1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

নির্বাচন পূর্ববর্তী বাজেট : জনতুষ্টির, নাকি সংকট মোকাবিলার

জাকির হোসেন
২৬ মে ২০২৩

আগামী ১ জুন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য জাতীয় বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার৷ জাতীয় নির্বাচনের আগে এটি হবে বর্তমান সরকারের শেষ বাজেট৷

বাংলাদেশ সংসদ ভবন৷
বাংলাদেশ সংসদ ভবন৷ছবি: picture alliance/Bildagentur-online/Tips Images

নির্বাচন সামনে রেখে সরকার সাধারণত ‘জনতুষ্টিমূলক’ বা ‘ভোট টানার’ বাজেট দিয়ে থাকে৷ অবশ্য এবারের বাজেটটি দিতে হচ্ছে ভিন্ন ও তুলনামূলকভাবে অধিকততর সংকটময় একটি অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে৷ এ কারণে নতুন বাজেটে জনতুষ্টির তুলনায় সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার দিকেই সরকারের বেশি মনোযোগ থাকবে বলে নীতি-নির্ধারকদের বক্তব্যে আভাস পাওয়া যাচ্ছে৷ 

বাজেট সামনে রেখে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ আরেকটি নতুন প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে৷ অর্থনীতির সংকট মোকাবিলায় সরকারকে আইএমএফের কাছ থেকে  ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ নিতে হচ্ছে৷ ঋণের প্রথম কিস্তির অর্থ ইতিমধ্যে পাওয়া গেছে৷ এই ঋণের বেশ কিছু শর্ত রয়েছে, যার মধ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমানো অন্যতম৷ ভর্তুকি কমাতে সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে গড়ে ৫০ শতাংশ৷ কয়েক দফায় দাম বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের৷ গ্যাসের দামও বাড়ানো হয়েছে৷ আগামীতে আরও হয়তো দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হতে পারে৷ জনতুষ্টিমূলক না হলেও সরকারকে আর্থিক শৃঙ্খলার জন্য এ ধরণের পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে৷ আইএমএফের ঋণের পরবর্তী কিস্তিগুলো পেতে আগামীতে নতুন কর আরোপ, সুদের হার বাড়ানো, মুদ্রার বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার মতো বিভিন্ন সংস্কারের মধ্যে যেতে হবে, যা জনপ্রিয় নাও হতে পারে৷ 

অবশ্য নির্বাচনের আগে পদ্মা সেতু এবং ঢাকায় মেট্র্র্রোরেলের আংশিক চালু জনগণের প্রশংসা পেয়েছে৷ অর্থনীতিতে চাপের মাঝেও নিকট মেয়াদে এ ধরণের দৃশ্যমান বড় প্রকল্পের উদ্বাধন কিংবা বাস্তবায়ন জোরদার করে ভোটারদের ভাবনাকে প্রভাবিত  করার চেষ্টা থাকতে পারে৷ উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বার্ষিক ইনক্রিমেন্টের হার বাড়তে পারে বলেও শোনা যাচ্ছে৷ নির্বাচনী ভাবনা থেকে এ জাতীয় কিছু উদ্যোগ আগামী বাজেটে থাকতে পারে৷

আগামী অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) যা চলতি মাসে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ অনুমোদন করেছে, তাতে ‘ফাষ্ট ট্র্যাক’ বা দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য অগ্রাধিকার তালিকার প্রকল্পগুলোতে বড় অংকের বরাদ্দ রাখা হয়েছে৷ ‘ফাষ্ট ট্র্যাক’ তালিকার বাইরে কিছু বড় অবকাঠামো প্রকল্পে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে৷ বরাদ্দের বিবেচনায় শীর্ষ-১০টি প্রকল্পের মধ্যে মেট্রো রেল, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর সম্প্রসারণ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ ৯ টি ভৌত অবকাঠামো প্রকল্প রয়েছে৷ পরিকল্পনা কমিশন গত মার্চে এডিপি প্রণয়নের যে নীতিমালা প্রকাশ করে সেখানে ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পে অগ্রাধিকার দেওয়ার পাশাপাশি ধীরগতির প্রকল্পে বরাদ্দ কমিয়ে দ্রুত গতির প্রকল্পে বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে৷ বরাদ্দের ক্ষেত্রে বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় খাদ্য নিরাপত্তা এবং কৃষি খাতে বিশেষ জোর দেওয়ার তাগিদ রয়েছে ওই নীতিমালায়৷ দারিদ্র্য বিমোচনের সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট প্রকল্পে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে৷ এসব পদক্ষেপের সঙ্গে নির্বাচনী ভাবনার যোগসূত্র থাকতে পারে বলে ধারণা করা যায়৷

কেমন আছে অর্থনীতি

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কয়েক বছরের মধ্যে সামষ্টিক অর্থনীতি এখন সবচেয়ে চাপে রয়েছে৷ কোভিড সংক্রমণ কমে আসার পরিপ্রেক্ষিতে চাহিদা বেড়ে অর্থনীতি যখন পুনরুদ্ধারের পথে তখন অভ্যন্তরীণ নানা কারণে সামষ্টিক অর্থনীতি চাপের মুখে পড়ে এবং এখনও অব্যাহত রয়েছে৷ মূল্যস্ফীতির হার এখন প্রায় দেড় দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে৷ গত এপ্রিল মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ৷ চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ৷ সরকার চলতি অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশে সীমিত রাখার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল৷ বোঝাই যাচ্ছে, সরকারের ধারণার চেয়ে মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি হচ্ছে৷ উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সমাজের একটি বড় অংশের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে৷ আর এর সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ছে দরিদ্র্য ও নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাপনে৷  

বর্তমান সরকারের দায়িত্বের প্রথম তিন বছরে মূল্যস্ফীতি মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে ছিল৷ দায়িত্ব গ্রহণের অর্থবছরে (২০১৮-১৯) বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৫২ শতাংশ৷ পরের দুটি অর্থবছরেও মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের নিচে ছিল৷ ২০২১-২২ অর্থবছরে করোনা পরবর্তী চাহিদা বৃদ্ধির সময়কালে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৬ দশমিক ১ শতাংশ দাঁড়ায়৷চলতি অর্থবছরেই মূল্যস্ফীতি দ্রুত বাড়তে থাকে, যার অন্যতম কারণ হিসেবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবকে দায়ী করা হচ্ছে৷ যদিও ভারতসহ কয়েকটি দেশ অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সম্প্রতি মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে৷ 

অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের কারণে স্থানীয় মুদ্রা টাকার ধারাবাহিক পতন হচ্ছে৷ এক বছরের মধ্যে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১২ বিলিয়ন ডলার কমে ৩০ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে৷ ডলারের বিপরীতে টাকার পতন হয়েছে গত এক বছরে ২৪ শতাংশ ৷ সর্বশেষ গত এপ্রিল মাসে রপ্তানি আয় কমেছে ১৬ শতাংশের মতো৷ প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স কমেছে একই হারে৷ যদিও এপ্রিলসহ গত ১০ মাসে রপ্তানি ও রেমিট্যান্সে সামান্য প্রবৃদ্ধি রয়েছে৷ আবার এ সময়ে বিদেশি বিনিয়োগ এবং ঋণ কমে গেছে৷ অবশ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা নিয়ন্ত্রণে আমদানি ব্যয় কমেছে৷ তারপরও বহির্বিশ্বের সাথে লেনদেন উচ্চ ৮ বিলিয়ন ডলারের মতো ঘাটতি রয়েছে৷

চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) আগের অর্থবছরের চেয়ে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ বাড়বে ধরে নিয়ে সরকার বাজেট দিয়েছিল৷ সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জিডিপির সাময়িক হিসাব প্রকাশ করেছে, যেখানে প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করা হয়েছে ৬ দশমিক শুন্য ৮ শতাংশ৷ প্রবৃদ্ধির এ হার সরকারের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম, তবে আইএমএফের পূর্বাভাসের কাছাকাছি৷ আইএমএফ চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশে সাড়ে ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছিল৷

