ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্তে চরম দক্ষিণপন্থি শক্তির নির্বাচনি সাফল্য বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠছে৷ এবার নেদারল্যান্ডসের সংসদ নির্বাচনে খেয়ার্ট ভিল্ডার্সের ফ্রিডম পার্টির অভাবনীয় জয় সেই উদ্বেগ আরো বাড়িয়ে দিলো৷ সংসদের ১৫০টি আসনের মধ্যে ৩৭টি দখল করে সবচেয়ে শক্তিশালী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে চরম দক্ষিণপন্থি এই দল৷ তবে সরাসরি ক্ষমতায় আসতে হলে ভিল্ডার্সকে অন্য দলের সঙ্গে জোট গঠন করে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রমাণ দিতে হবে৷ কোনো আইন প্রণয়ন করতে গেলেও জোটসঙ্গিদের সম্মতির প্রয়োজন হবে৷ নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে জয়ের পর রুটে সুর নরম করে বলেন, তিনি গোটা দেশের মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে প্রধানমন্ত্রী হতে চান৷
ইসলাম ধর্ম ও মুসলিমদের সম্পর্কে খেয়ার্ট ভিল্ডার্সের খোলাখুলি বিরূপ মন্তব্য বার বার নজর আকর্ষণ করেছে৷ তিনি অতীতে নেদারল্যান্ডসে মসজিদ ও পবিত্র কোরান নিষিদ্ধ করার ডাক দিয়েছেন৷ ফলে নির্বাচনে এমন ব্যক্তির প্রতি বিপুল জনসমর্থন নেদারল্যান্ডসের মুসলিমদের জন্য গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে৷ সে দেশের সিএমও নামের মুসলিম সংগঠনের প্রতিনিধি সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ডাচ মুসলিমদের জন্য নির্বাচনের এই ফলাফল অত্যন্ত মর্মান্তিক৷ তাঁর মতে, আইনের শাসনের মৌলিক নীতির বিরুদ্ধে কর্মসূচি স্থির করে কোনো দল যে এত সাফল্য পেতে পারে, তা প্রত্যাশার বাইরে ছিল৷
উল্লেখ্য, নেদারল্যান্ডসের জনসংখ্যার প্রায় পাঁচ শতাংশ মুসলিম৷ ভিল্ডার্স ক্ষমতায় এলে তাদের অনেকের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে৷ সিরিয়া থেকে আসা ছাত্রী জুডি কারাজোলি সংবাদ সংস্থা এএফপি-কে নিজের উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, ভিল্ডার্সের বর্ণবাদী পিভিভি দল খোলাখুলি দেশ থেকে ইসলাম ধর্ম দূর করার অঙ্গীকার করেছে৷ দলের ইশতাহারে এমনকি দাবি করা হয়েছে যে, সিরিয়ার কিছু অংশ বর্তমানে নিরাপদ থাকায় সেখান থেকে আশা শরণার্থীদের রেসিডেন্স পারমিট বাতিল করে ফেরত পাঠানো উচিত৷ কারজোলি তার সিরীয় বন্ধুদের ভবিষ্যৎ নিয়েও দুশ্চিন্তা প্রকাশ করেন৷
নেদারল্যান্ডসের দলীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে এমন ফলাফল অবশ্য সবার কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল না৷ অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে, দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুটের শাসনকাল সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ হয়ে অনেক মানুষ মূল স্রোতের রাজনৈতিক দলগুলির বিকল্পের খোঁজ করেছেন৷
ভিল্ডার্সের দলের সাফল্যের বিরুদ্ধে নেদারল্যান্ডসের কিছু জায়গায় বিক্ষোভ দেখা গেছে৷ উটরেখট শহরে প্রায় এক হাজার মানুষ ‘তোমরা একা নও' স্লোগান দিয়ে মুসলিমদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছেন৷ বামপন্থি দলগুলির উদ্যোগে আয়োজিত এই সমাবেশে দেশের সব শ্রেণির অধিকারের জন্য সংগ্রামের অঙ্গীকার করা হয়৷ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আমস্টারডাম শহরেও ফ্যাসিবাদ-বিরোধী মিছিল হয়েছে৷
এসবি/এসিবি (রয়টার্স, এএফপি)
ইউরোপ কতটা অসাম্প্রদায়িক? কোন দিকে বেশি ঝুঁকছে ইউরোপের মানুষ? ধর্ম নিয়ে রাষ্ট্রের অবস্থান কী? সাম্প্রদায়িকতা বা সম্প্রীতি কতটা? ছবিঘরে থাকছে এমন সব প্রশ্নের উত্তর৷
ছবি: René Arnold/House of Oneপিউ রিসার্চের ২০১৫ সালের এক জরিপ অনুযায়ী ইউরোপে সাড়ে ৭৪ শতাংশ জনগোষ্ঠী খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী৷ তারপর থাকা সবচেয়ে বেশি জনগোষ্ঠী ১৮ দশমিক ৮ শতাংশের কোনো ধর্ম নেই৷ তৃতীয় অবস্থানে থাকা মুসলিমরা প্রায় ছয় শতাংশ। এছাড়াও ইহুদি, হিন্দু, বৌদ্ধ ও অন্যান্য ধর্মের জনগোষ্ঠী এক শতাংশের কম করে৷
