নির্বাচনে সেনাবাহিনী শুধু ‘স্ট্রাইকিং ফোর্স’ নয়, অন্যান্য বাহিনীর মতো পূর্ণ ক্ষমতায় আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকবে৷ এজন্য আরপিও (গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ) সংশোধন করে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে প্রস্তাব পাঠাতে যাচ্ছে ইসি৷
আরপিওর প্রস্তাবিত সংশোধনী অনুমোদন পেলে নির্বাচনে সেনা সদস্যরা ম্যাজিষ্ট্রেসি এবং পুলিশের ক্ষমতা একসঙ্গে পাবেছবি: DW
বিজ্ঞাপন
এর মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন সেনাবাহিনীকে নির্বাচনি দায়িত্বে পূর্ণ ক্ষমতা দিতে চায়৷ ফলে ম্যাজিস্ট্রেটের চাহিদার ওপরে নয়, সেনাবাহিনী স্বাধীনভাবেই নির্বাচনের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করতে পারবে বলে ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ৷
তিনি বলেন, ‘‘আমরা আরপিও সংশোধন করে সেখানে ল’ এনফোর্সমেন্ট এজেন্সি হিসাবে সেনাবাহিনীকেও অন্তর্ভুক্ত করেছি৷ আগে ছিল না৷ আগে শুধু পুলিশ, কোস্টগার্ড, বিজিবি ছিল৷ এখন সেনাবাহিনীকেও অন্তর্ভুক্ত করা হলো৷’’
তিনি জানান, প্রস্তাবটি এই সপ্তাহের মধ্যেই সরকারের কাছে পাঠানো হবে৷ বলেন, ‘‘আমাদের দিক থেকে আমাদের রিকমেন্ড করে একটা খসড়া এই সপ্তাহের মধ্যেই চলে যাবে৷ আমরা পাঠাবো, তারপর ওনারা ওনাদের মতো করে চিন্তা করবেন কতদূর করা যায়৷’’
বিজ্ঞাপন
সব ধরনের নির্বাচনে সেনাবাহিনী
১৬ বছর আগে আরপিওর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তালিকা থেকে সেনাবাহিনীকে বাদ দেয়া হয়৷ নির্বাচন কমিশন ও বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, সামনের ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সেনাবাহিনী পূর্ণ ক্ষমতায় দায়িত্ব পালন করলে ভোটারদের মনে আস্থা ফিরে আসবে৷
সব নির্বাচনেই সেনাবাহিনী থাকা দরকার: আব্দুর রহমানেল মাছউদ
This browser does not support the audio element.
২০০১ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রথম আরপিও সংশোধন করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় প্রতিরক্ষা কর্ম বিভাগগুলো বা সশস্ত্র বাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়৷ আরপিওর ৮৭ অনুচ্ছেদে এই বিধান যুক্ত করে বলা হয় যে, ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি বা আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে যা-ই থাকুক না কেন, নির্বাচন সংক্রান্ত দায়িত্ব পালনকালে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কোনো সদস্য একজন পুলিশ কর্মকর্তা না হয়েও নির্বাচনি অপরাধের জন্য কাউকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করতে পারবেন৷ ২০০১ সালে এই বিধান অধ্যাদেশের মাধ্যমে আরপিওতে যুক্ত করা হয়৷
শুধু জাতীয় সংসদ নির্বাচনেই নয়, পরবর্তী সময়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আইনগুলোতেও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনীকে অন্তুর্ভুক্ত করা হয়৷ কিন্তু ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকার ওই সংশোধনী অধ্যাদেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞা থেকে প্রতিরক্ষা কর্ম বিভাগ বাদ দেয়৷ এর ফলে নির্বাচনি দায়িত্ব পালনে পুলিশ, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন, র্যাব, আনসার, বিজিবি, কোস্ট গার্ডের যে ক্ষমতা তা সশস্ত্র বাহিনীর থাকেনি৷
নির্বাচন কমিশন এবার আরপিওর যে সংশোধনী প্রস্তাব পাঠিয়েছে তাতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ সব নির্বাচনেই সেনাবাহিনী আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত থাকবে৷ নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি অনুসারে এই প্রস্তাবটি অনুমোদন করা হয়েছে বলে কমিশন জানিয়েছে৷ নির্বাচন কমিশনের এই প্রস্তাব রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে বাস্তব রূপ পাবে৷ নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ বলেন, ‘‘নির্বাচন কমিশন সর্বসম্মতভাবে এই প্রস্তাব গ্রহণ করেছে৷’’
এক নজরে সব নির্বাচন কমিশন
বাংলাদেশের প্রথম প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলেন বিচারপতি এম ইদ্রিস৷ বর্তমানে কাজী হাবিবুল আউয়াল৷ বাংলাদেশের বিভিন্ন সময়ের নির্বাচন কমিশনগুলো সম্পর্কে জানুন ছবিঘরে...
