছে।
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/M. Ponir Hossain
বিচার বিভাগ সংস্কার
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন সুপ্রিম কোর্টের স্বাধীন সচিবালয়, বিচারক নিয়োগের জন্য স্বাধীন কমিশন, হাই কোর্টের বিভাগীয় বেঞ্চ, জেলা ও উপজেলা আদালত স্থাপনসহ নানা সংস্কারের সুপারিশ করেছে। প্রধান বিচারপতি নিয়োগে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত ও সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া, বিচারকদের শৃঙ্খলা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
পুলিশ সংস্কার কমিশন
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেয়া প্রতিবেদনে পুলিশ সংস্কার কমিশন বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করেছে। বল প্রয়োগ, আটক, গ্রেপ্তার, তল্লাশি, জিজ্ঞাসাবাদ, মানবাধিকার, প্রভাবমুক্ত ও জবাবদিহিমূলক বাহিনী গঠন, থানায় জিডি রেকর্ড, মামলা রুজু, তদন্ত ও ভ্যারিফিকেশনসহ বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কারের সুপারিশ করেছে পুলিশ সংস্কার কমিশন। পুলিশের সেবামূলক ও জনবান্ধব কার্যক্রম বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে।
ছবি: Nazmul Hasan/DW
দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন
দুদক সংস্কার কমিশনের দায়িত্ব পান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। একটি সংস্কার কমিশন গঠিত হয় এবং কমিশন দুর্নীতি প্রতিরোধে ৪৭টির মতো সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে। দুদককে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা শক্তিশালীকরণকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এই প্রতিবেদনে।
ছবি: Mamunur Rashid/NurPhoto/picture alliance
জনপ্রশাসন সংস্কার
জনপ্রশাসন সংস্কারকে একটি চলমান প্রক্রিয়া হিসেবে উল্লেখ করে কমিশন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর উপর বেশ কিছু কাঠামোগত ও পদ্ধতিগত সংস্কারের সুপারিশ করেছে। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে তথ্য ও যোগাযোগ বিভাগকে আলাদা করা, ফরিদপুর ও কুমিল্লাকে বিভাগ ঘোষণা, নাগরিক পরিষেবা উন্নয়নে প্রশাসনের ডিজিটাল রূপান্তর, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের কাঠামো ও প্রক্রিয়াগত সংস্কারের উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
ছবি: bdnews24.com
6 ছবি1 | 6
কিছুদিন আগে এনসিপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা নাসিরউদ্দীন পাটোয়ারী একটা কথা জনসমক্ষে বলেছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘যদিও বলা হচ্ছে যে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে, কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে না।' মি. পাটোয়ারী এমন কথা কেন বললেন? কেবলই মনে হলো আর বলে দিলেন? তা কী করে হয়? উনি তো এলেবেলে কোনো লোক নন। এনসিপির মূখ্য সমন্বয়ক। আর এনসিপি নতুন দল এবং এখনো এর নিবন্ধন না হলেও, এ দলটি সরকারের কাছে খুবই গুরুত্ব পায়। এই আওয়ামী লীগের মতো দলকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধের মাধ্যমে নির্বাচনের বাইরে রাখা, এ পেছনে দৃশ্যত এনসিপির দাবিই ছিল সবচেয়ে জোরালো। সে সময় প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে যে বিক্ষোভ হয়েছিল তার নেতৃত্বে ছিলেন এনসিপির আর এক নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ। মাঝে একবার নানা রাজনৈতিক অস্থিরতায় প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস সম্ভবত খুব বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন। সেই সময় তিনি পদত্যাগের কথাও ভাবছিলেন বলে আমরা জানতে পারলাম। কীভাবে জানলাম? এনসিপির নেতা নাহিদ ইসলাম জানালেন। তিনি গিয়েছিলেন ড. ইউনূসের সঙ্গে দেখা করতে। ইউনূস সাহেব এ বিষয়টি নাহিদ ইসলামের সঙ্গে শেয়ার করেছিলেন। সেখান থেকে বের হয়ে এসে নাহিদ ইসলাম সংবাদ মাধ্যমকে জানালেন প্রধান উপদেষ্টার আবেগ মিশ্রিত মানসিক অবস্থার কথা। এই ঘটনা থেকেই বোঝা যায় এনসিপির সঙ্গে সরকার প্রধানের সম্পর্কের গভীরতাটি।
তাই এহেন এনসিপি যখন আবদার করল ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের জন্য, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের জন্য, দেখা গেল দ্রুততার সঙ্গেই সেসব দাবি পূরণ করা হলো। সেই এনসিপিই এখন আবার দাবি করছে গণপরিষদ নির্বাচন ও শেখ হাসিনার বিচারের। শেখ হাসিনার বিচার এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। তার বিরুদ্ধে মামলা তো অনেক কটি, প্রায় সবগুলোই হত্যা মামলা। এসব মামলার নিষ্পত্তি কি এত দ্রুত করা সম্ভব? এটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কিন্তু মনে করুন, মাস কয়েক আগের কথা, এনসিপির আর এক নেতা সারজিস আলম কিন্তু বলেছিলেন—হাসিনার বিচার না হওয়া পর্যন্ত কেউ যেন নির্বাচনের কথা না বলে! তাহলে?
