প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন সমঝোতা হলে দশম সংসদ ভেঙে আগেই নির্বাচন দেয়া হবে৷ তবে বিশ্লেষকদের প্রশ্ন – সমাধান যদি পরে হতে পারে, তাহলে আগে হলে সমস্যা কোথায়?
বিজ্ঞাপন
বৃহস্পতিবার গণভবনে আওয়ামী লীগের এক সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আগামী ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে বিএনপির অংশ নেয়ার সুযোগ হচ্ছে না৷ তবে নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলনরত বিএনপির সঙ্গে আলোচনা চলবে৷ ওই সংলাপে যদি সমঝোতা হয় তাহলে দশম সংসদ ভেঙে দিয়ে পুনরায় নির্বাচন দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী৷ তবে এক্ষেত্রে বিরোধী দলকে ‘হত্যা' বন্ধের শর্ত দেন তিনি৷
প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যে আগামী ৫ জানুয়ারি নির্বাচন যে হচ্ছে এবং আওয়ামী লীগই সরকার গঠন করতে যাচ্ছে সে বিষয়টি মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে গেছে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের৷
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘‘সমস্যার সমাধান যদি পরে হতে পারে তাহলে আগে হলে সমস্যা কোথায়? আর এখন যদি আলোচনা করে সমস্যার সমাধান না করা যায় তাহলে পরে কিভাবে সম্ভব?''
তিনি মনে করেন, প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যে সংকট দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আলামত পাওয়া যাচ্ছে৷ ইতিমধ্যে, কঠিন সংকটের মধ্য দিয়ে দিন পার করছে দেশের মানুষ৷
অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি যে নির্বাচন করেছিল, এবারের নির্বাচন তার চেয়েও অগ্রহযোগ্য হচ্ছে৷ কারণ এবার ১৫৪ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে গেছেন৷ ফলে সেসব এলাকার ভোটাররা ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন – যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়৷
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট থামছে না
আগামী বছরের সূচনায় জাতীয় নির্বাচন, কিন্তু দুই মুখ্য রাজনৈতিক জোটের টানাপোড়েন অব্যাহত৷ অথচ দেশে-বিদেশে অনেকেই চান সংকট নিরসনে দুই বৈরী জোটের মধ্যে আলোচনা৷ কিন্তু সেটা কি আদৌ সম্ভব হবে?
ছবি: AP
দু’দলের দ্বন্দ্ব
বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নির্দিষ্ট হয়েছে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে৷ তবে মুখ্য বিরোধী দল বিএনপি এখনো নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি নয়৷ তারা চায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, শাসক আওয়ামী লীগের কাছে যা সংবিধান লঙ্ঘনের সমান৷
ছবি: Getty Images/AFP/FARJANA K. GODHULY
জাতিসংঘ চায় সংলাপ
জাতিসংঘ ইতিমধ্যেই দুই বিবাদী জোটের মধ্যে সংলাপের উদ্যোগ নিয়েছে৷ মহাসচিব বান কি-মুন গত ২৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে টেলিফোনে কথাবার্তা বলেছেন৷ জাতিসংঘের মহাসচিব উভয় নেতার প্রতি চলতি রাজনৈতিক সংকটের শান্তিপূর্ণ অবসানের জন্য আলাপ-আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন৷
ছবি: Reuters
হাসিনা চান সংসদে আলোচনা
জাতিসংঘ বাংলাদেশি রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে মহাসচিবের ফোনালাপের কোনো খুঁটিনাটি প্রকাশ করেনি৷ তবে বাংলাদেশের একাধিক দৈনিকে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী হাসিনা ‘‘জাতিসংঘের প্রধানকে জানিয়েছেন যে, তিনি সংবিধান অনুযায়ী সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনা করছেন৷’’ বিরোধীপক্ষ যদি গোটা প্রসঙ্গটি সংসদে আলোচনা করার কোনো প্রস্তাব দেয়, তবে তিনি তাকে স্বাগত জানাবেন, এমন আভাসও দিয়েছেন হাসিনা৷
ছবি: dapd
সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচনে বিএনপির ‘না’
বান কি-মুনের সঙ্গে ফোনালাপে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়াও সংকট সমাধানে সংলাপের সপক্ষে মতপ্রকাশ করেছেন, কিন্তু এ-ও স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, ‘‘বিরোধীপক্ষ আওয়ামী লীগ সরকারের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না৷’’
ছবি: Reuters
তত্ত্বাবধায়ক সরকার কি ও কেন?
