1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ভারতের আরেক নির্ভয়া

রাজীব চক্রবর্তী নতুন দিল্লি
১৭ মে ২০১৭

ভারতে নারী সুরক্ষা কি সেই তিমিরেই?‌ ক্রমশ অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে আস্ত সমাজটাই৷ গণধর্ষণ এবং নৃশংসতার যেন প্রতিযোগিতা চলছে৷ শুধু বদলে যাচ্ছে নির্যাতিতা ও তাঁর শহর৷ পুরুষের বিকৃতকামের বলি হতে হচ্ছে লাখো নির্ভয়াকে৷

Vergewaltigungsfälle in Indien
ছবি: picture alliance/AP Photo

তাহলে, শাসন কিংবা শাস্তির ভয়?‌ ওসব আছে আইনের বইয়ের পাতায়৷ দেশের নারী সুরক্ষা আজও প্রশ্নচিহ্নের মুখে৷

বছর পাঁচেক আগে দিল্লিতে চলন্ত বাসে এক প্যারামেডিকেল ছাত্রীকে গণধর্ষণের পরে অকথ্য অত্যাচার করে মৃতপ্রায় নগ্ন অবস্থায় রাস্তার পাশে ফেলে পালিয়ে যায় পাষণ্ডরা৷ বাসের চাকায় পিষে মারার চেষ্টাও করেছিল তারা৷ সে যাত্রায় আর ঘরে ফেরা হয়নি মেয়েটির৷ গোটা ভারতের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল মেয়েটির ওপর পাশবিক (‌পশুরাও বোধহয় এমন অত্যাচার করে না)‌ অত্যাচার৷ গণআন্দোলন জন্ম নিয়েছিল দিল্লির বুকে৷ ২৩ বছরের সেই মেয়ে জ্যোতি সিংয়ের নাম রাখা হয়েছিল নির্ভয়া৷ এই তো ক’দিন আগেই দেশের সর্বোচ্চ আদালত ৪ নরাধমকে ফাঁসির সাজা শুনিয়েছে৷ কিন্তু, তাতেও এতটুকু পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়নি৷ আর তার ঠিক তিন দিনের মাথাতেই ফের আরও এক নির্ভয়ার খোঁজ পাওয়া গেল৷ দিল্লির নির্ভয়ার মতোই ধর্ষণের পর হরিয়ানার এই নির্ভয়ার যৌনাঙ্গও ছিন্নভিন্ন করে দেওয়া হলো৷ থেঁতলে দেওয়া হলো তাঁর মুখ৷ ৯ মে নৃশংস এই ঘটনাটি ঘটেছে হরিয়ানার রোহতাক জেলায়৷ ঘটনার দিন হেঁটে অফিস যাচ্ছিলেন ওই তরুণী৷ মাঝ রাস্তা থেকেই তাঁকে অপহরণ করে সাত জন৷ রোহতাকের এক ফাঁকা জায়গায় নিয়ে গিয়ে গণধর্ষণ করা হয় তাঁকে৷ এখানেই শেষ নয়৷ যন্ত্রণায় কাতরানো ওই তরুণীর যৌনাঙ্গে ধারালো অস্ত্র ঢুকিয়ে দেওয়া হয়৷ তাঁর পরিচয় যাতে কেউ জানতে না পারে, তার জন্য একটি গাড়ি তাঁর মাথার উপর দিয়ে চালিয়ে দেওয়া হয়৷ নির্যাতিতার মুখ ও শরীরের কিছু অংশ রাস্তার কুকুরেও কামড়েছে৷ হিংস্রতা এমনও হয়!

বিবাহবিচ্ছেদের পর বাবা মা'র সঙ্গেই থাকতেন বছর ২৩-এর ওই যুবতী৷ গত মঙ্গলবার সোনিপত থেকে তাঁকে অপহরণ করা হয়৷ মেয়ে রাতে বাড়ি না ফেরায় তরুণীর পরিবার পরের দিন পুলিশে নিখোঁজ ডায়েরি করেন৷ সেই ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে তার তিন দিন পর, ১২ মে রোহতাকের ওই ফাঁকা এলাকা থেকে ওই তরুণীর মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ৷ কিন্তু তাঁর মাথা এতটাই থ্যাঁতলানো ছিল যে তাঁকে চিনতে পারেনি পুলিশ৷ পরিবারকে খবর দিলে তাঁরাই থানায় গিয়ে তাঁকে শনাক্ত করেন৷

‌পুরোনো কথা মনে পড়ছে সবার৷ সেই ২০১২-র ১২ ডিসেম্বর, সঙ্গীর সঙ্গে সিনেমা দেখে বাসে বাড়ি ফিরছিলেন ফিজিওথেরাপির ছাত্রী জ্যোতি সিংহ৷ সেই বাসে ছিল আরও ছয় জন৷ বাস চলতে শুরু করলে জ্যোতির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে অন্যেরা৷ সঙ্গীর সামনেই জ্যোতিকে একে একে ধর্ষণ করে ছয় জন৷ ধর্ষণের পর নৃশংস অত্যাচার করা হয় তাঁর উপর৷ এই ঘটনা সামনে আসার পর বিচার চেয়ে সারা দেশে তোলপাড় হয়৷ পরে ছয় অপরাধীকেই গ্রেপ্তার করে পুলিশ৷ এক জন নাবালক হওয়ায় জুভেনাইল কোর্টে তিন বছরের সাজা মেলে তার৷ ২০১৫ সালে সে ছাড়া পেয়ে যায়৷ মামলা চলাকালীনই ২০১৩-র মার্চে তিহার জেলে আত্মহত্যা করে আর এক অভিযুক্ত৷ আর বাকি চার অপরাধীর ফাঁসির সাজা হয়৷ রাজধানীর ওই ঘটনার নৃশংসতার স্মৃতি আজও তাজা৷ অপরাধীদের এই শাস্তিতে সমাজে অপরাধ আদৌ কমবে কি না তা নিয়ে সংশয় ছিলই, হরিয়ানার এই ঘটনায় সেই প্রশ্ন আরও জোরালো হলো৷ 

‘‘একটা দেশে যখন ধন-‌বৈষম্য তৈরি হয়, তখন মানুষ চাওয়ার বিষয়টি কেড়ে নিতে চায়’’

This browser does not support the audio element.

সমগ্র বিষয়টাকে অন্যভাবে দেখেন বাংলার বিশিষ্ট কবি ও রাজনীতিক৷ তাঁর কথায়, ‘‘‌একটা দেশ বা রাষ্ট্রে যখন ধন-‌বৈষম্য তৈরি হয়, তখন সমাজ, আইন-‌কানুনকে আর কেউ মানতে চায় না৷ মানুষের মনে হয়, আমি যা চাই তা কেড়ে নেবো৷ স্বার্থপরতা প্রকট আকার ধারণ করে৷ সামজের প্রতি ভালোবাসা বলে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না৷ তাই ধর্ষণের মতো ভয়ঙ্কর অপরাধও বাড়ছে৷ অমানবিক নৃশংসতা বাড়ছে৷ এর প্রধান কারণই হলো, এক শ্রেণির হাতে প্রচুর অর্থ এবং উল্টোদিকে গরিব ও বেকারত্ব বেড়ে যাওয়া৷ দেশ, সমাজ এবং অপরকে সম্মান করার মানসিকতার ভিত আজকে নড়বড়ে৷ ধর্ষণকারীদের প্রতি সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে৷ সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে৷ সর্বোপরি পুঁজিপতি অর্থ ব্যবস্থার পরিবর্তন করতেই হবে৷’’

