নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টি একাই পেয়েছে ৫৪৩টি আসনের মধ্যে ২৮৫টি আসন৷ আর জোটসঙ্গিদের নিয়ে ঐ সংখ্যা পৌঁছে গেছে ৩৩৫-এ৷ কংগ্রেস সেখানে পেয়েছে মাত্র ৪৮টি আসন৷
বিজ্ঞাপন
২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের ভোটের ফলাফল ঘোষণার প্রতীক্ষা শেষ৷ বিজেপির প্রতীক চিহ্ন পদ্মফুলের সৌরভে গোটা দেশ আ-মোদিত৷ শুরু হবে ভারতে উন্নয়নের নতুন যুগ, বলেছেন বিজেপি সভাপতি রাজনাথ সিং৷ সংসদের মোট ৫৪৩টি আসনের মধ্যে বিজেপি একাই ২৮৫টি আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে৷ জোট শরিকদলগুলিকে নিয়ে সংখ্যাটা দাঁড়িয়েছে ৩৩৫-এ৷
এরপর আর কী? ভারতের চতুর্দশ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদী সম্ভবত শপথ নেবেন আগামী মঙ্গলবার ২০শে মে৷ আর বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং শনিবার ১৭ই মে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে তাঁর মন্ত্রিসভার পদত্যাগপত্র পেশ করবেন৷ উল্লেখ্য, নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ায় পদে পদে সরকারের সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে বিজেপিকে শরিক দলগুলির মুখাপেক্ষি হয়ে আর থাকতে হবে না, যার জন্য প্রতি পদক্ষেপে বাধা পেয়ে মনমোহন সিং সরকারকে নীতি পঙ্গুত্বের অভিযোগ শুনতে হয়েছিল৷
একজন নরেন্দ্র মোদী
উগ্র সাম্প্রদায়িক আদর্শ এবং বিভাজনের রাজনীতির কারণে ভারতের বহু মানুষের কাছে তিনি খলনায়ক৷ ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নিজেকে নতুন মোড়কে সামনে এনে সেই নরেন্দ্র মোদীই শোনাচ্ছেন ভারতকে বদলে দেয়ার মন্ত্র৷
ছবি: dapd
চা ওয়ালা
১৯৫০ সালে গুজরাটের নিম্নবিত্ত এক ঘাঞ্চি পরিবারে জন্ম নেয়া নরেন্দ্র মোদী কৈশরে বাবাকে সাহায্য করতে রেল ক্যান্টিনে চা বিক্রি করেছেন৷ ঘাঞ্চি সম্প্রদায়ের রীতি অনুযায়ী ১৭ বছর বয়সে যশোদাবেন নামের এক বালিকার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়, যদিও বেশিদিন সংসার করা হয়নি৷ ছাত্র হিসেবে সাদামাটা হলেও মোদী বিতর্কে ছিলেন ওস্তাদ৷ ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস-এর প্রচারক হিসাবে রাজনীতির দরজায় পা রাখেন মোদী৷
ছবি: UNI
গুজরাটের গদিধারী
১৯৮৫ সালে আরএসএস থেকে বিজেপিতে যোগ দেয়ার ১০ বছরের মাথায় দলের ন্যাশনাল সেক্রেটারির দায়িত্ব পান ১৯৯৫ সালে গুজরাটের নির্বাচনে চমক দেখানো মোদী৷ ১৯৯৮ সালে নেন দলের জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব৷ ২০০১ সালে কেশুভাই প্যাটেলের স্বাস্থ্যের অবনতি হলে দলের মনোনয়নে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে আবির্ভূত হন নরেন্দ্র মোদী, যে দায়িত্ব তিনি এখনো পালন করে চলেছেন৷
ছবি: Reuters
দাঙ্গার কালিমা