ছবি: Asif Mahmud Ove
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচন কমিশন
বাংলাদেশের প্রথম প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলেন বিচারপতি এম ইদ্রিস৷ ১৯৭২ সালের ৭ জুলাই থেকে ১৯৭৭ সালের ৭ জুলাই পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন তিনি ৷ ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে এই কমিশন৷ সে সময় রাষ্ট্রপতি ছিলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। নির্বাচনে ২৯৩ আসন জিতে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। জাসদ ও বাংলাদেশ জাতীয় লীগ একটি করে এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পাঁচটি আসন পায়।
ছবি: AP
নুরুল ইসলাম কমিশন
বিচারপতি একেএম নুরুল ইসলাম বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদে দায়িত্ব পালন করা সিইসি৷ ১৯৭৭ সালের ৮ জুলাই যখন দায়িত্ব নেন, তখন রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান৷ প্রায় আট বছর দায়িত্ব পালনের পর অব্যাহতি নেন ১৯৮৫ সালের ১৭ ফ্রেব্রুয়ারি৷ ৷ ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন হয় তার তত্ত্বাবধানে। বিএনপি পায় ২০৭ আসন, আবদুল মালেক উকিলের আওয়ামী লীগ ৩৯ আসন৷
ছবি: imago stock&people
তিন রাষ্ট্রপতির কমিশন
পরপর দুই সামরিক শাসকের অধীনে সিইসির দায়িত্ব পালন করেছেন নুরুল ইসলাম৷ ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে জিয়াউর রহমান নিহত হলে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার ১৫ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ ‘সামরিক অভ্যুত্থানে’ ক্ষমতায় আসেন সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। পরবর্তীতে এরশাদের সরকারে আইনমন্ত্রী ও পরে উপ রাষ্ট্রপতিও হয়েছিলেন নুরুল ইসলাম৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/P. Rahman
মসউদ কমিশন
বিচারপতি চৌধুরী এটিএম মসউদ দায়িত্ব নেন ১৯৮৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি৷ তিনি পূর্ণ পাঁচ বছর মেয়াদ শেষ করেন ১৯৯০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি৷ এরশাদের আমলে ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে দুটো জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এই কমিশনের অধীনে৷ তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আট দলীয় জোট গেলেও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সাত দলীয় জোট তা বর্জন করে। চতুর্থ জাতীয় নির্বাচন দুই জোটই বর্জন করে৷
ছবি: DW
সুলতান কমিশন
বিচারপতি সুলতান হোসেন খান ১৯৯০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি সিইসি’র দায়িত্ব নেন৷ তবে মাত্র ১০ মাস দায়িত্বে থেকে কোনো জাতীয় নির্বাচন না করেই ২৪ ডিসেম্বর সরে যেতে বাধ্য হন এরশাদের নিয়োগ পাওয়া এই সিইসি৷ গণঅভ্যুত্থানে এরশাদ পদত্যাগে বাধ্য হলে প্রধান দলগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক মতৈক্যে অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান ও অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হন বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদ৷ এরপর তিনি ইসি পুনর্গঠন করেন৷
ছবি: Mustafiz Mamun
রউফ কমিশন