মতৈক্যে পৌঁছালেই নির্বাচন: ড. ইউনূস
01:39
This browser does not support the video element.
এনসিপি যে গণপরিষদ নির্বাচনের কথা বলছে, সেটা মূলত নতুন সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে। যদিও এরই মধ্যে সংবিধানের মৌলিক বিষয়গুলোর পরিবর্তনের বিষয়ে বাম দলগুলো ও বিএনপি আপত্তি জানিয়েছে। তাই একেবারে নতুন সংবিধান হয়তো আর হবে না। তারপরও সংবিধানে যে সকল জায়গায় পরিবর্তন আনার বিষয়ে প্রায় সকল রাজনৈতিক দলই একমত হয়েছে, সেগুলোও বাস্তবায়নের জন্য আগামীর রাজনৈতিক সরকারের উপর নির্ভর করতে চায় না এনসিপি। সে কারণেই তাদের দাবি একটা গণপরিষদ নির্বাচনের। তারা বলছে, গণপরিষদ ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন একই সঙ্গে হবে, একই লোক নির্বাচিত হবে। প্রথমে তারা গণপরিষদে বসবে, সংবিধান সংশোধন বা পরিবর্তন করবে, তারপর এরাই পরবর্তী ৫ বছরের জন্য সংসদ সদস্য হিসাবে কাজ করবে।
যতদূর যা দেখা যাচ্ছে, তাদের এই দাবি শেষ পর্যন্ত কতটুকু বাস্তবায়িত হবে তা নিয়ে অনেকেরই সন্দেহ রয়েছে। কিন্তু দাবি আদায় না হলে তারা যদি নির্বাচন বর্জন করে? একই আশঙ্কা রয়েছেজামায়াতের ক্ষেত্রেও। তারাও যদি নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়? একবার ভাবুন বিষয়টা, ভিজ্যুয়ালাইজ করার চেষ্টা করুন। নির্বাচন একটা হচ্ছে, সেখানে আওয়ামী লীগ নেই, জামায়াতে ইসলামী নেই, এনসিপিও নেই! সেটাকে নির্বাচন বলা যাবে? সেটা তো ২০১৪ এর চেয়েও খারাপ হবে।
ভোটার হওয়ার বয়স কোন দেশে কত
বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও ভোটার হওয়ার ন্যূনতম বয়স ১৮৷ তবে সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ১৭ বছর বয়সেই ভোটাধিকার দেওয়া যেতে পারে। দেখা যাক বিশ্বের কোন দেশে ভোটার হওয়ার বয়স কত...
