শনিবার আচমকাই পদত্যাগ করেছেন ভারতের অন্যতম নির্বাচন কমিশনার অরুণ গোয়েল। কেন পদত্যাগ, তা নিয়ে চলছে বিতর্ক।
বিজ্ঞাপন
ভারতের নির্বাচন কমিশনে তিনজন ব্যক্তির একটি বেঞ্চ থাকে। এরমধ্যে একজন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার এবং দুইজন নির্বাচন কমিশনার। জাতীয় নির্বাচনের মরসুমে একটি পদ আগেই খালি হয়েছিল। শনিবার অরুণ গোয়েল নির্বাচন কমিশনারের পদ থেকে ইস্তফা দেয়ায় বেঞ্চে কেবলমাত্র মুখ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব কুমারই থাকলেন।
অরুণ গোয়েলের নিয়োগ নিয়ে এর আগেই বিতর্ক হয়েছিল। ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে অবসর নেওয়ার পর তাকে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ দেওয়া হয়। সেই নিয়োগকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চে মামলা হয়। বিচারপতি সঞ্জীব খান্নার বেঞ্চ সেই মামলা শেষ পর্যন্ত খারিজ করে দেয়। কিন্তু গত শনিবার অরুণ গোয়েল আচমকা কেন ইস্তাফ দিলেন, তা নিয়ে নানা আলোচনা চলছে।
নির্বাচন কমিশনের একটি সূত্র জানাচ্ছে, কেন্দ্রীয় বাহিনীর মোতায়েন নিয়ে মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে মতভেদ হওয়ার কারণেই অরুণ ইস্তাফ দিয়েছেন। বিজেপির একটি সূত্র আবার ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছে, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে অরুণ প্রার্থী হতে পারেন। সে কারণেই এই ইস্তফা। ওই সূত্র দাবি করেছে, পাঞ্জাব ক্যাডার অরুণ গোয়েল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঘনিষ্ঠ।
লোকসভা নির্বাচন ২০২৪: নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ
পশ্চিমবঙ্গে এসে লোকসভা ভোট নিয়ে দুই দিন ধরে বৈঠক করলেন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার এবং অন্য কর্তারা।
ছবি: Subrata Goswami/DW
স্বচ্ছ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের স্বার্থে
পশ্চিমবঙ্গে স্বচ্ছ ও শান্তিপূর্ণ ভোটের স্বার্থে একগুচ্ছ ব্যবস্থা নেয়ার কথা ঘোষণা করলো নির্বাচন কমিশন। দুই দিন ধরে একগুচ্ছ বৈঠকের পর মুখ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব কুমার সাংবাদিক সম্মেলন করে ঘোষণা করেছেন, ''পশ্চিমবঙ্গে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করাতেই হবে পুলিশকে। তারা দায়িত্ব পালন না করলে কমিশন তাদের বাধ্য করবে।''
ছবি: Subrata Goswami/DW
দায়ী থাকবেন ডিজি
মুখ্য নির্বাচন কমিশনার(সিইসি) রাজীব কুমার জানিয়েছেন, ''পুলিশকেই শান্তি বজায় রাখতে হবে। কোনো গণ্ডগোল হলে তার জন্য দায়ী থাকবেন রাজ্য পুলিশের ডিরেক্টর জেনারেল(ডিজি)।'' কাকতালীয় হলেও রাজ্য পুলিশের ডিজির নামও রাজীব কুমার। সিইসি বলেছেন, ডিজিকে পুলিশ সুপার, থানার ওসি-দের এই ব্যাপারে স্পষ্ট নির্দেশ দিতে হবে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
'সব রিপোর্ট আছে'
সাংবাদিক সম্মেলনে সিইসি রাজীব কুমার বলেছেন, ''আমাদের কাছে সব রিপোর্ট আছে। পশ্চিমবঙ্গে সহিংসতা ও অর্থশক্তিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা কোনোভাবেই বরদাস্ত করা হবে না।'' তিনি জানিয়েছেন, ''মুখ্যসচিব ও ডিজিদের স্পষ্টভাবে বিষয়টি বলেছি। তারাও বলেছেন, শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য তারা বদ্ধপরিকর।''
ছবি: Subrata Goswami/DW
বিরোধীদের নালিশ
সিইসি-সহ কমিশনের কর্তারা রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও কথা বলেছেন। তণমূল, বিজেপি, কংগ্রেস, আপ, সিপিএম, ফরোয়ার্ড ব্লক-সহ কয়েকটি দলের সঙ্গে তাদের কথা হয়েছে। সিইসি রাজীব কুমার বলেছেন, ''একটি বাদে সব দল বলেছে, পর্যাপ্ত পরিমাণ কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করতে হবে।'' তাদের অভিযোগ, ''আমলাতন্ত্র নিরপেক্ষভাবে কাজ করে না। তারা ভয় দেখানোর অভিযোগও করেছেন।''
ছবি: Subrata Goswami/DW
'নির্বাচন হলো ১৪ পার্বণ'
সিইসি রাজীব কুমার বলেছেন, ''বাংলায় একটা কথা আছে, বারো মাসে তেরো পার্বণ। নির্বাচন হলো ১৪তম পার্বণ। সেখানে উৎসবের মাজাজ থাকতে হবে। ভয়ের বাতাবরণ সহ্য করা হবে না। মানুষ আসবেন, আনন্দ করে ভোট দেবেন। সহিংসতা ও ভয়মুক্ত নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে। প্রশাসন করতে না পারলে আমরা ওদের দিয়ে করাব। গোলমাল হলে পুলিশ দায়ী থাকবে।''
