নির্বাচনি ডামাডোলে সাংবাদিক নির্যাতনের অপরাধ আড়ালে
২৮ নভেম্বর ২০২৩![সাংবাদিকদের উপর হামলার ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি, কেউ গ্রেপ্তারও হয়নি।](https://static.dw.com/image/67247489_800.webp)
গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির সমাবেশের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে নির্যাতিত হন অন্তত ৩০ জন সাংবাদিক। ওই দিনের নানা ঘটনায় প্রায় দেড়শ' মামলা হয়। গ্রেপ্তার করা হয় বিএনপির সহস্রাধিক নেতা-কর্মীকে। কিন্তু সাংবাদিকদের উপর হামলার ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি, কেউ গ্রেপ্তারও হয়নি।
বাংলাদেশে সাংবাদিকরা নির্যাতিত হলে সাংবাদিক সংগঠনগুলো সোচ্চার হয়, কয়েকদিন মানববন্ধন, সমাবেশ হয় এরপর সবকিছু থেমে যায়, নির্যাতনকারীরা থেকে যায় বহাল তবিয়তে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সাংবাদিক সংগঠনগুলো আন্দোলন করেছে, দেশি ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো থেকে বিবৃতি এসেছে, কিন্তু কাজের কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
২৮ অক্টোবর সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে হামলার শিকার হন দৈনিক কালবেলার স্টাফ রিপোর্টার রাফসান জনি। ডয়চে ভেলেকে তিনি জানান, সেদিন কাকরাইল মোড়ের পাশে আইল্যান্ডে দাঁড়িয়ে তিনি সংবাদ সংগ্রহ করছিলেন। এ সময় দেখেন বিএনপির কয়েকজন নেতা-কর্মী কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে মারধর করছেন। তখন ওই হামলাকারীরা তার উপরও চড়াও হন। তার মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেওয়া হয়। শরীরের বিভিন্ন স্থানে লাঠিসোঁটা দিয়ে আঘাত করে হামলাকারীরা। এক পর্যায়ে তারা চলে গেলে স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। কিছুদিন হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার পর বাড়িতে ফিরলেও এখনও শরীরিকভাবে অসুস্থ বলে জানান রাফসান জানি।
এই ঘটনায় কী কোনো আইনগত পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, "আমি যখন হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম তখন অনেক পুলিশ কর্মকর্তা আমাকে দেখেতে এসেছেন। তাদের আমি মৌখিকভাবে ঘটনা বলেছি। তারা সিসিটিভি ফুটেজ দেখে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত ওই ঘটনায় একজনও গ্রেপ্তার হয়নি। ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের কমিশনার হাবিবুর রহমান নিজেও আমার সঙ্গে কথা বলেছেন। তারপরও কোনো ব্যবস্থা আমি দেখিনি। আরেকটু সুস্থ হলে আমি আইনগত পদক্ষেপ নেবো।”
২৮ অক্টোবরের ঘটনায় তো অনেকগুলো মামলা হয়েছে। পুলিশ বাদি হয়ে করেছে অধিকাংশ মামলা। এর মধ্যে কি সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায় কোনো মামলা হয়েছে? বা কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে? পল্টন থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সালাহউদ্দিন মিয়া ডয়চে ভেলেকে বলেন, "না, ওই দিনের ঘটনায় যে মামলাগুলো হয়েছে. তার মধ্যে সাংবাদিক নির্যাতনের কোনো মামলা নেই। এই সংক্রান্ত কোনো অভিযোগে কাউকে গ্রেপ্তার বা আটকও করা হয়নি। তবে আমরা সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করছি, সেখানে কাউকে পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর বাইরেও অনেকগুলো সংস্থা এসব বিষয় নিয়ে কাজ করছে।”