মোদীকে নিয়ে আলোচনায় ২০০২ সালের দাঙ্গার প্রসঙ্গ আসে অবধারিতভাবে৷ স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে ভয়াবহ সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গুজরাটে প্রায় ১২০০ মানুষ নিহত হন৷ মোদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েও তিনি দাঙ্গায় উসকানি দেন৷ তিনি এ অভিযোগ স্বীকার করেননি, আদালতও তাঁকে রেহাই দিয়েছে৷ তবে দাঙ্গার পক্ষে কার্যত সাফাই গেয়ে, হিন্দুত্ববাদের গান শুনিয়েই তিন দফা নির্বাচনে জয় পান মোদী৷
ছবি: AP
রূপান্তর
দাঙ্গার পর নিজের ভাবমূর্তি ফেরানোর উদ্যোগ নেন নরেন্দ্র মোদী৷ একজন বিতর্কিত নেতার বদলে উন্নয়নের কাণ্ডারি হিসাবে তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিতে শুরু হয় ‘গুজরাট মডেল’-এর প্রচার৷ ২০০৭ সালের পর নিজেকে একজন সর্বভারতীয় নেতা হিসাবে তুলে ধরতে নতুন প্রচার শুরু করেন এই বিজেপি নেতা, প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্র্যান্ড মোদী’৷গুজরাটের উন্নয়নের চিত্র দেখিয়ে কলঙ্কিত ভাবমূর্তিকে তিনি পরিণত করেন ভারতের ত্রাতার চেহারায়৷
ছবি: UNI
ভারতের পথে পথে
ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌঁড়ে নরেন্দ্র মোদী পাড়ি দিয়েছেন তিন লাখ কিলোমিটার পথ৷ সারা ভারতে পাঁচ হাজার ৮২৭টি জনসভায় তিনি অংশ নিয়েছেন, নয় মাসে মুখোমুখি হয়েছেন পাঁচ কোটি মানুষের৷ কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা হিসাবে শুরু করলেও এবার তিনি হিন্দুত্ব নিয়ে প্রচার এড়িয়ে গেছেন সচেতনভাবে, যদিও বাংলাদেশের মানুষ, ভূখণ্ড এবং ধর্ম নিয়ে নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি নেতাদের বক্তব্য নতুন সমালোচনার জন্ম দিয়েছে৷
ছবি: AP
নতুন ইতিহাস
ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটই যে এবার ভারতে সরকারগঠন করতে যাচ্ছে, বুথফেরত জরিপ থেকে তা আগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল৷ ৬৩ বছর বয়সি মোদীর নেতৃত্বে এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি৷ ৭ই এপ্রিল থেকে ১২ই মে অনুষ্ঠিত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এ নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ৮১ কোটি ৪০ লাখ৷ তাঁদের মধ্যে রেকর্ড ৬৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ ভোট দিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শেষ হাসি
নির্বাচনে বিজেপির প্রতিশ্রুতি ছিল – মোদী প্রধানমন্ত্রী হলে দেশের অর্থনীতি নতুন গতি পাবে, গুজরাটের আদলে তিনি ভারতকে বদলে দেবেন৷ অবশ্য সমালোচকরা বলছেন, ‘কলঙ্কিত ভাবমূর্তি’ ঢাকতে এসব মোদীর ফাঁপা বুলি৷ তাঁর স্বৈরাচারী মেজাজ, শিক্ষা ও অর্থনীতির জ্ঞান নিয়েও ঠাট্টা-বিদ্রুপ হয়েছে৷ বলা হচ্ছে, ভোটাররা টানা তৃতীয়বার কংগ্রেসকে চায়নি বলেই বিজেপি জয় পেয়েছে৷ যদিও শেষ হাসি দেখা যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদীর মুখেই৷
ছবি: dapd
7 ছবি1 | 7
