ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে গুটি গুটি পায়ে এসে গেছে পৌষ মাস। কাগজে-কলমে ছয় ঋতুর বাংলাদেশে পৌষ-মাঘ এ দুই মাস শীতকাল। সে হিসেবে শীত এসে গেছে। কিন্তু নির্বাচনের উত্তাপে এ বছর শীতার্তরা খানিকটা উপেক্ষিত রয়ে গেছে।
বিজ্ঞাপন
ঢাকায় অবশ্য এখনো শীত সেভাবে জাঁকিয়ে বসতে পারেনি। অন্যান্য বছর পৌষের শুরু থেকে শীত কাঁপন ধরালেও এ বছর যে তার কিছুটা ব্যতিক্রম হবে তা আগেই বলেছিলেন আবহাওয়াবিদরা। কারণ, পরপর কয়েকটি ঘূর্ণিঝড় এবং এল নিনোর প্রভাব। ফলে শীতের তীব্রতা বাড়তে দেরি বা তীব্রতা কিছুটা কমও হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছেন তারা। তবে আবহাওয়াবিদরা যাই বলুন, ঢাকার বাইরে শীত কিন্তু বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে। গত সপ্তাহে গ্রামে কয়েক দিন থাকতে গিয়ে সেটা বেশ ভালোই অনুভব করেছি। সঙ্গে দুই বাচ্চা ছিল। শীত মোকাবেলার জন্য তাদের মোটা একাধিক জ্যাকেট, হাত মোজা, পা মোজা, টুপি সবই পরাতে হয়েছে।
উত্তরের জেলাগুলোতে শীতের প্রকোপ বাড়তে শুরু করেছে। পঞ্চগড়ে ১৯ ডিসেম্বর তাপমাত্রা ছিল সর্বনিম্ন ৯ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে দরিদ্র, অসহায় ও ছিন্নমূল মানুষের দুর্ভোগ। শীতজনিত নানা রোগ বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের দুর্বল করে ফেলছে। প্রতি বছরের মত এবারও এসবই ঘটছে। কিন্তু একজন সংবাদকর্মী হিসেবে এ বছর দেশের নানা প্রান্ত থেকে শীতের দুর্ভোগ এবং শীতার্ত মানুষের খবর খুব একটা পাচ্ছি না।
ঢাকায় শীতের পোষাক ও উদযাপন
পৌষ মাসের আগমনী বার্তায় রাজধানী ঢাকায় শীতের প্রকোপ শুরু হয়েছে। কেনাকাটা বেড়েছে শীতের পোষাকের। ঢাকায় কিভাবে শীতের আগমনকে বরণ করছেন সাধারণ মানুষ, দেখুন ছবিঘরে।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
কোট ও ব্লেজারের বিক্রি ভালো
ঢাকার গুলিস্তান ও পল্টনের ফুটপাতের দোকানগুলোতে সকাল থেকেই পথচারীদের ভিড়। বিক্রেতারা জানান, ছয়শ টাকা থেকে শুরু করে আড়াই হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে পোষাকগুলো।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
কম্বল দাম ও চাহিদা
ঢাকার কম্বলের অন্যতম পাইকারি ও খুচরা বাজারগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে দেশি-বিদেশি কম্বলের সমান চাহিদা রয়েছে। বিদেশি কম্বল মূলত দুবাই, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, সৌদি আরব, ভারত, স্পেন থেকে আসছে। আকারভেদে সেগুলো বিক্রি হচ্ছে আড়াই থেকে ১২ হাজার টাকায়।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
যত শীত তত বিক্রি
ঢাকার গুলিস্তানের পাইকারি ও খুচরা কম্বল বিক্রেতা রকিবুল ইসলাম মনে করেন, ঢাকায় ৩-৪ বছর পর পর শীত তীব্র হয়। গত কয়েক বছরে তেমন শীত না পড়ায় এবার শীত বেশি পড়ার আশা করছেন তিনি। তিনি বলেন, যত বেশি শীত, আমাদের ব্যবসা তত ভালো।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