ছবি: Subrata Goswami/DW
অ্যাপ চালু হবে
সিইসি জানিয়েছেন, তারা একটা অ্যাপ চালু করবেন। সেখানে সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক দল, কোনো সংগঠনের তরফ থেকে অভিযোগ জানানো যাবে। ভোটে সহিংসতা, বেনিয়ম দেখলেই যেন সেখানে অভিযোগ করা হয়। অভিযোগ পাওয়ার পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঘটনাস্থলে গিয়ে তদন্ত করা হবে। তারপর কমিশনের সিদ্ধান্তও জানিয়ে দেয়া হবে। নির্বাচন উপলক্ষে তিনটি অ্যাপ চালু করছে নির্বাচন কমিশন।
ছবি: DW/O. Singh Janoti
সীমান্ত এলাকায় বিশেষ ব্যবস্থা
পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে তিনটি দেশের সীমান্ত আছে। সবচেয়ে বড় সীমান্ত বাংলাদেশের সঙ্গে। এছাড়া নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত আছে। সিইসি রাজীব কুমার জানিয়েছেন, সীমান্তে কড়া প্রহরা থাকবে। বিএসএফ-সহ সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে কথা হয়েছে এবং তাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
ছবি: Dipa Chakraborty/NurPhoto/picture alliance
কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে
সিইসি রাজীব কুমার জানিয়েছেন, ''পশ্চিমবঙ্গে পর্যাপ্ত কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকবে।'' কেন্দ্রীয় বাহিনী কোথায়, কীভাবে মোতায়েন করা হবে, সেটাও জানিয়েছেন তিনি। রাজীব কুমার জানিয়েছেন,, ''রাজ্য পুলিশ, নোডাল অফিসার ও সিইও আরিফ আফতাব এবং কমিশনের এক পর্যবেক্ষক মিলে সিদ্ধান্ত নেবে, কোন কোন এলাকা স্পর্শকাতর। জেলায় যখন বাহিনী পৌঁছে যাবে, তখন সিদ্ধান্ত নেবে ডিএম, এসপি ও কমিশনের জেলা পর্যবেক্ষক।''
ছবি: Payel Samanta/DW
মোট ভোটদাতা সাড়ে সাত কোটি
পশ্চিমবঙ্গে মোট ভোটদাতার সংখ্যা ৭ কোটি ৫৮ লাখ। এর মধ্যে পুরুষের সংখ্যা, ৩ কোটি ৮৫ লাখ ও নারী ভোটারের সংখ্যা ৩ কোটি ৭৩ লাখ।
ছবি: Payel Samanta/DW
9 ছবি1 | 9
অরুণ অবশ্য সংবাদমাধ্যমের সামনে এবিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। নির্বাচন কমিশনের তরফেও এবিষয়ে এখনো পর্যন্ত কোনো মন্তব্য করা হয়নি, কোনো বিবৃতিও দেওয়া হয়নি।
সরকারের একটি সূত্রের দাবি, চলতি সপ্তাহেই কেন্দ্রীয় সরকার দুই নতুন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করতে পারে। আর তা নিয়েই আশঙ্কা প্রকাশ করেছে কংগ্রেস। কংগ্রেসের মধ্যপ্রদেশের এক নেতা সুপ্রিম কোর্টে এবিষয়ে একটি মামলা রুজু করেছেন সোমবার। অভিযোগ, নরেন্দ্র মোদীর সরকার নিয়োগে হস্তক্ষেপ করতে পারে। আর সে ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা থাকবে না।
এদিকে জাতীয় নির্বাচনের পাশাপাশি এবছর ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ, অরুণাচল প্রদেশ, সিকিমেও বিধানসভা ভোট আছে। কেবলমাত্র মুখ্যনির্বাচন কমিশনারের পক্ষে একাজ করা সম্ভব কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
এবারের নির্বাচনে আরো একটি প্রশ্ন সামনে এসেছে। সরকারি পদ ছেড়ে তড়িঘড়ি নির্বাচনে অংশ নেওয়া কতটা নৈতিক। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, সম্প্রতি কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় পদে ইস্তফা দিয়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। তিনি সম্ভবত তমলুক থেকে বিজেপির প্রার্থী হবেন। আবার শনিবার পশ্চিমবঙ্গের রায়গঞ্জ রেঞ্জের পুলিশ আইজি প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় পদ থেকে ইস্তফা দেন, রোববারই তৃণমূল তাকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেছে। নির্বাচন কমিশনারের পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে অরুণ গোয়েলও যদি ভোটের প্রার্থী হন, তাহলে তা নিয়েও একই প্রশ্ন উঠবে।
এবিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ''ভারতীয় আইন অনুযায়ী পদে ইস্তফা দিয়ে যে কেউ নির্বাচনের পদপ্রার্থী হতে পারেন। কিন্তু মনে রাখা দরকার, তাদের একটি অতীত আছে। এবং সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দিলে নীতি এবং নৈতিকতার প্রশ্নটি সামনে আসে। সেই প্রশ্নটিকে কখনোই অস্বীকার করা যায় না।'' বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের বক্তব্য, যারা একাজ করছেন, তাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক।