বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া প্রহসনের নির্বাচন বাতিল করে সরকারকে সমঝোতায় আসার আহ্বান জানিয়েছেন৷ সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলনের পর, খালেদা জিয়া এই আহ্বান জানান৷ তা নাহলে বিএনপি আন্দোলনেই থাকবে৷
বিজ্ঞাপন
খালেদা জিয়া তাঁর বিবৃতিতে বলেন, ৫ই জানুয়ারির ‘কলঙ্কময় প্রহসন'-কে জনগণ বর্জন করেছে৷ তাই অবিলম্বে সরকারকে এই নির্বাচন বাতিল করতে হবে৷ একই সঙ্গে সরকারকে পদত্যাগ করে একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে এবং সকলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারকে সমঝোতায় আসার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি৷ তবে প্রহসনের নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করায় দেশবাসীকে ধন্যবাদও জানান বিএনপি চেয়ারপার্সন৷
এদিকে বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা আহমেদ আজম খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, রবিবারের ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার পুরোপুরি অবৈধ হয়ে গেছে৷ তাই এই অবৈধ সরকারের সঙ্গে কোনো আলোচনা নয়৷ আন্দোলনের মাধ্যমেই অবৈধ সরকারকে বিদায় করা হবে৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে জানান, চলমান আন্দোলন অব্যাহত রাখার পাশাপাশি নতুন আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে৷ নতুন আন্দোলনে নেয়া হবে নতুন কৌশল৷ আর এ জন্য বিএনপির শীর্ষ নেতারা ১৮ দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে নতুন কর্মসূচি ঠিক করবেন৷
তিনি বলেন, শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে আলোচনা এবং সমঝোতার কথা বলে জনগনকে নতুন করে বিভ্রান্ত করার কাজে নেমেছেন৷ তিনি জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করে আলোচনা এবং সমঝোতায় আসার আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপিকে৷ এটা শেখ হাসিনার নতুন ভাওতাবাজি ছাড়া আর কিছুই না বলে মন্তব্য করেন আহমেদ আজম খান৷ তিনি প্রশ্ন করেন, জামায়াতে ইসলামী সন্ত্রাসী দল হলে সরকার তাদের নিষিদ্ধ করে না কেন? নিষিদ্ধ করলেই তো বিএনপি এবং ১৮ দলের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক থাকবে না৷ তিনি বলেন, এই জামায়াতকে নিয়েই অতীতে আওয়ামী লীগ এক সঙ্গে বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে৷
ওদিকে খালেদা জিয়ার বড় ছেলে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানও লন্ডনে এক সংবাদ সম্মেলনে অবৈধ সরকারের সঙ্গে কোনো আলোচনা বা সমঝোতার সম্ভাবনাকে নাকোচ করে দিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন৷ তিনি বলেন, জনগণ নির্বাচন বর্জন করায় আন্দোলনের প্রথম ধাপ শেষ হয়েছে৷ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া গ্রহণযোগ্য কোনো নির্বাচন হবে না৷ আর সেটা, আন্দোলনের মাধ্যমেই আসবে বলে মনে করেন তিনি৷
যুক্তরাজ্যের আহ্বান
অন্যদিকে বাংলাদেশের নতুন সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে দেশ ও জনগণের স্বার্থে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাজ্য৷ নির্বাচনের পরের দিন সোমবার, ব্রিটিশ ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েল্থ অফিসের সিনিয়র মিনিস্টার ব্যারেনেস সাঈদা ওয়ারসি এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের নির্বাচনের ফলাফল গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে তার দেশ৷ তিনি বিবৃতিতে বলেন, নির্বাচনে ভোট পড়েছে কম৷ আর অর্ধেকেরও বেশি আসনে নির্বাচন না হওয়ায় মানুষ ভোটদানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন৷ তাই সহিংসতা এড়িয়ে আগামীতে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর একসঙ্গে কাজ করা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি৷
গুলশানের বাসভবনে ‘অবরুদ্ধ’ খালেদা জিয়া
বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে তাঁর গুলশানের বাসভবনে কার্যত ‘অবরুদ্ধ’ করে রাখা হয়েছে৷ রবিবার তিনি পুলিশের বাধার কারণে বাড়ি থেকে বের হতে পারেননি৷ এই বিষয়ে আমাদের ছবিঘর৷
ছবি: DW/M. Mamun
বাড়ি থেকে বেরোনোর চেষ্টা
‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ বা ‘গণতন্ত্রের অভিযাত্রা’য় অংশ নিতে রবিবার স্থানীয় সময় দুপুর তিনটার দিকে গুলশানের বাড়ি থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া৷ কিন্তু তাঁর পথরোধ করতে বাড়ির গেটে মানব দেয়াল তৈরি করে পুলিশ এবং ব়্যাবের সদস্যরা৷
ছবি: DW/M. Mamun
আটকে ছিলেন গেটে
পুলিশ এবং ব়্যাব সদস্যদের বাধার মুখে বেশ কিছুক্ষণ গাড়ির মধ্যে বসে ছিলেন খালেদা জিয়া৷ এরপর এক পর্যায়ে গাড়ি থেকে বের হয়ে আসেন তিনি৷
