নির্বাচন পর্যবেক্ষণ: ইইউর প্রভাব কি যুক্তরাষ্ট্রের ওপর পড়বে?
হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
৮ অক্টোবর ২০২৩
ঢাকায় কাজ শুরু করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচনি পর্যবেক্ষক দল৷ রোববার তারা পররাষ্ট্রমন্ত্রী,পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে বৈঠক করেন৷ রাতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও বাংলাদেশি নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের সঙ্গে বৈঠকের কথা রয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সঙ্গে সোমবার বৈঠক করবেন তারা৷ এর আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল বাংলাদেশে সফর করে৷ এরপর ইউরোপীয় ইউনিয়ন জাতীয় নির্বাচনে তাদের পর্যবেক্ষক দল না পাঠানোর সিদ্ধান্ত জানায়৷
যুক্তরাষ্ট্র কী করবে সেটাই এখন প্রশ্ন৷ সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন মনে করেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের ওপরও প্রভাব ফেলতে পারে৷ আর যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির মনে করেন ইইউ-এর পর যুক্তরাষ্ট্রও একই সিদ্ধান্ত নিলে সেটা বাংলাদেশের জন্য দুঃখজনক হবে৷
যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) ও ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট (এনডিআই) যৌথভাবে প্রাক-নির্বাচন সমীক্ষা মিশন পরিচালনা করছে৷ এনডিআই এবং আইআরআই হল নির্দলীয় বেসরকারি সংস্থা, যা বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের অনুশীলনকে সমর্থন ও শক্তিশালী করতে কাজ করে৷ সংস্থা দুটি সম্মিলিতভাবে গত ৩০ বছরে ৫০টিরও বেশি দেশে ২০০টিরও বেশি নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছে৷
প্রতিনিধি দলটি আগামী ১২ অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রাক-নির্বাচন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে৷ তাদের মূল্যায়নের ওপরই নির্ভর করছে আগামী বছরের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জাতীয় নির্বাচনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পর্যবেক্ষক দল পাঠাবে কীনা৷
তারা পরিস্থিতি আরো ভালোভাবে বুঝতে পারবে: এম সাখাওয়াত হোসেন
তারা সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিসহ সার্বিক পরিস্থিতি সরেজমিনে যাচাই করবেন৷ বিশেষ করে নির্বাচনের পরিবেশের ওপর জোর দেবেন৷ ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের সূত্রে জানা যায়, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের জন্য এনডিআইয়ের নীতিমালার ঘোষণা অনুযায়ী একটি যৌথ প্রাক-নির্বাচন মূল্যায়ন মিশন (পিইএএম) পরিচালনা করতে তারা এসেছেন৷ সফরকালে পর্যবেক্ষক দলের সদস্যরা নির্বাচন কমিশন, সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও মন্ত্রণালয়, রাজনৈতিক দল, নাগরিক সংগঠন, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান এবং বাংলাদেশে কাজ করা বিদেশি দূতাবাস ও বিভিন্ন হাইকমিশনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করবেন৷
শনিবার ঢাকায় আসার পর রোববার দুপুরের পর তারা পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন এবং পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করেন৷ সোমবার তারা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সঙ্গে আলাদাভাবে বৈঠক করবেন৷ নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠকের কথা মঙ্গলবার৷
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, ‘‘তারা বাংলাদেশের সঙ্গে অনেক দিন ধরেই কাজ করছে৷ তারা বাংলাদেশে ১৯৯৬, ২০০৮ সালের নির্বাচনের সময় কাজ করেছে৷ তারা অনেক দিন ধরেই কাজ করছে এবং তাদের গ্রহণযোগ্যতা আছে৷”
যুক্তরাষ্ট্রও পর্যবেক্ষক না পাঠালে দুঃখজনক হবে: হুমায়ুন কবির
তিনি জানান, নির্বাচনের আইন কানুন, রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থা, নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি, মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতাসহ অবাধ,সুষ্ঠু ও অংশহণমূলক নির্বাচনের জন্য যা যা দরকার তার সবকিছুই তারা খতিয়ে দেখে৷