আগামী অর্থবছরেও থাকবে কৃচ্ছসাধন

সরকার তার লক্ষ্যমাত্রা অনুযাযী রাজস্ব আয় করতে পারছে না৷ চলতি অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে রাজস্ব সংগ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা৷ মার্চ পর্যন্ত ৯ মাসে এনবিআর সংগ্রহ করেছে ২ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা৷ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে গেলে এনবিআরকে বাকি তিন মাসে ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা আয় করতে হবে, যা সম্ভব নয়৷ লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় এনবিআর অন্ততঃ ৫০ হাজার কোটি টাকা পিছিয়ে থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে৷

প্রত্যাশিত আয় না হওয়ায় ব্যয়ের ক্ষেত্রে কৃচ্ছ সাধনের কথা সরকারই বারবার বলছে৷ চলতি অর্থবছরে সরকার উন্নয়ন প্রকল্পগুলোকে তিনটি ক্যাটাগির করে তুলনামূলক কম জরুরি প্রকল্পে ব্যয় কমিয়ে দিয়েছে৷ অর্থনীতিতে সংকটের কারণে প্রকল্পগুলোকে ‘এ’, ‘বি’ এবং ‘সি’ ক্যাটাগরিতে ভাগ করে সরকার অর্থ খরচ করছে৷ উন্নয়ন প্রকল্পের বাইরে সরকারের পরিচালন ব্যয়ে বিদেশ ভ্রমণ, বিভিন্ন ভাতা এবং কেনাকাটার ক্ষেত্রে ব্যয়সাশ্রয়ী বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে৷ আগামী অর্থবছরেও কৃচ্ছসাধনের পদক্ষেপ অব্যাহত থাকবে থাকবে বলে সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন৷ গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী সম্প্রতি আগামী বাজেট নিয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী অর্থবছরেও যথাসম্ভব ব্যয় সাশ্রয়ের নির্দেশনা দিয়েছেন৷

জাকির হোসেন, সাংবাদিকছবি: privat

বাজেট তাহলে কেমন হবে

আগামী বাজেটের ব্যয় ধরা হচ্ছে ৭ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি, যা মোট জিডিপির ১৫ দশমিক ২ শতাংশ৷ মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির তুলনায় এই অংককে সম্প্রসারণমূলক বলা যাবে না৷ চলতি অর্থবছরের বাজেটও জিডিপির অনুপাতে একই ছিল৷ যদিও কোনো বছরই পুরো বরাদ্দ খরচ হয় না৷ আগামী বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৫ লাখ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১০ শতাংশ৷ চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল জিডিপির ৯ দশমিক ৭ শতাংশ৷ ফলে ব্যয়ের তুলনায় আয় বাড়ানোর ওপর জোর বেশি দেওয়া হচ্ছে৷ এ জন্য অনেক ক্ষেত্রে করের হার বাড়বে এবং করছাড় কমবে৷

সম্প্রতি পরিকল্পনা মন্ত্রী এম.এ. মান্নান বলেছেন, সরকার জনতুষ্টির নয়, জনকল্যাণের বাজেট দিতে যাচ্ছে৷ ব্যয়ের ক্ষেত্রে কৃচ্ছসাধনের প্রয়াসও আগামী অর্থবছরে বজায় থাকবে বলে তিনি মন্তব্য করেছেন৷ অন্য নীতি–নির্ধারকদের বক্তব্যেও আভাস পাওয়া যাচ্ছে, অর্থনীতি যাতে আরও সংকটে না পড়ে, সেদিকেই বেশি মনোযোগ থাকবে সরকারের৷ এ জন্য আয় বাড়ানো এবং ব্যয়ের ক্ষেত্রে সংযত হওয়ার পদক্ষেপ থাকবে৷ অন্যদিকে জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা, দারিদ্র্যবান্ধব বিভিন্ন কর্মসূচি, বড় অবকাঠামো প্রকল্পে অগ্রাধিকার দেওয়ার মতো কিছু পদক্ষেপ থাকবে৷ ফলে একটি ‘মিশ্র ঝুঁড়ির' বাজেট করার সম্ভাবনাই প্রবল হচ্ছে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