ছবি: Mortuza Rashed/DW
বেশিরভাগ গণতান্ত্রিক দেশের চিত্র
বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই ভোটার হওয়ার সর্বনিম্ন বয়স ১৮৷ বিশ্বের ৮৫ ভাগ দেশেই ১৮ বছর বয়সে ভোটাধিকার পায় জনগণ৷ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, জাপান, জার্মানি, ইটালি, ফ্রান্স, ক্যানাডা, অস্ট্রেলিয়া, কাতার, সাউথ আফ্রিকাসহ বেশির ভাগ গণতান্ত্রিক দেশই আছে এই তালিকায়৷
ছবি: Thomas Slusser/AP/picture alliance
বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশের অবস্থা
উপমহাদেশে বাংলাদেশের প্রতিবেশী সব দেশেই ভোটার হওয়ার বয়স ১৮ বছর। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান ও মালদ্বীপে ১৮ বছরের আগে কেউ ভোট দিতে পারে না। তালেবান ক্ষমতায় আসার আগে আফগানিস্তানেও ভোটার হওয়ার বয়স ছিলো ১৮ বছর৷ তালেবান ক্ষমতায় ফেরার পর আফগানিস্তানে আর ভোট হয়নি৷
ছবি: Anupam Nath/AP Photo/picture alliance
১৬ বছরে ভোট ১০টি দেশে
১৬ বছর বয়সেও ভোট দেওয়ার সুযোগ আছে কয়েকটি দেশে। এদের মধ্যে বেশিরভাগই ল্যাটিন অ্যামেরিকার দেশ৷ যেমন: ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ইকুয়েডর, কিউবা, নিকারাগুয়া৷ এছাড়া ছোট দেশ মাল্টা, জার্সি, গুয়ের্নসে এবং দ্য আইল অফ ম্যান এ ১৬ বছর বয়সে ভোট দেয়া যায়৷ ইউরোপের দেশ অস্ট্রিয়াতেও এই নিয়ম রয়েছে৷
ছবি: Matias Delacroix/AP Photo/picture alliance
১৭ বছর বয়সে ভোট
চারটি দেশে ১৭ বছর বয়সে ভোট দেয়ার অধিকার আছে৷ এর মধ্যে অন্যতম উত্তর কোরিয়া৷ এছাড়া গ্রিস, তিমুর লিসতে এবং ইন্দোনেশিয়াও আছে এই তালিকায়৷
ছবি: picture-alliance/AP/Dita Alangkara
১৯ ও ২০ বছরে ভোটাধিকার
সলোমন দ্বীপপুঞ্জ একমাত্র দেশ যেখানে ১৯ বছর বয়সে ভোটাধিকার পাওয়া যায়৷ তাইওয়ান, ক্যামেরুন, বাহরাইন, নাউরুতে ভোটাধিকার প্রাপ্তির বয়স ২০ বছর৷
ছবি: picture-alliance/AA/J. P. Kepseu
২১ ও ২৫ বছর বয়সে ভোটাধিকার
রাজনৈতিকভাবে রক্ষণশীল দেশ যেমন: কুয়েত, সিঙ্গাপুর, লেবানন, ওমান এবং টোঙ্গা, টোকেলাও, সামোয়াতে মানুষ ভোটাধিকার পান ২১ বছর বয়সে৷ সবচেয়ে বেশি বয়সে ভোটাধিকার পান সংযুক্ত আরব আমিরাতের মানুষ- ২৫ বছরে৷
ছবি: Jaber Abdulkhaleg/AP/picture alliance
জার্মানি
জার্মানিতে রাজ্য বা প্রাদেশিক নির্বাচনে ১৬টি রাজ্যের মধ্যে ৬টিতে ভোটারদের সর্বনিম্ন বয়স ১৬ বছর৷ এছাড়া ১১টি রাজ্যে পৌর নির্বাচনে ভোট দিতে পারেন ১৬ বছর বয়সিরা৷ বাকি প্রদেশ ও জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেয়ার সর্বনিম্ন বয়স ১৮ বছর।
ছবি: Getty Images/S. Gallup
স্থানীয় সরকার বা প্রাদেশিক নির্বাচন
এসব নির্বাচনের ক্ষেত্রে কয়েকটি দেশে ভোটারের বয়স সাধারণ নির্বাচনের চেয়ে ভিন্ন৷ এছাড়া পেশা এবং বৈবাহিক অবস্থার ওপরও বয়সের তারতম্য নির্ভর করে৷ যেমন: সার্বিয়া, স্লোভেনিয়া এবং অন্য বলকান দেশগুলোতে ১৬ বছর বয়সে কেউ চাকরি পেলে ভোট দেয়ার অধিকার পায়৷ ইসরায়েলে ১৭ বছর বয়সে পৌর নির্বাচনে ভোট দেয়া যায়৷ বেলজিয়াম ও জার্মানির মানুষ ১৬ বছর বয়সে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্ট নির্বাচনে ভোট দিতে পারে৷
ছবি: Kenzo TRIBOUILLARD/AFP
ছবিঘরের তথ্যসূত্র
ছবিঘরের তথ্য নেয়া হয়েছে স্বাধীন অলাভজনক সংস্থা ‘ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ’ থেকে৷ যারা তাদের ওয়েবসাইটে ২৩০টি দেশের তথ্য তুলে ধরেছে৷ লিংক: https://worldpopulationreview.com/country-rankings/voting-age-by-country