তিনি বলেন, ‘‘ইউরোপীয় ইউনিয়নের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও শেষ পর্যন্ত যদি নির্বাচনে পর্যবেক্ষক না পাঠায় তাহলে তা আমাদের জন্য দুঃখজনক হবে৷”
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল(অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন মনে করেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের ওপরও প্রভাব ফেলতে পারে৷ কারণ তারা একইভাবে কাজ করে৷ তারপরও তারা প্রাক-পর্যবেক্ষক দল পাঠিয়েছে তাদের মতো করে সার্বিক পরিস্থিতি অনুসন্ধান করতে৷
তিনি বলেন, ‘‘২০০৮ সালের নির্বাচনের সময় আমরা যখন নির্বাচন কমিশনে ছিলাম তখন ইইউ, যুক্তরাষ্ট্রসহ সব আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরাই এসেছিলেন৷ সেই সময়ের সঙ্গে এখনকার নির্বাচনি পরিবেশের তুলনা চলে না৷ আকাশ-পাতাল পার্থক্য৷”
তার মতে, নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় ইইউ দলের চেয়ে পরিস্থিতি আরো ভালোভাবে বুঝতে পারবে যুক্তরাষ্ট্রের এই দলটি৷ বলেন, ‘‘তারা যদি শেষ পর্যন্ত পর্যবেক্ষক পাঠায় তাদের টিম অত বড় হবে না৷ তারা দূতাবাসের মাধ্যমে এখান থেকেও লোক নিয়োগ দেয়৷”
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রণমূলক নির্বাচনের জন্য তৎপরতা দেখাচ্ছে৷ এরইমধ্যে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রণমূলক নির্বাচনের পথে যারা বাধা তাদের উপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিতে দিতে শুরু করেছে৷
নির্বাচনের আগে ভুয়া খবর বাড়ছে
নির্বাচনের সময় যত এগিয়ে আসছে অনলাইনে গুজব ও ভুয়া খবরের সংখ্যা তত বাড়ছে৷ জাতীয় নির্বাচনকে জড়িয়ে জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত সামাজিক মাধ্যম ও দেশীয় গণমাধ্যমে ৭৪টি ভুল তথ্য ছড়ানোর প্রমাণ পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার৷
ছবি: rumorscanner.com
নির্বাচনকে জড়িয়ে আট মাসে ৭৪টি ভুল তথ্য
গত জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত সামাজিক মাধ্যম ও দেশীয় গণমাধ্যমে প্রচারিত ১,০৮২টি ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে তথ্য যাচাইসংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশ করা রিউমর স্ক্যানার (https://rumorscanner.com/)৷ এর মধ্যে রাজনৈতিক বিষয়ে সবচেয়ে বেশি (২৪৮) ভুল তথ্য ছড়িয়েছে৷ গতবছর এই সংখ্যাটি ছিল ৯২৷ শুধু জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে জড়িয়ে গত আট মাসে ৭৪টি ভুল তথ্য ছড়ানোর প্রমাণ পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার৷
ছবি: Oleksandr Latkun/Zoonar/picture alliance
সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত ভুয়া খবর
সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ভুয়া খবরটি হচ্ছে, ‘প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে মির্জা ফখরুল ৫০ লাখ টাকা অর্থ সহায়তা নিয়েছেন’৷ রিউমর স্ক্যানার জানিয়েছে, চেকটি বার কাউন্সিলের একটি প্রণোদনার চেক থেকে সম্পাদনা করা এবং এর নম্বরটি ভুল ছিল৷
ছবি: rumorscanner.com
যাদের নিয়ে সবচেয়ে বেশি ভুয়া খবর
অনলাইন যাচাই ও মিডিয়া গবেষণা প্ল্যাটফর্ম ডিসমিসল্যাবের (https://dismislab.com/) হিসাবে গত জুলাই থেকে আগস্টের ২০ তারিখ পর্যন্ত যত মিথ্যা তথ্য ছড়িয়েছে তার ৪৪.৪ শতাংশই রাজনীতিবিষয়ক৷ রাজনীতিবিদদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভুয়া তথ্য ছড়িয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে৷ এরপর ছিলেন দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী৷
ছবি: dismislab.com
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে ভিত্তিহীন তথ্য প্রচার
সম্প্রতি ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ঘোষণার সাথে সাথে প্রায় ৭০-৮০ লক্ষ প্রবাসী দেশে আসতে প্রস্তুত’ শীর্ষক একটি তথ্য দৈনিক কালবেলার সূত্রে ফেসবুকে প্রচার করা হয়৷ কিন্তু আসলে এমন কোনো সংবাদ প্রকাশিত হয়নি৷ বিএনপি নেত্রী শামা ওবায়েদের নামে পরিচালিত দুটি ভুয়া ফেসবুক পেজেও এটি প্রচার করা হয়েছিল৷ তবে শামা ওবায়েদ রিউমর স্ক্যানারকে জানান, তার নামে একাধিক ভুয়া ফেসবুক পেজ আছে৷ এ বিষয়ে তিনি জিডি করেছেন৷