এদিকে মোদীর সাফল্যে অভিনন্দন বার্তা পাঠিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন৷ বলেছেন, ‘‘আপনার বিপুল জয় দু'দেশের দ্বিপাক্ষিক মৈত্রী সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হবে৷'' অনুরুপ বার্তা পাঠিয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফও মোদীকে পাকিস্তান সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন৷
অন্যদিকে সাম্প্রতিককালে কংগ্রেসকে এত বড় নির্বাচনি বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হয়নি৷ কংগ্রেস সাকুল্যে পেয়েছে মাত্র ৪৮টি আসন৷ তাই প্রধান বিরোধী দলও হতে পারবে না তারা৷ জোট সঙ্গীদের নিয়ে কংগ্রেস পেয়েছে ৬১টি আসন৷ কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী এবং পুত্র রাহুল গান্ধী দলের পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছেন নতমস্তকে৷ সোনিয়ার মতে, রাজনীতিতে জয়পরাজয় আছে৷ রাহুল দলের বিপর্যয়ের জন্য দায়ী করেছেন নিজেকে৷ তবে বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচনের মুখে অন্ধ্রপ্রদেশ বিভাজন রাজনৈতিক দিক থেকে কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত ঠিক হয়নি৷ তার খেসারত দিতে হয়েছে কংগ্রেসকে৷ সীমান্ধ্র এবং তেলেঙ্গানা দুই রাজ্যেই কংগ্রেসের ভরাডুবি৷ অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টির উত্থানও পড়েছে মুখ থুবড়ে৷ তারা পেয়েছে মাত্র চারটি আসন৷
গত ৩০ বছরে বিজেপি এত বড় সাফল্যের মুখ এর আগে আর দেখেনি৷ বিজেপির এই সাফল্যের প্রাণপুরুষ কী মোদী? বিশ্লেষকদের মতে, ‘‘হ্যাঁ, অনেকটাই তাই৷'' শুধু ভোটের কৌশলনীতি বা অঙ্গীকার নয়, মৌলিক ম্যানেজমেন্ট ও বিপণন নীতির ফলেই সফল হয়েছে তাঁর ‘‘মিশন ২৭৩-প্লাস''৷
মোদী মূল মন্ত্র করেন দুর্নীতি দমন, সুশাসন আর উন্নয়নকে৷ আর সেই বার্তা তিনি পৌঁছে দিতে পেরেছেন দেশের গ্রামে-গঞ্জে৷ এই কর্মসূচির সফল রূপায়নে হিন্দুত্ববাদী সংঘ পরিবারকে পাশে নিয়ে চলা হবে মোদীর পক্ষে বড় চ্যালেঞ্জ৷ মোদীর চরিত্রে আছে বৈপরিত্যের মিশেল৷ সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে ঘৃণা আর উন্নয়ন ও সুশাসন নিয়ে ভালোবাসা৷
বিজেপির তৃণমূল স্তর থেকে উঠে ২০০১ সালে নরেন্দ্র মোদী প্রথম গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হন৷ ২০০২ সালের দাঙ্গার কাদা লাগে তাঁর গায়ে৷ কিন্তু তারপর গত ১২ বছরে অন্যান্য রাজ্যে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ হলেও গুজরাটে আর হয়নি৷ ২০০৭ আর ২০১২ সালের বিধানসভা নির্বাচনে জিতে তৃতীয়বার মুখ্যমন্ত্রী হয়ে ‘হ্যাটট্রিক' করেন৷ এবার গুজরাটের ২৫টি আসনের সবকটিতেই জিতেছেন বিজেপি প্রার্থীরা৷ তবে দক্ষিণী রাজ্যগুলিতে বিজেপির গৈরিক রং লাগেনি৷ তামিলনাড়ুতে জয়ললিতার দল পেয়েছে ৩৭টি আসন৷ তবে মোদী দুটি আসনেই জিতেছেন৷ গুজরাটের বদোদরায় ৫ লাখ ৭০ হাজার ভোটে আর বারাণসীতে জিতেছেন তিনি ৫৩ হাজার ভোটে৷