মেয়েটির পরিবারের হাল কেমন হতে পারে?‌

ছোট্ট এক ঘরের ফ্ল্যাটের মেঝেতে শুয়ে রয়েছেন মা৷ দিল্লি থেকে ৪৩ কিলোমিটার দূরে৷ মেয়েকে গণধর্ষণ করে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে জানার পরে তিনি আর হাঁটাচলা করতে পারছেন না৷ শুধু গণধর্ষণের যন্ত্রণা নয়, মেয়েটিকে যাতে পরে চেনা না যায়, তার জন্য অভিযুক্তরা তাঁর মুখ আর মাথাও ইট মেরে থেঁতলে দিয়েছিল৷ মা এই সব জেনেছেন৷ জানতে পেরেছেন মাদক বা ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ধর্ষণের পরে নির্যাতনকারীরা গাড়ি চালিয়ে দিয়েছিল মেয়েটির দেহের উপর দিয়ে৷ জেনেছেন, পড়ে থাকা দেহ থেকে মুখ আর নিম্নাংশ খুবলে খেয়েছে কুকুরে৷ ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পড়ে জেনেছেন, মেয়ের খুলিটা টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল৷ তাঁর যৌনাঙ্গের গভীর ক্ষত থেকে মনে হয়েছে কোনও ধারালো বস্তু ঢোকানো হয়েছিল৷ নিজের মেয়ের সম্পর্কে এই সব ভয়ংকর তথ্য শুনেছেন তাঁর মা৷

মা বলছেন, ‘‘নির্ভয়া-কাণ্ডে দোষীরা সাজা পাওয়ার পরে সুপ্রিম কোর্টের রায় নিয়ে গ্রামের সবাই আলোচনা করেছি৷ মনে হয়েছিল, এবার হয়তো এমন অপরাধ করার আগে দুস্কৃতীরা দু'বার ভাববে৷ এখন বুঝছি, মেয়েদের নিরাপত্তা নেই৷ সাজা পেয়েও লোকজনের কোনও ভয় নেই৷’’ মেয়ের দিনমজুর বাবা বলেছেন, ‘‘দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়িয়েছি মেয়েকে৷ টাকার অভাবে আর পড়াতে পারিনি৷ একটি ওষুধ সংস্থায় কাজ পেয়েছিল সে৷ মাসে চার হাজার টাকা মাইনে পেত৷ এই বয়সে যেভাবে ও সাহায্য করছিল, তাতে গর্ব হতো৷’’

এদিকে, অভিযুক্ত মোট আটজনের মধ্যে দু'জনকে গ্রেফতার করতে পেরেছে পুলিশ৷ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খট্টর জানিয়েছেন, ফার্স্ট ট্র্যাক কোর্টে এই মামলার শুনানি হবে৷ পুলিশের দাবি, সুমিত নামে মুখ্য অভিযুক্ত মেয়েটিকে বিয়ে করতে চেয়েছিল৷ মেয়েটি আপত্তি করায় প্রতিশোধ নিতে চেয়ে সে এই ঘটনা ঘটিয়েছে৷ স্বাভাবিকভাবেই এই নিয়ে অবশ্য রাজনীতিও শুরু হয়ে গেছে ভারতে৷

শিক্ষিকা রুমা ব্যানার্জি বলছেন, ‘‘আমি এক ‌মেয়ের মা, সামাজিক এই অবক্ষয় দেখে ভীষণ ভয় পাই৷ মেয়ে কলেজে গেলে বাড়িতে মন বসে না৷ আমার মতোই কোটি কোটি মা দিনরাত দুশ্চিন্তায় থাকেন৷ ধর্ষণকারীরা কেউ মানুষ নয়৷ শয়তান৷ হয় আইন সংশোধন করা হোক, তা না হলে একদিন এমন আসবে যখন মেয়েরা আইন নিজের হাতে তুলে নিতে বাধ্য হবে৷’’

আমার মতোই কোটি কোটি মা দিনরাত দুশ্চিন্তায় থাকেন: রুমা ব্যানার্জি

This browser does not support the audio element.