পঞ্চম সংসদ নির্বাচনের আগে প্রথম তিন সদস্যের ইসি পায় বাংলাদেশ। বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুর রউফ সিইসি হিসেবে নিযু্ক্ত হন৷ ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা করে তার কমিশন৷ তিনি ১৯৯৫ সালের ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন৷ রউফ কমিশন নির্বাচনি আইনে ব্যাপক সংস্কার আনে, জারি করা হয় নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) অধ্যাদেশ। ১৯৯৪ সালে মাগুরা উপ নির্বাচন নিয়ে বিতর্কিত হন সিইসি রউফ।
ছবি: AP
সাদেক কমিশন
বিচারপতি একেএম সাদেক সিইসি পদে নিযুক্ত হন ১৯৯৫ সালের ২৭ এপ্রিল৷ ১৯৯৬ সালে এই কমিশনের অধীনেই হয় বিতর্কিত ১৫ ফেব্রুয়ারির ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন৷ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলগুলো ভোট বর্জন করে। বিএনপি পায় ২৭৮ আসন৷ দেড় মাস মেয়াদী সংসদের একমাত্র অধিবেশনে ত্রয়োদশ সংশোধনে সংবিধানে যুক্ত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা৷ এই ইসিই নির্বাচনি আচরণবিধি চালু করে৷
ছবি: AP
হেনা কমিশন
১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে ঘিরে অস্থিরতার মধ্যে সাবেক আমলা মোহাম্মদ আবু হেনা ১৯৯৬ সালের ৯ এপ্রিল সিইসি’র দায়িত্ব নেন৷ এই প্রথম কোনো আমলা এই পদে নিয়োগ পান৷ তার অধীনে ১৯৯৬ সালের জুনে সপ্তম জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়৷ দলীয় সরকারের অধীনে ১৯৯৯ সালে টাঙ্গাইল (সখিপুর-বাসাইল) উপনির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির জন্য সমালোচিত হয় তার কমিশন৷ নির্বাচনের গেজেট না করেই ২০০০ সালের ৮ মে দায়িত্ব ছাড়েন আবু হেনা৷
ছবি: Mustafiz Mamun
সাঈদ কমিশন
রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাসের মেয়াদপূর্তির পর আওয়ামী লীগ সরকার ওই দায়িত্বে আনে একানব্বইয়ের নির্বচনের সময় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্বে থাকা শাহাবুদ্দিন আহমেদকে। আবু হেনা সরে যাওয়ার পর সিইসি হন সাবেক আমলা এম এ সাঈদ৷ বিচারপতি লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে সাঈদ কমিশনের অধীনেই ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অষ্টম সংসদ নির্বাচন হয়।
ছবি: Mustafiz Mamun
আজিজ কমিশন
বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত কমিশনগুলোর একটি আজিজ কমিশন৷ বিচারপতি এমএ আজিজ ২০০৫ সালের ২২ মে সিইসি’র দায়িত্ব নেন৷ ব্যাপক রাজনৈতিক টানাপড়েনের সময় ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি নবম জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন৷ পরে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান ফখরুদ্দীন আহমদ তফসিল বাতিল করেন৷ ২১ জানুয়ারি কোনো জাতীয় নির্বাচন আয়োজন না করেই পদত্যাগ করেন এম এ আজিজ৷
ছবি: DW
শামসুল হুদা কমিশন
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এমএ আজিজের উত্তরসূরী হন এটিএম শামসুল হুদা৷ তার কমিশন ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নবম জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা করে৷ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়ন হয় ওই কমিশনের সময়েই। সংলাপ করে নির্বাচনি আইন সংস্কার করা হয়। চালু হয় রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের নিয়ম ও ইভিএম। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৩০, বিএনপি ৩০ ও জাতীয় পার্টি ২৭ আসন পায়।
