প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সমাবেশে বিএনপি নির্বাচনে যেতে ছয়টি শর্ত দিয়েছে৷ এর মধ্যে প্রধান শর্ত হল নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তি৷ কিন্তু আওয়ামী লীগ মনে করে বিএনপি নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করতেই এসব শর্ত দিচ্ছে৷
বিজ্ঞাপন
শনিবার নয়াপল্টনে বিএনপি'র প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সমাবেশে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তাঁর বক্তৃতায় আগামী নির্বাচনে যাওয়ার আগে ছয়টি দাবি পূরণের কথা বলেছেন৷ শর্তগুলো হলো, প্রথমত, নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তি ও তাঁর নামে দেয়া সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে৷ আরো রয়েছে, একাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সরকারের পদত্যাগ, সংসদ ভেঙে দিতে হবে৷ নির্বাচনের আগে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে হবে, সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিতে হবে৷ বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে পুনর্গঠন করতে হবে৷
খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি সমাবেশে প্রধান দাবি হিসেবে উঠে এসেছে৷ বক্তারা বলেছেন বিএনপি'র চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার মুক্তি ছাড়া কোনো নির্বাচন নয়৷ জিয়া অর্ফানেজ ট্রাস্ট মামলায় ৫ বছরের কারাদণ্ড মাথায় নিয়ে খালেদা জিয়া গত ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে কারাগারে আছেন৷
সমাবেশে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বিএনপি'র স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী৷ তিনি রবিবার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা সরকারের কাছে এই দাবি পেশ করেছি৷ সরকার এ নিয়ে আলোচনা শুরু করতে পারে৷ কিন্তু সরকার যদি আলোচনায় না আসে তাহলে আন্দোলন হবে৷ আমরা আন্দোলন শুরু করবো৷ আর এটা তো শুধু বিএনপি'র দাবি নয়৷ বাম জোট এবং যুক্তফ্রন্টও দু'একটি ছাড়া একই ধরনের দাবি দিয়েছে৷ দাবির পক্ষে এখন অনেকগুলো দল৷ তাই যুগপৎ আন্দোলন হবে৷''
‘খালেদা জিয়ার মুক্তি ছাড়া নির্বাচন হবে না’
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘আমরা এখন ধারাবাহিক কর্মসূচি দেব৷ এই মাসেই অনেকগুলো কর্মসূচি দেয়া হবে৷ এভাবে ধারাবাহিক কর্মসূচির মাধ্যমেই আমরা চূড়ান্ত আন্দোলনের দিকে যাব৷ সাধারণ মানুষকে এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত করা হবে৷ আর সেই কাজ আমরা এরই মধ্যে শুরু করে দিয়েছি৷''
তিনি বলেন, ‘‘নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক করতে হলে আমাদের দাবিগুলো সরকারকে মানতে হবে৷''
খালেদা জিয়ার মুক্তির প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘‘এটা আমাদের এক নম্বর দাবি, দেশের নেতা-কর্মীরাও এটা চায়৷ আমরা বলেছি খালেদা জিয়ার মুক্তি ছাড়া নির্বাচন হবে না৷''
বিএনপি'র এইসব দাবির ব্যাপারে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ মাহবুব উল আলম হানিফ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘খালেদা জিয়াকে সরকার কারাদণ্ড দেয়নি৷ তাকে কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত অর্থ আত্মসাতের মামলায়৷ তার বিরুদ্ধে আরো মামলা আছে৷ এগুলোকে আইনগতভাবেই মোকাবেলা করতে হবে৷ আইন অনুযায়ী খালেদা জিয়া রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনাও করতে পারেন৷ এসব নিয়ে সরকারের কিছু নেই৷ বিএনপি জানে খালেদা জিয়াকে আইনগতভাবে নির্দোষ প্রমাণ করা যাবে না৷ তাই তারা আইনের পথে না গিয়ে তাকে মুক্তি দেয়ার অযৌক্তিক দাবি তুলছে৷''
‘বিএনপি ষড়যন্ত্র করছে’
তিনি আরো বলেন, ‘‘নির্বাচন হবে সাংবিধানিক পদ্ধতিতে৷ সংবিধানে যে রকম আছে সে রকমই নির্বাচন, নির্বাচনকালীন সরকার সব কিছু হবে৷ কোনো দলের দাবির কারণে সংবিধান পরিবর্তন করার প্রশ্নই ওঠে না৷ আর এটা করলে যে যার সুবিধামত সংবিধান পরিবর্তন করতে চাইবে৷''
নির্বাচন কমিশন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে রাষ্ট্রপতির গঠিত সার্চ কমিটির মাধ্যমে অত্যস্ত স্বচ্ছ উপায়ে৷ সেখানে আওয়ামী লীগ বিএনপিসহ আরো অনেক দল নাম দিয়েছে৷ সেখান থেকেই নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে৷ তাই নির্বাচন কমিশন নিয়ে বিএনপি'র দাবির কোনো যৌক্তিকতা নেই৷ বিএনপি সব সময়ই নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র করেছে৷ এবারো তাই করছে৷''
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘বিএনপি কঠোর আন্দোলন করবে কি করবে না এটা তাদের ব্যাপার৷ এ নিয়ে আমরা কোনো কথা বলতে চাই না৷ সরকার আছে৷ বিএনপি যদি আন্দোলনের নামে কোনো বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির চেষ্টা করে সেটা সরকার দেখবে৷''২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি ও তাদের জোটভুক্ত দলগুলো৷ তারা নির্বাচন প্রতিহতেরও ঘোষণা দিয়েছিল৷ তারা দাবি করেছিল নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন৷ ঐ একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসে৷ চলতি বছরের ডিসেম্বরের শেষ দিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা রয়েছে৷ তার আগে বিএনপি একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্যজোট গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে৷ তবে দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে নির্বাচনে বিএনপি যাবে কি যাবে না তা জানতে আরো অপেক্ষা করতে হবে৷
বিএনপির চার দশক
৪৫ বছরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, বিএনপি৷ দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দলটির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া৷ যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত আছেন সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান৷ এত বছরে কী ছিল দলটির পথচলা?