গত ২০ নভেম্বর ধানমন্ডিতে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছে অনলাইন সংবাদমাধ্যম জাগো নিউজের স্টাফ রিপোর্টার নাহিদ হাসান। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, "একটা সংঘর্ঘের খবর পেয়ে আমি ধানমন্ডিতে যাই। সেখানে গিয়ে আমি জানতে পারি এই সংঘর্ষে নিউ মডেল ডিগ্রি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম জড়িত। তখন আমি তাকে ফোন করি। তিনি আমার অবস্থান জেনে ৫ মিনিটের মধ্যে সামনে এসে কথা বলবেন বলে জানান। কয়েক মিনিটের মধ্যে আমার সামনে কয়েকটি মোটরসাইকেলে সঙ্গীদের নিয়ে হাজির হন রাকিবুল। কোনো কথা বলার আগেই তারা আমাকে মারতে শুরু করে। আমি নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কথা বলার চেষ্টা করলেও তারা কিছুই শোনেনি। এক পর্যায়ে আমার মোবাইল ফোন নিয়ে গ্যালারি চেক করে দেখে আমি তাদের কোনো ছবি তুলেছি কিনা। নির্যাতনের মধ্যে রাকিবুল ছাড়াও স্থানীয় যুবলীগ নেতা তানজিদ রহমানকে আমি চিনতে পারি। এরপর কয়েকদিন হাসপাতালে থেকে চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরেছি। অসুস্থতা নিয়েও আমি ধানমন্ডি থানায় একটি অভিযোগ দিয়েছি। সেখানে ওই দুই জনের নামও উল্লেখ করেছি। কিন্তু পুলিশের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কাউকে গ্রেপ্তার করার খবর আমি পাইনি।”
সাংবাদিক নাহিদ হাসানের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ধানমন্ডি থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) পারভেজ ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, "তার অভিযোগটি আমরা সাধারণ ডায়েরি হিসেবে রেকর্ড করেছি। এটার তদন্ত করার জন্য আদালতের অনুমতি চেয়ে পাঠানো হয়েছে। অনুমতি পেলে তদন্ত করা হবে।” এই ঘটনায় কাউকে গ্রেপ্তার বা আটক করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে ওসি বলেন, "না, কাউকে আমরা গ্রেপ্তার বা আটক করিনি।”
তবে ঘটনার পর অভিযুক্তরা যোগাযোগ করে ক্ষমা চেয়েছেন বলে জানিয়েছেন সাংবাদিক নাহিদ হাসান। তিনি বলেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপসের এপিএস নাসিরুল ইসলাম সজীবের খালাতো ভাই অভিযুক্ত যুবলীগ নেতা তানজিদ রহমান। সজীব ভাই তানজিদকে সঙ্গে নিয়ে আমার কাছে এসেছিলেন। ভুল হয়ে গেছে বলে ক্ষমা চেয়েছেন। এই পর্যন্তই। এর বাইরে আর কোনো উদ্যোগ আমি দেখিনি।''
সাংবাদিক নাহিদ হাসানের উপর হামলার ঘটনায় মঙ্গলবার বিবৃতি দিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব জার্নালিস্ট (আইএফজে)। বিবৃতিতে তারা বলেছে, ২০ নভেম্বর ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাথে যুক্ত একটি যুব ও ছাত্র সংগঠনের সদস্যদের সাথে জড়িত একটি সংঘর্ষ কভার করার সময় সাংবাদিক নাহিদ হাসান ২০ থেকে ২৫ জনের একটি দল দ্বারা লাঞ্ছিত হন। আইএফজে এই হামলার নিন্দা করেছে। দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহি করতে এবং কর্মরত সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান তারা। গত কয়েক মাসে, আইএফজে বাংলাদেশে ছাত্রলীগসহ ছাত্র সংগঠনের সদস্যদের দ্বারা সাংবাদিকদের হয়রানি ও সহিংসতার বেশ কয়েকটি অনুরূপ ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। গত ৯ নভেম্বর ছাত্র সাংবাদিক আবু সাঈদ রনি ও আব্দুল আলিমকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা মারধর করেন। সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সাংবাদিক মোশাররফ শাহের উপর হামলা করে ছাত্রলীগ। আইএফজে বলছে, রাজনৈতিক গোষ্ঠীর দ্বারা সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীদের উপর হামলা বৃদ্ধি গভীরভাবে উদ্বেগজনক এবং কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে।