ছবি: DW/Muhammad Mostafigur Rahman
রকিবুদ্দিন কমিশন
ইসি পুনর্গঠনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপের পর সার্চ কমিটি গঠন করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। ২০১২ সালের ০৯ ফেব্রুয়ারি দায়িত্ব নেন সাবেক আমলা কাজী রকিবুদ্দিন আহমদ৷ সংসদে বাতিল হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা৷ ক্ষমতাসীন দলের অধীনে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়৷ বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি দলের বর্জন করা নির্বাচনে ১৫৩ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন৷
ছবি: DW
নুরুল হুদা কমিশন
এবারও সংলাপ আয়োজন করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবুল হামিদ৷ সিইসি করা হয় সাবেক আমলা কে এম নুরুল হুদাকে৷ দ্বাদশ ইসির যাত্রা শুরু হয় ২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন কমিশনের নতুন কার্যালয় নির্বাচন ভবনে। তার অধীনে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলেও ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ পাওয়ায় যায়৷ বর্তমান কমিশনের মেয়াদ রয়েছে ২০২২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
ছবি: bdnews24
13 ছবি1 | 13
নির্বাচনি দায়িত্বে সেনা সদস্যদের ম্যাজিস্ট্রেসি এবং পুলিশি ক্ষমতা
এবারের নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় দেড় লাখের মতো পুলিশ মোতায়েন থাকবে৷ এর বাইরে বিজিবি, কোস্টগার্ড ও আনসারও থাকছে৷ আর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী গত ১১ আগস্ট সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচনে ৮০ হাজারের বেশি সেনা সদস্য মোতায়েন করা হবে৷
সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এখন যেটা হচ্ছে, সেটা হলে নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না৷ তাদের অনুমোদনের অপেক্ষা করতে হবে না৷ নির্বাচন কমিশন সরাসরি সেনা সদর দপ্তরে তাদের চাহিদা জানিয়ে আলোচনা করে নির্বাচনের সময় দায়িত্ব পালনে তাদের কাজে লাগাতে পারবে৷ অতীতে নির্বাচন কমিশন সেনাবাহিনী চেয়েও পায়নি এমন নজির আছে৷ সেই পারিস্থিতির মুখে পড়তে হবে না কমিশনকে৷’’
তিনি জানান, আরপিওর এই সংশোধনী হলে নির্বাচনের দায়িত্ব পাওয়া সেনা সদস্যরা ম্যাজিস্ট্রেসি এবং পুলিশের ক্ষমতা একসঙ্গে পাবে৷ আগে তারা স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসাবে ভোট কেন্দ্রের বাইরে এক জায়গায় অবস্থান করতেন৷ কোনো সমস্যা হলে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমোদন সাপেক্ষে তারা কাজ করতেন৷ কিন্তু এখন তার আর প্রয়োজন হবে না৷ ‘‘তারা স্বাধীনভাবে ডেপ্লয়মেন্ট এবং অন্যান্য কাজ করতে পারবেন তাদের কমান্ডারের অধীনে’’, বলেন তিনি৷
এমদাদুল ইসলাম আরো বলেন, ‘‘নির্বাচনে অনেক সময় স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব থাকে৷ অন্য কারণেও তারা প্রভাবিত হতে পারেন৷ কিন্তু সেনাবাহিনীর ওপর আমার মনে হয় সেই ধরনের প্রভাব বিস্তার করা যাবে না৷ ফলে তারা অন্যান্য বাহিনীর মতো আইনশৃঙ্খলার পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ব পেলে তা অনেক ইতিবাচক হবে৷ নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার কঠিন হয়ে পড়বে৷’’
সেনবাহিনীকে বড় ভূমিকা পালন করতে হবে: ড. সাব্বির আহমেদ
This browser does not support the audio element.