কমফোর্টারে আরাম
ঢাকার গুলিস্তানের পাইকারি ও খুচরা কম্বলের দোকানগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কিছু দোকানে কমফোর্টার বিক্রি হচ্ছে। পুরান ঢাকা থেকে কমফোর্টার কিনতে আসা সেলিনা পারভীন বলেন, কম্বলের চাইতে এর আরাম বেশি। তবে বিক্রেতারা দাম অনেক বেশি চাইছেন।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
দামে ও পছন্দে মিলছে না
ক্রেতারা জানান, এবারের শীতের পোষাকের দাম তুলনামূলক অনেক বেশি। যেটা পছন্দ হচ্ছে, সেটা দামে মিলছে না। আবার যেটার দাম নাগালের মধ্যে, সেই পোশাকের মান পছন্দ হচ্ছে না।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
কেনাকাটায় পিছিয়ে নেই পুরুষরা
ঢাকায় ফুটপাত, মার্কেট, শপিং মলে নারী ক্রেতাদের পাশাপাশি চোখে পড়ছে পুরুষ ক্রেতাদেরও। মূলত তাঁরা নিজেদের জন্যই শীতের পোশাক কিনতে আসছেন।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ফুটপাতে একদাম
ঢাকার গুলিস্তান, পল্টন, ফার্মগেটের ফুটপাথে শীতের কাপড় বিক্রি করছে এমন দোকানগুলোতে ঘুরে দেখা যায়, সেখানে অধিকাংশ দোকানেই “এক দাম” এ শীতের পোশাক বিক্রি হচ্ছে। দামদর করার ঝামেলা এড়াতে সীমিত লাভে বিক্রেতারা পোষাকগুলো বিক্রি করছেন বলে দাবি তাদের।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
শীতে বাড়ে জুতার চাহিদা
ঢাকার গুলিস্তানের জুতা বিক্রেতা মোঃ শাহজাহান মিয়া বলেন, “গরমের সিজনে স্যান্ডেল আর শীতে বাড়ে জুতার চাহিদা। এখন তাই জুতার দামও কিছুটা বেশি।“
ছবি: Mortuza Rashed/DW
চলাচলের রাস্তা বন্ধ করে চলছে ব্যবসা
ঢাকার শীতের পোশাকের অন্যতম বড় খুচরা বাজার গুলিস্তানে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে চলাচলের একটি রাস্তা সম্পূর্ণ বন্ধ করে কেনাবেচা করছেন বিক্রেতারা। রাস্তাটিতে ক্রেতাদের উপচে পড়া ভীড়ের কারণে আশেপাশের সড়কে সৃষ্টি হচ্ছে তীব্র যানজটের।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
অভিজাত দোকানে ভিড় কম
ঢাকার ধানমন্ডির অভিজাত দোকান ও শপিং মলগুলোতে ঘুরে দেখা যায়, সেখানে এখনো শীতের পোশাক বিক্রি জমে উঠেনি। তবে শীত বাড়ার সাথে সাথে বিক্রি বাড়ার ব্যাপারেও আশাবাদী বিক্রেতারা।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ফ্যাশন হাউজগুলোর স্টাইলিশ কালেকশন
ঢাকার বসুন্ধরা সিটি শপিং মল, রাপা প্লাজাসহ বিভিন্ন ফ্যাশন হাউজগুলো ঘুরে দেখা যায়, সেখানে শীতের জন্য স্টাইলিশ ও এক্সক্লুসিভ সব কালেকশন আনছেন তাঁরা। ক্রেতাদের সাড়াও পাচ্ছেন ভালো।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
এলাকাভিত্তিক মৌসুমি ব্যবসা
ঢাকার মিরপুরের আগারগাঁও, কাজীপাড়া, তালতলা এলাকাগুলোতে ঘুরে দেখা যায়, সেখানে এলাকাভিত্তিক ব্যবসায়ীরা শীতের পোশাক বিক্রি করছেন। তাঁরা জানান, সারা বছর অন্যান্য পণ্যের ব্যবসা করলেও শীতের মৌসুমে তাঁরা শীতের পোশাকই বিক্রি করেন।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ভোরে শীত বেশি