ছবি: Getty Images/Keystone
প্রেক্ষাপট
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনা সদস্যদের গুলিতে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন৷ এরপর প্রায় তিন বছর বাংলাদেশে ছিল অনির্বাচিত সরকার৷ সে সময় দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেন তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান৷ পরে ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন এগিয়ে এলে রাজনৈতিক দল গঠন করেন৷
ছবি: imago/Belga
প্রতিষ্ঠা
বিএনপি গঠন করার আগে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) নামে আরেকটি দল তৎকালীন উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে সভাপতি করে গঠন করা হয়েছিল৷ পরে তা বিলুপ্ত করে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে প্রধান করে গঠিত হয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, বিএনপি৷ ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর রমনা রেস্তোরাঁয় আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র পাঠ করে দলের যাত্রা করেন জিয়াউর রহমান৷
ছবি: imago/United Archives International
নির্বাচন ও মৃত্যু
জিয়া রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থাতেই ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন৷ এ নির্বাচনে বিএনপি ২৯৮টি আসনের মধ্যে ২০৭টিতে জয়লাভ করে৷ তখন মালেক উকিলের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ৩৯টি ও মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ২টি আসনে জেতে৷ নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেবার মাত্র দুই বছরের মাথায় ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন৷
ছবি: Getty Images/Keystone
খালেদার রাজনীতিতে আসা
জিয়ার মৃত্যুর পর নেতাকর্মীদের আহ্ববানে তিনি ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি বিএনপিতে যোগ দেন৷ ১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে তিনি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হন৷ ১৯৮৩ সালের ১ এপ্রিল দলের বর্ধিত সভায় প্রথম বক্তৃতা করেন৷ ১৯৮৪ সালের ১০মে পার্টির চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হন৷
ছবি: AP
এরশাদবিরোধী আন্দোলন ও খালেদা জিয়া
জিয়ার মৃত্যুর পর উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার রাষ্ট্রপতি হন৷ তবে তাঁকে হটিয়ে ১৯৮৩ সালে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতায় আসেন৷ বিএনপি জিয়াউর রহমানের স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার বিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে৷ এই আন্দোলনে বেগম জিয়া ও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দু’জনই ছিলেন, যদিও আপোষহীনতার কারণে খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়৷
ছবি: Getty Images/AFP/FARJANA K. GODHULY
সরকার গঠন
১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন৷ এ নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে বিএনপি৷ ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল প্রশ্নবিদ্ধ আরেকটি নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করে৷ কিন্তু আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলগুলোর প্রতিবাদে মাত্র ৪৫ দিন টিকতে পারে সেই সরকার৷
ছবি: AP
শেষবার সরকারে
২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় নির্বাচনে জিতে আবারো সরকার গঠন করে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট৷এই সরকারই ছিল বিএনপির শেষ সরকার৷ এই সরকারের মেয়াদ শেষ হবার পর নানা বিতর্ক ও ঘটনার প্রেক্ষাপটে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় ছিল প্রায় দুই বছর৷ সে সময় খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা উভয়কেই জেলে যেতেও হয়েছিল৷ পরে অবশ্য দু’জনই ছাড়া পান৷
ছবি: Getty Images
জোটের রাজনীতি
বিএনপি এ পর্যন্ত বারবার জোট করেছে৷ প্রথম সাতদলীয় জোট করে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে৷ এরপর জামায়াতে ইসলামীসহ গড়ে চারদলীয় জোট৷ পরবর্তীতে জোটে দলের সংখ্যা বাড়তে থাকে৷ সেটি ঠেকে বিশ দলীয় জোটে৷
ছবি: bdnews24.com
রাজনৈতিক ভুল ও কারাগারে খালেদা
সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পর আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট৷ এই নির্বাচনে অংশ না নেয়াকে অনেকেই রাজনৈতিক ভুল বলে মনে করেন৷ তাঁর বিরুদ্ধে থাকা নানা মামলার মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে করা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় আদালত তাঁকে কারাদণ্ড দেয়৷ আরো কয়েকটি মামলা চলছে তাঁর বিরুদ্ধে৷
ছবি: picture-alliance/epa/A. Abdullah
বিদেশে তারেক রহমান
মানি লন্ডারিংসহ নানা মামলায় বর্তমানে যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছেন জিয়াপুত্র ও দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান৷ নানা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় তিনি দেশে ফিরতে পারছেন না৷ এসব সংকট নিয়ে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে কিছুটা দুর্বল অবস্থায় আছে বলে মনে করেন অনেকেই৷