ছবি: Robert Harding/picture alliance পিউ রিসার্চের ২০১৮ সালের জরিপ অনুযায়ী, পশ্চিম ইউরোপের অনেক দেশেই অর্ধেকের বেশি মানুষ ধর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন৷ তবে বেছে নিতে হলে কোনটি বেছে নেবেন- এমন প্রশ্নে জার্মানির ৭১ শতাংশ ও ফ্রান্সের ৬৪ শতাংশ খ্রিস্ট ধর্মের কথা বলেছেন৷ আরেক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৫০ সাল নাগাদ এই অঞ্চলে খিস্টান ৬৫ শতাংশ, ‘ধর্মহীন’ ২৩ দশমিক তিন শতাংশ ও মুসলিমদের হার হবে ১০ দশমিক দুই শতাংশ৷ বাকিদের হার অনেকটা অপরিবর্তিতই থাকবে৷
ছবি: Diogo Baptista/ZUMAPRESS/picture allianceপিউ রিসার্চের ২০১৮ সালের জরিপ অনুযায়ী,পশ্চিম ইউরোপের বেশিরভাগ মানুষ সরকারি নীতি থেকে ধর্মকে দূরে রাখার পক্ষপাতী৷ সুইডেনে ৯০ শতাংশ, বেলজিয়ামে ৭২ শতাংশ মানুষই এমনটা মনে করেন৷ অন্যদিকে সুইজারল্যান্ডের ৪৫ ভাগ আর যুক্তরাজ্যের ৩৮ ভাগ মনে করেন সরকারের নীতিতে ধর্মকে সমর্থন দেয়া উচিত৷ ফ্রান্স, জার্মানিসহ ইইউভুক্ত বেশিরভাগ দেশে অসাম্প্রদায়িকতা এবং নাগরিকদের স্বাধীনভাবে ধর্ম পালনের সাংবিধানিক স্বীকৃতি আছে৷
ছবি: Sebastian Gollnow/dpa/picture allianceপিউ রিসার্চের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ধর্ম পালনে সরকারের হয়রানিতে মধ্যপ্রাচ্য-উত্তর আফ্রিকার পরই রয়েছে ইউরোপ৷ এই অঞ্চলে ৯৮ শতাংশ দেশে ধর্মীয় গোষ্ঠীর উপর এবং ৯১ শতাংশ দেশে উপাসনায় হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে৷ বিভিন্ন আইনের কারণে ধর্মবিধি পালনে মানুষ সমস্যায় পড়েন৷ যেমন, স্লোভেনিয়ায় অচেতন ছাড়া প্রাণী হত্যা নিষিদ্ধ করায় মুসলিম ও ইহুদিরদের হালাল ও কোশার বিধি মানা কঠিন হয়ে পড়ে৷
ছবি: Mesut Zeyrek/AA/picture allianceঅনেক দেশেই জনসমক্ষে বা কর্মক্ষেত্রে ধর্মীয় পোশাকে নিষেধাজ্ঞা আছে৷ যেমন, অস্ট্রিয়ায় জনসমক্ষে মুখমণ্ডল আবৃত রাখা এবং স্কুলে ১০ বছরের কম বয়সিদের স্কার্ফ পরা নিষেধ৷ ফ্রান্সে জনসেবা প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের স্কার্ফ, টুপি, পাগড়ি বা ক্রস পরিধান নিষিদ্ধ৷ ২০১৫ সালে জার্মানির আদালত বিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের স্কার্ফ পরা নিষিদ্ধ করলেও তা বাস্তবায়ন রাজ্যগুলোর উপর ছেড়ে দিয়েছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Johnson২০১৯ সালে ইউরোপে ১৭টি দেশে ধর্মীয় গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে সরকার, আগের বছর এমন দেশের সংখ্যা ছিল ১৯৷ এক্ষেত্রে সবার উপরে ছিল রাশিয়া৷ গত বছরের নভেম্বরে ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ধর্মীয় উগ্রবাদের অভিযোগে ২০১৭ সাল থেকে ৪৩টি মসজিদ বন্ধ করেছে ফ্রান্স৷ কোভিড-১৯-এর বিধিনিষেধের কারণে ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে দেশটির ক্যাথলিক চার্চ কর্তৃপক্ষ৷
ছবি: Ait Adjedjou Karim/Avenir Pictures/ABACA/dpa/picture allianceসাম্প্রতিক বছরে ইউরোপের দেশে দেশে উগ্রবাদের বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে৷ ২০২০ সালে ফ্রান্সে জঙ্গিবাদ সমর্থক এক মুসলিম তরুণ এক কলেজ শিক্ষককে হত্যা করেন৷ তার আগে টিউনিসিয়ার এক অভিবাসী চার্চের ভিতরে তিন খ্রিস্টানকে হত্যা করেন৷ ২০১৯ সালে জার্মানিতে সিনাগগে হামলায় মারা যান দুইজন৷ সম্প্রতি সুইডেনে উগ্র ডানপন্থি দলের নেতা রাসমুস পালুদান সুইডেনে পবিত্র কোরানের কপি পোড়ানোর ঘোষণা দিলে ক্ষুব্ধ হন দেশটির মুসলিমরা৷
ছবি: Alain Jocard/AFP/Getty Imagesউগ্রতা আর সাম্প্রদায়িকতার বাইরে ইউরোপে সম্প্রীতির অনেক উদাহরণ আছে৷ ইহুদি এবং মুসলমানদের একত্রিত করতে জার্মানির মারবুর্গ শহরে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করেছেন দুই সম্প্রদায়ের মানুষ৷ বার্লিনে মুসলমান, খ্রিস্টান ও ইহুদিদের এক ছাদের নীচে প্রার্থনার জন্য নির্মাণ করা হচ্ছে ‘হাউস অব ওয়ান’৷ সম্প্রতি জার্মানির বুন্ডেসলিগার ম্যাচ চলার সময় এক ফুটবলারের ইফতারের জন্য কিছুক্ষণ খেলা বন্ধ রাখা হয় - যা আগে কখনও হয়নি৷
ছবি: Frank Senftleben/epd-bild