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদও মনে করেন বাংলাদেশের বাস্তবতায় নির্বাচনে সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেয়ার প্রয়োজন রয়েছে৷ সেনাবাহিনী নিয়োগ ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় বলেও মনে করেন তিনি৷
তার মতে, ‘‘সেটা শুধু স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসাবে নয়, পূর্ণ ক্ষমতা দিয়ে তাদের নির্বাচনি দায়িত্ব দিতে হবে৷ নয়ত নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা নিয়ে বড় সংকট তৈরি হতে পারে৷ তাই আরপিও সংশোধন করে নির্বাচনের সময় তাদের যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পূর্ণ ক্ষমতা দেয়া হচ্ছে এটা অনেক ইতিবাচক৷’’
তিনি মনে করেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনে দায়িত্ব পালনে পুলিশ তার আস্থা হারিয়েছে৷ এরপর গত বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে পুলিশের ভূমিকা এবং তাদের ওপর হামলা বাহিনীটির মনোবল আরো ভেঙে দিয়েছে৷ তাই এবারের নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তায় সেনবাহিনীকে বড় ভূমিকা পালন করতে হবে৷
নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশন বিষয়ক আইনজীবী অ্যাডভোকেট আহসানুল করিম বলেন, ‘‘আগে তো সেনাবাহিনী স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসাবে দায়িত্ব পালন করতো৷ তাতে যা হতো তারা চাইলেও নিজেরা কোনো ব্যবস্থা নিতে পারতো না৷ ম্যাজিস্ট্রেটের ওপর নির্ভর করতে হতো৷ এখন যদি আরপিও সংশোধন করে তাদের নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া হয় তাহলে তারা স্বাধীনভাবে ব্যবস্থা নিতে পারবে, দায়িত্ব পালন করতে পারবে৷ তবে উপ-নির্বাচনের জন্য বারবার তাদের মোতায়েন করা কেমন হবে তা দেখতে হবে৷ বড় বা একসঙ্গে অনেক এলাকায় নির্বাচনের জন্য এটা ইতিবাচক৷’’
তারপরও সরকার, নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের মনোভাবের উপরই সুষ্ঠু নির্বাচন নির্ভর করে বলে উল্লেখ করেন তিনি৷
নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ বলেন, ‘‘নির্বাচন নিয়ে মানুষের মধ্যে এক ধরনের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে৷ আমরা মনে করেছি তাই শুধু জাতীয় নির্বাচনে নয়, সব নির্বাচনেই সেনাবাহিনী থাকা দরকার৷ সেই কারণে এটা সরকারের ইচ্ছাধীন না রেখে আমরা একটি আইনি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে এসেছি৷ এখন নির্বাচন কমিশন অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মতো সেনাবাহিনীর সঙ্গেও আলাপ আলোচনা করে প্রয়োজনীয় ফোর্স চাইতে পারবে৷ আর তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সব ধরনের দায়িত্বই পালন করতে পারবে৷ এটা এখন আইনের অধীন হলো৷’’
ভোট গ্রহণ বন্ধে ইসির বিধানে যা আছে
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ ও বন্ধ করাসহ বিভিন্ন নিয়ম কানুন জানিয়ে ১০ডিসেম্বর একটি পরিপত্র দিয়েছে ইসি৷ তাতে কী থাকছে দেখুন ছবিঘরে...
