সুশাসনের জন্য নাগরিক বা সুজন মনে করে, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অন্তত ৪টি শর্ত পূরণ করতে হবে৷ এর মধ্যে নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন অন্যতম৷ নির্বাচন কমিশন আইনের সংস্কারও প্রয়োজন৷
বিজ্ঞাপন
নির্বাচন কমিশন আইনে নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিধান ছাড়াও না ভোটের ব্যবস্থা, ব্যালট পেপারে প্রার্থীর মার্কা এবং ছবি ব্যবহার এবং নির্বাচনকালীন গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগে তদন্ত সাপেক্ষে নির্বাচন বাতিলের বিধানের কথা বলেছে সুজন৷
সুজন-এর সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন এবং শক্তিশালী করতে হবে৷ তাহলেই বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে সুষ্ঠু নির্বাচনের গ্যারান্টি দেয়া যাবে৷ নয়তো প্রত্যেক নির্বাচনের আগেই নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হবে৷ রাজনীতির এই অস্থিতিশীল ধারা বন্ধের কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন৷ তত্ত্বাবধায়ক সরকার হলো সাময়িক সমাধান৷''
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট থামছে না
আগামী বছরের সূচনায় জাতীয় নির্বাচন, কিন্তু দুই মুখ্য রাজনৈতিক জোটের টানাপোড়েন অব্যাহত৷ অথচ দেশে-বিদেশে অনেকেই চান সংকট নিরসনে দুই বৈরী জোটের মধ্যে আলোচনা৷ কিন্তু সেটা কি আদৌ সম্ভব হবে?
ছবি: AP
দু’দলের দ্বন্দ্ব
বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নির্দিষ্ট হয়েছে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে৷ তবে মুখ্য বিরোধী দল বিএনপি এখনো নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি নয়৷ তারা চায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, শাসক আওয়ামী লীগের কাছে যা সংবিধান লঙ্ঘনের সমান৷
ছবি: Getty Images/AFP/FARJANA K. GODHULY
জাতিসংঘ চায় সংলাপ
জাতিসংঘ ইতিমধ্যেই দুই বিবাদী জোটের মধ্যে সংলাপের উদ্যোগ নিয়েছে৷ মহাসচিব বান কি-মুন গত ২৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে টেলিফোনে কথাবার্তা বলেছেন৷ জাতিসংঘের মহাসচিব উভয় নেতার প্রতি চলতি রাজনৈতিক সংকটের শান্তিপূর্ণ অবসানের জন্য আলাপ-আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন৷
ছবি: Reuters
হাসিনা চান সংসদে আলোচনা
জাতিসংঘ বাংলাদেশি রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে মহাসচিবের ফোনালাপের কোনো খুঁটিনাটি প্রকাশ করেনি৷ তবে বাংলাদেশের একাধিক দৈনিকে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী হাসিনা ‘‘জাতিসংঘের প্রধানকে জানিয়েছেন যে, তিনি সংবিধান অনুযায়ী সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনা করছেন৷’’ বিরোধীপক্ষ যদি গোটা প্রসঙ্গটি সংসদে আলোচনা করার কোনো প্রস্তাব দেয়, তবে তিনি তাকে স্বাগত জানাবেন, এমন আভাসও দিয়েছেন হাসিনা৷
ছবি: dapd
সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচনে বিএনপির ‘না’
বান কি-মুনের সঙ্গে ফোনালাপে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়াও সংকট সমাধানে সংলাপের সপক্ষে মতপ্রকাশ করেছেন, কিন্তু এ-ও স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, ‘‘বিরোধীপক্ষ আওয়ামী লীগ সরকারের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না৷’’
ছবি: Reuters
তত্ত্বাবধায়ক সরকার কি ও কেন?
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মূল কাজ হলো মুক্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করা৷ ১৯৯১ সালে এই পদ্ধতি চালু করা হয় কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ২০০৯ সালে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সেই পদ্ধতি বাতিল করে৷ বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী পক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবি তুলেছে৷
ছবি: AP
জার্মানি সংলাপ সমর্থন করে
সংলাপকে বাংলাদেশের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক জোটের মধ্যে অচলাবস্থা নিরসনের একমাত্র পন্থা বলে মনে করে জার্মানি৷ ‘ঢাকা কুরিয়ার’ নামক সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ঢাকায় জার্মান রাষ্ট্রদূত ড. আলব্রেশট কনৎসে বলেছেন, ‘‘দু’টি মুখ্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংলাপ হলো বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা সমাধানের একমাত্র পথ৷’’
ছবি: DW/R. Manzoor
ইউনূস তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ডাক দিলেন
বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস একটি ‘‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ (নির্বাচনকালীন) সরকার’’ বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য সমর্থন ব্যক্ত করেছেন৷ গত ২২ আগস্ট ইউনূস একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘‘নির্বাচন অতি অবশ্য হওয়া উচিত এবং তা একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হওয়া উচিত৷’’
ছবি: Getty Images
আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি)
হাসিনা সরকারের সৃষ্ট আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল বা আইসিটি-র উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার৷ কিন্তু তা শাসকদল এবং বিরোধীপক্ষের মধ্যে একটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ আইসিটি এখন পর্যন্ত ছ’জন অভিযুক্তকে শাস্তি দিয়েছে৷ বিরোধীপক্ষ এই বিচার প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত আখ্যা দিয়েছে৷ তাদের মতে এই প্রক্রিয়ার বাস্তবিক উদ্দেশ্য ন্যায়বিচার নয়, পুরাতন শত্রুতার প্রতিশোধ৷
ছবি: AP
আন্তর্জাতিক সমালোচনা
হিউম্যান রাইটস ওয়াচও আইসিটি-র সমালোচনা করেছে৷ এইচআরডাব্লিউ বিবৃতিতে বলেছে, জামায়াতে ইসলামীর সাবেক প্রধান গোলাম আযমের বিচার প্রক্রিয়া ‘‘গভীরভাবে ত্রুটিপূর্ণ’’ ছিল৷ প্রতিক্রিয়া হিসেব সরকারি কৌঁসুলির তরফ থেকে এইচআরডাব্লিউ-এর বিরুদ্ধে আদালতের অবমাননার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে৷ ইতিমধ্যে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা বলেছেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এইচআরডাব্লিউ-এর ‘‘একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা’’ রয়েছে৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
ট্র্যাক রেকর্ড
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসে৷ বিদ্যুৎ উৎপাদন কিংবা কৃষি খাতে সরকারের সাফল্যের খতিয়ান যাই হোক না কেন, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ানোর পর হাসিনা সরকারের অন্য সব সাফল্য ঐ একটি কেলেঙ্কারির আড়ালে ধামাচাপা পড়ে গেছে৷ আগামী নির্বাচনেও পদ্মা সেতু প্রকল্প প্রসঙ্গটি প্রভাব ফেলতে পারে বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা৷
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
তিনি বলেন, ‘‘নির্বাচন কমিশনকে এখনো ঠুটো জগন্নাথ করে রাখা হয়েছে৷ নির্বাচন সংক্রান্ত অপরাধের ধারাগুলো মন্ত্রিসভা গ্রহণ করেনি৷ ফলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি প্রতিকার পাবেন না৷ আর অপরাধীরা পার পেয়ে যাবে৷
‘‘ভারতে কারো এক দিনের সাজা হলেও আর সে নির্বাচনে দাঁড়াতে পারেনা৷ কিন্তু বাংলাদেশে আপিল নিস্পত্তি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়৷ আর আপিল ঝুলিয়ে রেখে অভিযুক্ত ব্যক্তি মন্ত্রী এমপি হয়৷ এর পরিবর্তন দরকার৷''
ড. মজুমদার বলেন, ‘‘স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচন করতে পারবেনা এই বিধান গ্রহণযোগ্য নয়৷ ভোটার হয়ে শর্ত পূরণ করলে যেকোনো নাগরিকের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার থাকা উচিত৷ আর স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচন করতে না পারলে যোগ্য প্রার্থী কমে যাবে৷ আর এতে রাজনৈতিক দলের প্রধানরা নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হবেন৷''
এদিকে এখনো সংলাপের কথা বলছে রাজনৈতিক দলগুলো৷ বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াসহ সিনিয়র নেতারা এখন প্রায় প্রতিদিনই সংলাপের কথা বলেন৷ আর শনিবারও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বলেছেন, ‘‘তারা যেকোন জায়গায় যেকোনো সময় আলোচনার জন্য প্রস্তুত আছেন৷''
ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘‘সংলাপ নিয়ে রাজনীতি এখনো চলছে৷ একদল আন্দোলনে যাচ্ছে৷ আরেকদল সংলাপের কথা বললেও তাদের মত করে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে৷ তবে এতে সমাধান হবে না৷ সত্যিকারের সংলাপের মধ্য দিয়ে সমাধান আসবে৷ তবে তা কখন সংঘাতের আগে না পরে তা তিনি নিশ্চিত নন৷''
তিনি বলেন, ‘‘শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকারই পারে বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করতে৷''