ছবি: Go Nakamura/REUTERS
9 ছবি1 | 9
আমার কেন যেন মনে, সম্ভবত এই সমীকরণকে মাথায় রেখেই এনসিপি, গণঅধিকার পরিষদরা দাবি করছে জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করার। অনেকে বলছেন, এই দুই দলের দাবির পিছনেই জামায়াতের শক্ত সমর্থন রয়েছে। তারা বুঝতে পারছে, জাতীয় পার্টিকেও যদি আওয়ামী লীগের মতো মাঠ থেকে সরিয়ে দেওয়া যায়, তখন নির্বাচনের নাটাই পুরোপুরোই জামায়াত ও এনসিপির হাতে থাকবে। বিষয়টা বোধকরি বিএনপিও উপলব্ধি করতে পেরেছে। সে কারণে তারা এরই মধ্যে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে—বিএনপি কোন রাজনৈতিক দলের নিষিদ্ধের পক্ষে থাকবে না। এখন এটাই যদি বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থান হয়, তাহলে কিন্তু অনেকে এমন প্রশ্নও করতে পারেন—তাদের এই নীতি আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তের সময় কোথায় ছিল? বাধা দেওয়া দূরে থাক, তারা ন্যূনতম একটা বিবৃতি দিতে পারত! তাও তো তারা করেনি। এখন যখন নিজের গায়ে লাগছে, তখন শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। আসলে আমাদের দেশের রাজনীতির এটাই চরিত্র। সকলে কেবল নিজের স্বার্থটাই দেখছে। যারা বড় দল তারা নিজেদের শেয়ার কমবে মনে করে পিআর-এর বিরোধিতা করছে। আর ছোট দলগুলো ৫-১০ আসনের আশায় পিআর-এর পক্ষে মাঠ গরম করছে। দুজায়গাতেই তারা উচ্চারণ করছে জনস্বার্থের কথা, কিন্তু ভাবছে নিজের দল আর নেতার স্বার্থের কথা।
কিন্তু যে কথা বলছিলাম, নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার কথা। এই যে এতক্ষণ জামায়াত বা এনসিপির দাবিগুলোর কথা বললাম—এসবই আসলে ইদানীং এত বেশি বেশি আলোচিত হচ্ছে যে, মানুষের মনে সন্দেহ জেগেছে নির্বাচন হওয়া না হওয়া নিয়ে। এই অনিশ্চয়তার পাশাপাশি রয়েছে আরও একটা বড় আশঙ্কা। ড. ইউনূস এরই মধ্যে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে বলেছেন—তিনি নাকি জাতিকে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ নির্বাচন উপহার দেবেন! তিনি ঠিক কোন বাস্তবতার উপর ভিত্তি করে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করছেন, আমি বুঝি না। আওয়ামী লীগ একটা বড় দল, দেশজুড়ে তার বিপুল কর্মী সমর্থক। আওয়ামী লীগ একটা বংশানুক্রমিক দল। দেশে এমন অনেক পরিবার আছে যেখানে দুই তিন প্রজন্ম ধরে আওয়ামী লীগ করে, নৌকায় ভোট দেয়। তাদেরকে আপনি একটা নির্বাহী আদেশ দিয়ে অনন্তকালের জন্য একেবারে ঘরে বসিয়ে দেবেন, এটা বাস্তবসম্মত চিন্তা নয়। আসন্ন নির্বাচনে তাদের ভূমিকা কী থাকবে? ঠিক এই জায়গাটিতেই অনেকে নানামুখী আশঙ্কা দেখেন। ২০১৪ সালে আমরা দেখেছি, নির্বাচন বানচাল করার জন্য নানা ধরনের সহিংসতা। ২০২৬ কী হবে কে জানে!
আর একটা কথা বলে লেখাটা শেষ করব। ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে ড. ইউনূসকে যখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব দেওয়া হয়, তখন আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য সব রাজনৈতিক দলের নিরঙ্কুশ সমর্থন ছিল তার প্রতি। ধীরে ধীরে তা কিছুটা কমলেও এখনো মাঠে থাকা সকল রাজনৈতিক দলই রয়েছেন তার সঙ্গে। এত বিপুল সমর্থন নিয়ে এর আগে এই দেশে আর কোন ব্যক্তি সরকারের দায়িত্ব নেননি। এত সমর্থনের পরও, উনি যখন নির্বাচনের ঘোষণা দেন, সে অনুযায়ী যথাসময়ে সকল কাজকর্ম করতে থাকেন, তখনও তার সেই ঘোষণার প্রতি সাধারণ মানুষের প্রত্যয় জন্মায় না কেন? মানুষ কেন তাঁর কথায় আর আস্থা রাখতে পারেন না?