এর ১৯ দিন আগে, অর্থাৎ ৯ নভেম্বর আইএফজে আরেকটি বিবৃতি দিয়েছিল। সেখানে ২৮ অক্টোবরের সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায় হামলাকারীদের বিচার দাবি করা হয়। সেখানে তারা বলে, আগামী জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই সাংবাদিকরা ক্রমবর্ধমান প্রতিকূল পরিবেশ এবং ব্যাপক সেন্সরশিপের সম্মুখীন হচ্ছেন। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলিতে, বাংলাদেশের সাংবাদিকরা বিভিন্ন ধরনের চাপের সম্মুখীন হয়েছেন, যার মধ্যে রয়েছে আইনি পদক্ষেপ, পুলিশি আগ্রাসন, অনলাইন হয়রানি, রিপোর্ট করার সময় হামলা এবং তাদের পরিবারের প্রতি হুমকি। বাকস্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংগঠন ‘আর্টিকেল-১৯'-এর প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন, হয়রানি ও আক্রমণ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি।
২৭ বছরে ৩৫ সাংবাদিক হত্যা, বিচার হয়েছে তিনজনের
রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের বাসায় ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার-মেহেরুন রুনি। হত্যাকাণ্ডের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জড়িতদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী; কিন্তু এক যুগের বেশি সময় পার হলেও হত্যারহস্য উদ্ঘাটন হয়নি। বিচার পায়নি পরিবার। শুধু সাগর-রুনি নন, ১৯৯৬ সাল থেকে ২০২৩ পর্যন্ত ২৭ বছরে বাংলাদেশে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন অন্তত ৩৫ জন সাংবাদিক। হত্যাকাণ্ডের এই তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে জামালপুরের সাংবাদিক গোলাম রব্বানি নাদিমের নাম।
সাংবাদিক হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের ঘটনাগুলোর মধ্যে মাত্র তিনটি হত্যাকাণ্ডের বিচার নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে খুলনায় সাংবাদিক হারুন অর রশিদ হত্যাকাণ্ডে ফাইনাল রিপোর্ট দিয়েছে পুলিশ। অর্থাৎ, খুনি কাউকে খুঁজে পাইনি পুলিশ। মানিক সাহা হত্যাকাণ্ডের রায় হলেও তার পরিবার ও সাংবাদিক সমাজ সেই রায় মানেনি। ফরিদপুরের সাংবাদিক গৌতম দাস হত্যাকাণ্ডে নিন্ন আদালতে রায় হলেও এখনো চূড়ান্ত রায় হয়নি। এই ফাঁকে সব আসামি কারাগার থেকে বেরিয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে)-র সাবেক সভাপতি ও সিনিয়র সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল ডয়চে ভেলেকে বলেন, "একজন সাংবাদিক নির্যাতিত হলে তার পক্ষে প্রথম অবস্থান নিতে হবে প্রতিষ্ঠানকে। দু-একটি প্রতিষ্ঠান বাদে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানকে আমরা এই ভূমিকা নিতে দেখি না। এরপর দায়িত্ব রয়েছে সাংবাদিক ইউনিয়নের। কিন্তু আন্দোলন সংগ্রাম করা ছাড়া তাদের কারো পক্ষে আইনি লড়াই করার মতো পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। তারা আন্দোলন সংগ্রাম করছে, কিন্তু সরকারকে তো ব্যবস্থা নিতে হবে। সেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না বলেই সাংবাদিকদের উপর হামলাকারীরা সব সময় ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই থাকছেন।”
দুই বছর আগে সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় সোচ্চার বৈশ্বিক সংগঠন ‘কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)-র গ্লোবাল ইমপিউনিটি ইনডেক্সে বলা হয়, বিশ্বে সাংবাদিক হত্যার বিচার না হওয়া দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১তম।
সেই প্রতিবেদন প্রকাশের পরও বাংলাদেশে সাংবাদিক নির্যাতন, সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনা কমেনি৷
গত ১০ মাসে, অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ২৬০ জন সাংবাদিক বাংলাদেশে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান বলছে এই কথা৷ আসক বলছে, ওই ২৬০ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হয়রানি, মামলা, হুমকি ও পেশাগত দায়িত্ব পালনে গিয়ে বাধার শিকার হয়েছেন। এছাড়া এ সময়ে হত্যার শিকার হয়েছেন একজন সাংবাদিক।