ছবি: DW/M. Mamun
ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া
গাড়ি থেকে বেরিয়ে পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন বিরোধী দলীয় নেত্রী৷ এসময় তিনি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন৷ উপস্থিত পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশ্যে খালেদা বলেন, ‘‘দেশ আজ কোথায় যাচ্ছে? এরা সবাই গোপালগঞ্জের৷ গোপালগঞ্জের নামই বদলে যাবে৷’’ দৈনিক প্রথম আলো খালেদার এই বক্তব্য প্রকাশ করেছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
সোমবারও চলবে কর্মসূচি
নিরাপত্তা বাহিনীর বাধার মুখে শেষ পর্যন্ত বাড়ি থেকে বের হতে পারেননি খালেদা জিয়া৷ তবে তিনি বাড়ির মধ্যে ফিরে যাবার আগে উপস্থিত গণমাধ্যম কর্মীদের বলেন, ‘‘এই সরকার জালেম এবং অগণতান্ত্রিক৷ এই সরকারের পতন হবেই৷’’ এসময় তিনি ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ সোমবারও চলবে বলে ঘোষণা দেন৷
ছবি: DW/M. Mamun
বালুভর্তি ট্রাকের ব্যারিকেড
খালেদা জিয়ার বাড়ির চারপাশে গত কয়েকদিন ধরেই পুলিশের ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছিল৷ শনিবার তাঁর বাড়ির সামনের রাস্তায় সাধারণ ব্যারিকেডের পাশাপাশি বালুভর্তি ট্রাকও যোগ করা হয়৷ কয়েকটি ট্রাক এমনভাবে রাখা হয়, যাতে খালেদার গাড়ি বাড়ির সামনের রাস্তা থেকে বের হতে না পারে৷ আমাদের ঢাকা প্রতিনিধি হারুন উর রশিদ স্বপন জানান, খালেদা জিয়াকে কার্যত গুলশানের বাড়িতে ‘অবরুদ্ধ’ করে রাখা হয়েছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
পুলিশের বক্তব্য
খালেদা জিয়াকে বাড়ির বাইরে যেতে না দেয়া প্রসঙ্গে পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘নয়াপল্টনে কোনো জমায়েত বা সমাবেশের অনুমতি নেই৷ তাই বিরোধী দলীয় নেত্রীকে সেখানে যেতে দেয়া হবে না৷ আর তাঁর নিরাপত্তার বিষয়টিও পুলিশের দেখার আছে৷’’
ছবি: DW/M. Mamun
প্রাণহানি
এদিকে, ‘গণতন্ত্রের অভিযাত্রা’কে ঘিরে সংঘর্ষ এবং বিস্ফোরণে ঢাকায় কমপক্ষে দুই ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছেন৷ রবিবার সকাল এগারোটার দিকে ঢাকার মালিবাগে পুলিশ আর জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে প্রাণ হারান মনসুর আলী৷ অন্যদিকে, কমলাপুরে তল্লাশির সময় বোমার বিস্ফোরণে নিহত হন নিরাপত্তাকর্মী আবুল কাশেম৷
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP/Getty Images
সুপ্রিমকোর্টে তাণ্ডব
এদিকে, ‘গণতন্ত্রের অভিযাত্রা’য় যোগ দিতে সুপ্রিমকোর্টের বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা কোর্টের মূল গেট দিয়ে মিছিল করে নয়াপল্টনে যেতে চাইলে পুলিশ তাদের জল কামান ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে আটকে দেয়৷ এরপর তারা ভিতরে গিয়ে পুলিশের প্রতি ইট পাটকেল ছোড়ে৷ এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগের একদল সমর্থক সুপ্রিমকোর্ট চত্বরে ঢুকে বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়৷ সেখানে কয়েকজন আইনজীবী আহত হন৷
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP/Getty Images
বিরল সংঘর্ষ
বলাবাহুল্য, সাম্প্রতিক সময়ে সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটলেও বাইরে থেকে কোন দলের নেতাকর্মীরা সেখানে গিয়ে সংঘর্ষে অংশ নেয়নি৷ সেক্ষেত্রে রবিবার আওয়ামী লীগ সমর্থকদের আদালত চত্বরে প্রবেশ করে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়াটা বিরল ঘটনা বলে অবিহিত করেন আমাদের ঢাকা প্রতিনিধি৷
ছবি: Reuters
চুপচাপ নয়াপল্টন
‘গণতন্ত্রের অভিযাত্রা’ কর্মসূচির আওতায় গোটা দেশ থেকে সক্ষম নেতাকর্মীদের ২৯ ডিসেম্বর, রবিবার বিএনপির নয়াপল্টন কার্যালয়ে হাজির হওয়ার আহ্বান জানান খালেদা জিয়া৷ কিন্তু রবিবার বিএনপি কার্যালয়ের সামনে বিএনপির নেতাকর্মীরা জড়ো হতে পারেনি৷ কিছু নেতাকর্মী কার্যালয়ের সামনে যেতে চাইলে তাদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ৷ ফলে বিএনপি কার্যালয়ের সামনে দৃশ্যত পুলিশ এবং সাংবাদিক ছাড়া কেউ ছিল না৷
ছবি: DW/M. Mamun
পাঁচ জানুয়ারি নির্বাচন
উল্লেখ্য, আগামী পাঁচ জানুয়ারি বাংলাদেশে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে৷ প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট এই নির্বাচন বর্জন করায় এবার ১৫৪টি আসনে ভোটাভুটির দরকার হচ্ছে না৷ এসব আসনে একজন করে প্রার্থী রয়েছে৷ ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কমনওয়েলথ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই নির্বাচন পর্যবেক্ষণ না করার ঘোষণা দিয়েছে৷