ছবি: Reuters/M. Ponir Hossain
ভোটগ্রহণের সময়
আগামী ৭ জানুয়ারি সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে চলবে ভোটগ্রহণ৷ গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী ২৮ ডিসেম্বর ভোটগ্রহণের দিন ও সময় উল্লেখ করে রিটার্নিং অফিসারগণ প্রত্যেক নির্বাচনি এলাকায় গণবিজ্ঞপ্তি জারি করবেন৷ (ছবি: ২০১৮ সালের নির্বাচন)
ছবি: DW/A. Islam
স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স
নির্বাচনের ভোট গ্রহণের জন্য স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স ছাড়া অন্য কোনো ধরনের বাক্স ব্যবহার করা যাবে না৷ ভোটকক্ষে একই সময়ে একাধিক ব্যালট বাক্স ব্যবহার করা যাবে না৷ একটি বাক্স ভর্তি হলে তা সবার সামনে সিল করে নির্ধারিত স্থানে রাখতে হবে৷
ছবি: Imago/Naim-ul-karim
প্রার্থীদের নাম ও প্রতীক
প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের নাম প্রতীকসহ পোস্টার প্রত্যেক ভোটকেন্দ্রে প্রদর্শন করতে হবে৷ এজন্য পোস্টার ছাপিয়ে প্রিজাইডিং অফিসারদের কাছে প্রয়োজনীয় সংখ্যক পোস্টার দেয়া হবে৷ (ছবি: ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন ২০২০)
ছবি: DW/Sazzad Hossain
কখন ভোট বন্ধ করা যাবে
ভোটগ্রহণ বিঘ্নিত বা বাধাগ্রস্ত হলে এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তা পুনরায় চালু করা না গেলে প্রিজাইডিং অফিসার ঐ কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ বন্ধ করে দেবেন৷ এছাড়া স্বচ্ছ ব্যালটবাক্স অপসারণ, ক্ষতিগ্রস্ত বা হারিয়ে গেলে এবং তার থেকে ঐ কেন্দ্রের ফলাফল নির্ধারণ করা না গেলেও তিনি ভোট বন্ধ করতে পারবেন৷ বিষয়টি রিটার্নিং অফিসারকে জানানোর পর তিনি নির্বাচন কমিশনের অনুমোদন নিয়ে ভোটগ্রহণের নতুন তারিখ নির্ধারণ করবেন৷
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
বন্ধ ভোটকেন্দ্রে আবার ভোট
বন্ধ কেন্দ্রের ভোট ছাড়াই যদি ঐ আসনের ফলাফল নির্ধারণ করা যায় তাহলে নতুন করে ভোটগ্রহণের প্রয়োজন হবে না৷ আর তা না হলে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে রিটার্নিং অফিসার আরেকটি দিন ও সময় ঠিক করে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করবেন৷ এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ভোটকেন্দ্রের সব ভোটারই ভোট দিতে পারবেন৷ বন্ধ ঘোষিত নির্বাচনের ভোটগণনা করা যাবে না৷
ছবি: Partho Sarothi Das
নির্বাচনি কার্যক্রম বন্ধের ক্ষমতা
নির্বাচনে বল প্রয়োগ, ভীতি প্রদর্শন, চাপ সৃষ্টির কারণে নিরপেক্ষেভাবে ও আইন অনুযায়ী নির্বাচন পরিচালনা করা না গেলে নির্দিষ্ট ভোটকেন্দ্র বা এমনকি যে কোন পর্যায়ে সম্পূর্ণ নির্বাচনী এলাকায় ভোট বন্ধ করে দিতে পারবে কমিশন৷ একই কারণে ভোট কেন্দ্রের ফলাফলও স্থগিত করা যাবে৷ অনুসন্ধানের পর তা প্রকাশ করা যাবে অথবা বাতিল ঘোষণা করে নতুনভাবে ভোট গ্রহণের নির্দেশ দেবে কমিশন৷
ছবি: bdnews24.com
ডাকযোগে ভোটগণনার বিবরণী
প্রিজাইডিং অফিসার ভোটকেন্দ্র থেকে সরাসরি ডাকযোগে ভোটগণনার বিবরণীর কপি পাঠাবেন৷ এজন্য প্রতিটি কেন্দ্রে ২টি বিশেষ খাম সরবরাহ করা হবে৷ নির্বাচন কমিশন প্রয়োজনীয় খাম ছাপিয়ে তা রিটার্নিং অফিসারদের দেবেন৷ এই খাম নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে পৌঁছানোর জন্য ভোটগ্রহণের দিন পোস্ট অফিসগুলো ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখতে ডাক বিভাগকে নির্দেশ দিয়েছে কমিশন৷