ছবি: rumorscanner.com
১০ বছর আগের প্রতিবেদন নতুন করে প্রচার
ব্রিটিশ সংবাদপত্র দ্য ইকোনমিস্ট ২০১৩ সালের এক প্রতিবেদনে বিভিন্ন জনমত জরিপের ভিত্তিতে বলেছিল, বাংলাদেশের চার-পঞ্চমাংশ মানুষ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়৷ ঐ প্রতিবেদন প্রকাশের তিনদিন পর বাংলাদেশের আমার দেশ পত্রিকায় ‘ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন: দেশের ৮০ ভাগ মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়’ নামে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল৷ প্রায় ১০ বছর আগের সেই প্রতিবেদনটির ছবি গত কয়েকমাসে ফেসবুকে আবার পোস্ট করা হয়েছে৷
ছবি: rumorscanner.com
পুরোনো ছবি দিয়ে আরাফাতের টুইট
মোহাম্মদ এ আরাফাত ২৯ জুলাই চারটি ছবি পোস্ট করে সেগুলো পুলিশের ওপর বিএনপি কর্মীদের সেদিনকার হামলার ছবি বলে দাবি করেন৷ তবে একটি ছবি ২০২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর পুলিশের সঙ্গে জামায়াতের সংঘর্ষ নিয়ে জনকণ্ঠে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ব্যবহৃত হয়েছিল৷ আরেকটি ২০২১ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবিতে মশাল মিছিলের সময় পুলিশের সাথে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষের সময় তোলা৷ তৃতীয় ছবি ২০১৫ সালে জাগোনিউজে প্রকাশিত হয়েছিল৷
ছবি: rumorscanner.com
মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে উদ্ধৃত করে ভুয়া তথ্য
‘অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব পাচ্ছেন ড. ইউনূস: পিটার হাস’ এই তথ্য দিয়ে প্রথম আলোর ওয়েবসাইটের প্রতিবেদনের আদলে তৈরি একটি স্ক্রিনশট ফেসবুকে প্রচার করা হয়৷ কিন্তু বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস এমন কোনো মন্তব্য করেননি৷ প্রথম আলোও এমন সংবাদ প্রকাশ করেনি৷ প্রকৃতপক্ষে প্রথম আলোর ওয়েব পেজের স্ক্রিনশট এডিট করে পিটার হাসের নামে ভুয়া বক্তব্য প্রচার করা হয়েছে৷
ছবি: United States Department of State
গয়েশ্বরের পুরোনো ছবি ব্যবহার
২৯ জুলাই ঢাকায় বিএনপির অবস্থান কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ধোলাইখালে সংঘর্ষের ঘটনায় বিএনপি নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় আহত হন৷ এই ঘটনার খবরের সঙ্গে ২০১৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর তোলা একটি রক্তাক্ত ছবি জুড়ে ফেসবুকে প্রচার করা হয়৷ ঐ বছরের ২৫ ডিসেম্বর ঢাকা-৩ আসনে গণসংযোগে চলাকালে কেরানীগঞ্জে এক হামলায় গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ অন্তত ২০ নেতা-কর্মী আহত হয়েছিলেন৷ উপরের ছবিটি ফাইল থেকে নেয়া৷
ছবি: Md Rafayat Haque Khan/Zuma/IMAGO
নিউইয়র্ক টাইমসকে উদ্ধৃত করে ভুল তথ্য প্রচার
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক টাইমসের বরাতে গত ২৯ আগস্ট থেকে ‘যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন করাতে ব্যর্থ হলে দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ ক্ষুন্ন হওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশে ভারতের মতো সাম্প্রদায়িক সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে’ এমন একটি তথ্য ফেসবুকে প্রচার শুরু হয়৷ কিন্তু নিউইয়র্ক টাইমসে এমন কোনো বক্তব্য প্রকাশিত হয়নি৷
ছবি: Imago Images/R.B. Levine
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা চায়নি যুক্তরাষ্ট্র
আগামী ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা চায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র- এমন একটি খবর দৈনিক কালবেলার সূত্র দিয়ে সম্প্রতি ফেসবুকে প্রচার করা হয়৷ এর আগে গত মাসে কোনো সূত্রের উল্লেখ না করেই খবরটি প্রচার করা হয়েছিল৷ তবে রিউমর স্ক্যানার অনুসন্ধান করে দেখেছে, কালবেলা এমন কোনো খবর প্রকাশ করেনি৷