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মূল কাজ হলো মুক্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করা৷ ১৯৯১ সালে এই পদ্ধতি চালু করা হয় কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ২০০৯ সালে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সেই পদ্ধতি বাতিল করে৷ বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী পক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবি তুলেছে৷
ছবি: AP
জার্মানি সংলাপ সমর্থন করে
সংলাপকে বাংলাদেশের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক জোটের মধ্যে অচলাবস্থা নিরসনের একমাত্র পন্থা বলে মনে করে জার্মানি৷ ‘ঢাকা কুরিয়ার’ নামক সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ঢাকায় জার্মান রাষ্ট্রদূত ড. আলব্রেশট কনৎসে বলেছেন, ‘‘দু’টি মুখ্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংলাপ হলো বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা সমাধানের একমাত্র পথ৷’’
ছবি: DW/R. Manzoor
ইউনূস তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ডাক দিলেন
বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস একটি ‘‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ (নির্বাচনকালীন) সরকার’’ বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য সমর্থন ব্যক্ত করেছেন৷ গত ২২ আগস্ট ইউনূস একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘‘নির্বাচন অতি অবশ্য হওয়া উচিত এবং তা একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হওয়া উচিত৷’’
ছবি: Getty Images
আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি)
হাসিনা সরকারের সৃষ্ট আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল বা আইসিটি-র উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার৷ কিন্তু তা শাসকদল এবং বিরোধীপক্ষের মধ্যে একটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ আইসিটি এখন পর্যন্ত ছ’জন অভিযুক্তকে শাস্তি দিয়েছে৷ বিরোধীপক্ষ এই বিচার প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত আখ্যা দিয়েছে৷ তাদের মতে এই প্রক্রিয়ার বাস্তবিক উদ্দেশ্য ন্যায়বিচার নয়, পুরাতন শত্রুতার প্রতিশোধ৷
ছবি: AP
আন্তর্জাতিক সমালোচনা
হিউম্যান রাইটস ওয়াচও আইসিটি-র সমালোচনা করেছে৷ এইচআরডাব্লিউ বিবৃতিতে বলেছে, জামায়াতে ইসলামীর সাবেক প্রধান গোলাম আযমের বিচার প্রক্রিয়া ‘‘গভীরভাবে ত্রুটিপূর্ণ’’ ছিল৷ প্রতিক্রিয়া হিসেব সরকারি কৌঁসুলির তরফ থেকে এইচআরডাব্লিউ-এর বিরুদ্ধে আদালতের অবমাননার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে৷ ইতিমধ্যে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা বলেছেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এইচআরডাব্লিউ-এর ‘‘একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা’’ রয়েছে৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
ট্র্যাক রেকর্ড
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসে৷ বিদ্যুৎ উৎপাদন কিংবা কৃষি খাতে সরকারের সাফল্যের খতিয়ান যাই হোক না কেন, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ানোর পর হাসিনা সরকারের অন্য সব সাফল্য ঐ একটি কেলেঙ্কারির আড়ালে ধামাচাপা পড়ে গেছে৷ আগামী নির্বাচনেও পদ্মা সেতু প্রকল্প প্রসঙ্গটি প্রভাব ফেলতে পারে বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা৷
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
তিনি মনে করেন, ৫ জানুয়ারি যে ১৪৬টি আসনে নির্বাচন হবে সেখানে সরকার চেষ্টা করবে সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে মেরে কেটে ৮০ ভাগের বেশি ভোটার হাজির করার৷ এর মাধ্যমে বিদেশিদের দেখানোর চেষ্টা করা হবে যে, নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়েছে, ভোটারদেরও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল৷ কিন্তু এই নির্বাচন কোনোভাবেই দেশবাসী বা বিদেশিদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না৷ আর সরকার নিজেও বুঝতে পারছে দশম সংসদ নির্বাচন যেনতেনভাবে করে ফেলা গেলেও সেটা স্থায়ী হবে না৷ তাই আগেভাগেই প্রধানমন্ত্রী বলে রেখেছেন সমঝোতা হলে দশম সংসদ ভেঙে নির্বাচন দিয়ে দেয়া হবে৷
অধ্যাপক ইমতিয়াজের মতে, এখন নির্বাচন না হলেও তো আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করতে পারে৷ কারণ নিজেদের আর মিত্রদের মিলিয়ে তো ১৫৪টি আসন তাদের হয়ে গেছে৷ তিনি বলেন, এগুলো সমস্যা সমাধানের কোনো চেষ্টা নয়৷ আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলেই সমাধান হতে পারে৷ বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা করেই সংকট সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে৷ সংকট দীর্ঘস্থায়ী হলে কারো জন্যই মঙ্গলজনক হবে না – সরকারকেও সেটা বুঝতে হবে৷
এদিকে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের জবাবে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান এবং বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী অনেক চমক দেখিয়েছেন, অনেক খেলা খেলেছেন, আর নয়৷ পাতানো নির্বাচন অবিলম্বে বন্ধ করা না হলে আগুন জ্বলবে বলেও সতর্ক করে দিয়েছেন তিনি৷ শুক্রবার এক আলোচনা সভায় তিনি এ কথা বলেন৷ এই সময় তিনি নির্বাচন কমিশনকে হুঁশিয়ার করে বলেন, সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে পাতানো নির্বাচন বাংলাদেশের মানুষ মানবে না৷
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে সমঝোতার কোনো ইঙ্গিত তারা দেখছেন না৷ এখন সমঝোতা হচ্ছে না, আর তখন সমঝোতা হবে এর নিশ্চয়তা কে দেবে? প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা৷ তিনি বলেন, এখনও সমঝোতা হলে নির্বাচনি তফশিল স্থগিত করে এবং সংসদ ভেঙে দিয়ে সংবিধানের ভেতরে থেকেই নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব৷