নির্বাচনের বছরে বাংলাদেশকে ঘিরে আন্তর্জাতিক কূটনীতি
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩এইসব সফর দ্বিপাক্ষিক। তবে মানবাধিকার, শ্রমিক অধিকার, গণতন্ত্র, রোহিঙ্গা সমস্যাগুলোও থাকছে কোনো কোনো দেশের এজেন্ডায়। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এ বছর বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে বলে এসব সফরের নানামুখী গুরুত্ব রয়েছে। আর নির্বাচনের আগে এই ধরনের সফর আরো বাড়বে বলে তারা মনে করছেন।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ঢাকা এসেছেন মাকিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের কাউন্সেলর ডেরেক শোলে। তিনি আন্ডার সেক্রেটারি পদমর্যাদায় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর জ্যেষ্ঠ পলিসি অ্যাডভাইজার। ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে তার দুই দিনের সফরে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, নিরাপত্তা ও রোহিঙ্গা সঙ্কটের মত বিষয় নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
এর আগে তিনি বাংলাদেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশন দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, "বাংলাদেশের ওপর থেকে রোহিঙ্গাদের চাপ কমানোর চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র। এজন্য কিছু রোহিঙ্গা শরণার্থীকে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাওয়ারও চেষ্টা চলছে। মিয়ানমারের পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে। এ নিয়ে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।''
ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে বাংলাদেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে ডেরেক শোলে বলেন, "এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা বাংলাদেশ সফর করছেন।”
শোলে আরো বলেন, "কোনো গণতন্ত্রই নিখুঁত নয় । কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সবসময় নিজেদের ভালো করার চেষ্টা করে এবং ভুল স্বীকার করে উন্নতি করার চেষ্টা করে। অংশীদারি ও বন্ধুত্বের চেতনা থেকেই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, নাগরিক সমাজের কথা বলে যুক্তরাষ্ট্র।''
বুধবার সকালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে শোলের বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। শোলের ঢাকা সফরের আগেই একটি অগ্রবর্তী দল বাংলাদেশে এসেছে। দলের সদস্যরা কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনও করেছেন। ডেরেক শোলেরও রোহিঙ্গা শিবিরে যাওয়ার কথা রয়েছে।
তার এই সফর গত জানুয়ারিতে জো বাইডেনের বিশেষ উপদেষ্টা রিয়ার অ্যাডমিরাল এইলিন লউবেখারের ও উপ-সহকারী পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডেনাল্ড লুর ঢাকা সফরের ফলোআপ সফর।
এদিকে ভারত এবার জি-২০ সম্মেলনের আয়োজক দেশ। ওই সম্মেলনে যোগ দেবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যে নয়টি দেশকে গেষ্ট অতিথি হিসেবে সম্মেলনে যুক্ত করা হচ্ছে তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি। সেপ্টেম্বরে এই সম্মেলন হবে। সেই সফরকে সামনে রেখেই প্রধানত মঙ্গলবার ঢাকা এসেছেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোত্রা।
আর মার্চে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতে যাবেন। জুনেও আরেকবার যাওয়ার কথা রয়েছে। সফরগুলোর এজেন্ডা ঠিক করার বিষয়ও রয়েছে ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের সফরে।
তবে বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের মধ্যে প্রতি বছর বৈঠক হয়, এই সফর তারও অংশ। ২০২১ সালে সর্বশেষ এই বৈঠক হয়।
বিনয় কোত্রা এর আগে জয়শংকরের সঙ্গে ঢাকা আসলেও এটা তার প্রথম একক সফর। বিশ্লেষকেরা বলছেন সামনে বাংলাদেশের নির্বাচন, ভারতেরও নির্বাচন। ফলে এই সফরগুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ। দুই দেশ তাদের যোগাযোগ আরো বাড়াতে চায়। বাড়াতে চায় বোঝাপড়া।
এদিকে জাপানের প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উপদেষ্টা নাকাতানি জোন ঢাকায় আসছেন ১৯ ফেব্রুয়ারি।
গত নভেম্বরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরের কথা ছিলো, তবে তা হয়নি। এখন এপ্রিলে তিনটি সম্ভাব্য তারিখ নিয়ে কথা চলছে। সেই বিষয়গুলো চূড়ান্ত করতেই তিনি ঢাকা আসছেন বলে জানা গেছে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) শহীদুল হক মনে করেন,"যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের কাউন্সিলর ডেরেক শোলে প্রধান রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়েই বাংলাদেশে আসছেন। এটা একটা আশার খবর। তারা এই ইস্যুকে গুরুত্ব দিচ্ছে। তবে এর বাইরে মানবাধিকার, গণতন্ত্র এসব বিষয় তার ফোকাসে থাকার কথা । বাংলাদেশ এবারো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের গণতন্ত্র সম্মেলনে আমন্ত্রণ পায়নি। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।”
তিনি মনে করেন," ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের সফরে দ্বিপাক্ষিক বিষয়ের কথা বলা হলেও আরো অনেক বিষয় থাকতে পারে। সেটা তো আর জানা যাবে না। তবে এটা নিশ্চিত যে নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ তিস্তার পানি পাচ্ছে না।”
তার কথা,"জাপান মূলত তার ব্যবসা বাণিজ্যের দিকেই নজর দেয়। মাতারবাড়ি প্রজেক্ট এই সফরে গুরত্ব পেতে পারে।”
আর সাবে রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, "সার্বিকভাবে বলতে গেলে বিশ্বে একটি সংকট চলছে। এই সময়ে সব দেশই চাইছে ব্যবসা বাণিজ্যের ও সহযোগিতার উন্নয়ন ঘটাতে। সেটা ওইসব দেশের জন্য যেমন প্রয়োজন, আমাদের দেশের জন্যও প্রয়োজন। ফলে এই সফরগুলো কাকতালীয়ভাবে একই সঙ্গে হলেও আমার মনে হয় সবার আলাদা আলাদা এজেন্ডা আছে।”
তার কথা, "তবে সুনির্দিষ্টভাবে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উপদেষ্টার কথা বললে বলতে হবে তিনি রোহিঙ্গা ইস্যুকেই প্রাধান্য দেবেন। তবে এর বাইরে নিশ্চয়ই তিনি মানবাধিকার, গণতন্ত্র, বাক স্বাধীনতা এসব বিষয় নিয়ে কথা বলবেন। ইন্দো-প্যাসিফিক ইস্যু আছে। তিনি এমন একজন লোক যিনি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কানে সরাসরি কথা তুলতে পারেন। ফলে তিনি সফর শেষে তাকে বাংলাদেশের সার্বিক বিষয়েও জানাবেন।”
"আর ভারতের পররাষ্ট্র সচিব এসেছেন জি-২০ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে দাওয়াত দিতে। কিন্তু পাশাপাশি সম্পর্কটা আরো ঝালাই করে নিতে চাইবেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব,” মনে করেন সাবেক এই রাষ্ট্রদূত।
এদিকে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইওলের ভবিষ্যৎ কৌশল বিষয়ক বিশেষ দূত জ্যাং সুং মিন, গত মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকায় এসেছেন। ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ছেড়ে যাবেন তিনি।
যুক্তরাজ্যের বাণিজ্য ও ব্যবসা বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ব্যাডেনোচ কেমি আগামী সপ্তাহে ঢাকায় আসছেন বলে জানা গেছে।