পেটের টানে মেয়েকে বাড়িতে রেখেই কাজে বেরিয়ে যেতেন মা৷ দিন মজুরের কাজ৷ অনেক সময় কয়েক দিনের জন্য রাজ্যের বাইরেও যেতে হতো তাঁকে৷ বাড়িতে অবশ্য স্বামী রয়েছে, তাই দূরে গিয়েও খানিক নিশ্চিন্ত থাকতেন৷ কিন্তু স্বপ্নেও ভাবেননি যে রক্ষার দায়িত্বে যাঁকে রাখা হয়েছে, সেই স্বামীই হবে তাঁর মেয়ের ধর্ষক৷ দীর্ঘ দিন ধরে ১০ বছরের মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠল তারই সৎ বাবার বিরুদ্ধে৷ এখন সে অন্তঃসত্ত্বা৷ গুরুতর অসুস্থ হয়ে স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন৷ ঘটনাটি ঘটেছে হরিয়ানার রোহতাকে৷ পুলিশ জানিয়েছে, তার মা কর্মসূত্রে মাঝে মধ্যেই বাইরে থাকতেন৷ আর সেই সুযোগেই নাবালিকার উপরে লাগাতার ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন চালিয়ে গেছে সৎ বাবা৷ সম্প্রতি ওই নাবালিকা অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে চিকিৎসা করাতে নিয়ে যান মা৷ তখনই ঘটনাটি সামনে আসে৷ চিকিৎসকেরা তাঁকে জানান যে, ওই নাবালিকা পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা৷ পরে নাবালিকাকে জি়জ্ঞাসা করলে সে-ও মুখ খোলে৷ সে জানায়, সুযোগ পেলেই ওই ব্যক্তি তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ত৷ উপরন্তু ভয়ও দেখাতো৷ তাই সে এত দিন কাউকে বিষয়টি জানানোর সাহস পায়নি৷

সেই রোহতাক, যেখানে শুক্রবার রাতে গণধর্ষণের পর নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে এক তরুণীকে৷

বছর বাইশের ওই নির্যাতিতা আদতে সিকিমের বাসিন্দা৷ এখন তিনি গুরুগ্রামের সেক্টর ১৭-য় থাকেন৷ রবিবার ভোররাতে মধ্য দিল্লির কন্নট প্লেস থেকে বাড়ি ফিরছিলেন৷ পুলিশ জানিয়েছে, ওই তরুণী যখন প্রায় বাড়ির কাছাকাছি, ঠিক সেই সময় তাঁর উপর চড়াও হয় দুষ্কৃতীরা৷ তাঁকে অপহরণ করে একটি ছোট গাড়িতে জোর করে তুলে নেওয়া হয়৷ এরপর গুরুগ্রাম থেকে পশ্চিম দিল্লির নজফগড়ের দিকে রওনা দেয় গাড়িটি৷ চলন্ত গাড়িতেই তরুণীকে ধর্ষণ করে তারা৷ এরপর গুরুগ্রাম থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে নজফগড়ের রাস্তায় দুষ্কৃতীরা তরুণীকে গাড়ি থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পালায়৷ রোহতাকে গণধর্ষণের ঘটনা‌র দু'দিন পরের এই ঘটনা আরও একবার রাজধানীর নারী সুরক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে৷

স্থানীয় লোকজনের সাহায্যে কোনও রকমে স্থানীয় থানায় পৌঁছান নির্যাতিতা৷ সেখান থেকে গুরুগ্রাম পুলিশের কাছে খবর পৌঁছায়৷ নির্যাতিতার বয়ান রেকর্ড করেছে পুলিশ৷

প্রিয় পাঠক, আপনি কিছু বলতে চাইলে জানাতে পারেন নীচে মন্তব্যের ঘরে...

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