প্রতিদিন ভোরে কাজে বেরিয়ে পড়তে হয় মিরপুরের বাসিন্দা আফজাল হোসেনকে। তিনি বলেন, মাঝ রাত থেকে ভোরের সময়টা পর্যন্ত কুয়াশা ও শীতের তীব্রতা থাকে বেশি। মূলত এ সমইয়টাতে একাধিক শীতের পোশাক গায়ে না জড়ালে টেকা মুশকিল।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
শীতের আকর্ষণ গুড়
বাংলাদেশে শীতের অন্যতম আকর্ষণ গুড়। আখের গুড় প্রায় সারা বছর পাওয়া গেলেও খেজুর গুড়ের চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে শীতের মৌসুমে। ছবিতে ঢাকার অদূরে মানিকগঞ্জে এক গাছির বাসায় খেজুরের রস থেকে গুড় প্রস্তুত করতে দেখা যাচ্ছে।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
নানা স্বাদের পিঠা
শীতের মৌসুমে বিভিন্ন ভ্রাম্যমাণ দোকানে নানা স্বাদের ঝাল ও মিষ্টি পিঠা বিক্রি করতে দেখা যায়। এর মধ্যে রয়েছে ডিম পিঠা, পাকন পিঠা, তেল পিঠা, চিতই পিঠা, ভাপা পিঠা, পাটিসাপটা পিঠা, পুলি পিঠা ইত্যাদি। দাম সাধ্যের মধ্যে হওয়ায় দোকানগুলোতে এসব পিঠার চাহিদাও থাকে বেশ।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
15 ছবি1 | 15
বরং পত্রিকার পাতাজুড়ে শুধু নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণার খবর। আগামী ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। দেশজুড়ে চলছে তার জোর তোড়জোড়। মানুষ ভোট নিয়েই খবর জানতে চাইছে। তাই পত্রিকা ও অনলাইন সংবাদম্যাধমের পাতা আর টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে নির্বাচনের খবরই প্রাধান্য পাচ্ছে। অথচ অন্যান্য বছর এই সময়ে সারা দেশে, বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে শীতে মানুষের দুর্ভোগ নিয়ে গুরুত্বে সঙ্গে খবর প্রকাশ হয়। সে সব খবরের প্রভাব সামাজের সাধারণ মানুষের মধ্যে পড়ে। তারা খাবার, কম্বল ও শীতবস্ত্র নিয়ে শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ান।
হাসপাতালগুলো হাঁপানি, সর্দিজ্বর ও ডাইরিয়াসহ শীতজনিত নানা রোগে আক্রান্ত মানুষে ভরে ওঠার খবর পাওয়া যায়। যে খবর পরিবারে সচেতনতা বাড়ায় এবং শিশু ও বয়স্কদের প্রতি এ সময়ে যত্নশীল হয়ে ওঠার কথা মনে করিয়ে দেয়।
শুধু দুর্ভোগের চিত্র নয়। বরং শীত ঘিরে নানা আনন্দ-আয়োজনের খবরেও এ সময় পত্রিকার পাতা ভরে উঠতো। শহুরে শীতে কনসার্ট, পিঠা উৎসব আর গ্রামে মেলা ও যাত্রাপালা। এবার অবশ্য নির্বাচন ঘিরে দেশে রাজনীতির ময়দায় উত্তপ্ত থাকা এবং নানা ধরণের নাশকতার খবর শীত ঘিরে অনুষ্ঠান আয়োজনকে বাধাগ্রস্ত করেছে। তাই এ ধরণের এখবর এবার এমনিতেই কম থাকবে।
অনুষ্ঠান আয়োজন না হয় কম হলো, কিন্তু মানুষের ভোগান্তি তো আর ভোটের উত্তাপে কমে যায়নি। বরং অন্য বছরগুলোর মতই ভোগান্তি হচ্ছে। তাই এ সময়ে শুধু নির্বাচনের খবরই নয় বরং শীতার্তদের খবরও প্রকাশ করা উচিত বলে আমার মনে হয়। না হলে আমরা তো স্রোতে গা ভাসানো মানুষ। এবার সব স্রোত নির্বাচনের দিকে। আমরা তাতে গা ভাসাতে গিয়ে শীতের সামনে অসহায় হয়ে পড়া মানুষগুলোকে যেনো ভুলে না যাই।