২০১২ সালে নির্ভয়া কাণ্ডের পর দেশজুড়ে শুরু হয়েছিল সামাজিক আন্দোলন৷ ধর্ষণ বিরোধী আইন সংশোধনের জন্য বসানো হয়েছিল কমিশন৷ রিপোর্টে আইন সংশোধনের সুপারিশও করা হয়েছিল৷
বিজ্ঞাপন
এরপর যমুনা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে, কিন্তু...
ধর্ষণ বা গণধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে বই কমেনি ভারতে৷ এর সাম্প্রতিকতম উদাহরণ পাওয়া গেছে শুক্রবার রাতে, উত্তর প্রদেশে৷ রাজ্যের বুলন্দশহরের ৯১ নং জাতীয় সড়কে মা এবং মেয়ে – দু'জনকেই গাড়ি থেকে নামিয়ে পাশের জঙ্গলে নিয়ে ধর্ষণ করেছে জনা পাঁচেক লোক৷ অথচ অপরাধীকে যোগ্য শাস্তির দেয়ার আগেই সংসদের ভেতরে ও বাইরে সেই ৩৫ বছরের মা এবং তাঁর ১৪ বছরে মেয়ের গণধর্ষণ কাণ্ড নিয়ে শুরু হয়ে গেছে রাজনৈতিক কাদা ছোঁড়াছুড়ি৷ হবে না? আগামী বছর যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে উত্তর প্রদেশে!
রাজ্যের শাসকদলের বিতর্কিত নেতা আজম কান এই ঘটনাকে বলেছেন রাজনৈতিক চক্রান্ত৷ অন্যদিকে বিজেপি বলছে, এই ঘটনার জন্য শাসকদল সমাজবাদী পার্টিই দায়ী৷ তাই মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদবের ইস্তফা দেওয়া উচিত৷ কিন্তু প্রশ্ন হলো, এটাই কি সব সমস্যার সমাধান?
ধর্ষিতার দুই আঙুল পরীক্ষা
কোনো নারী ধর্ষিতা হয়েছেন কিনা, তা নিরূপণের জন্য বিতর্কিত দুই আঙুল পরীক্ষা চালু করতে চেয়েছিল ভারত৷ এ নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে, বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়৷ শেষে অবশ্য বিশেষ কারণ ছাড়া পরীক্ষাটি বাতিল করা হয়৷ কী এই পরীক্ষা?
ছবি: AP
প্রমাণ করার জন্য
ধর্ষণকারীকে সাজা দিতে তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনাটাই যথেষ্ট নয়৷ ধর্ষণ যে হয়েছে, সেটা প্রমাণ করতে হয়৷ তাই এতদিন পর্যন্ত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চিকিৎসকরা দুই আঙুল পরীক্ষা করতেন৷
ছবি: Fotolia/detailblick
সম্ভোগের অভ্যাস
নিগৃহীতা মহিলার যৌনসম্ভোগের অভিজ্ঞতা বা অভ্যাস আছে কিনা, তা যাচাই করা হতো, কোথাও কোথাও এখনও হয়ে থাকে যোনিপথে আঙুল ঢুকিয়ে৷
ছবি: AP
কুমারিত্বের প্রমাণ
আঙুলের স্পর্শে চিকিৎসকরা বুঝতে পারেন, একজন নারীর সতীচ্ছদ অক্ষত আছে কিনা, অর্থাৎ সেই নারীর কুমারিত্ব অক্ষুণ্ণ আছে কিনা৷
ছবি: Fotolia/NinaMalyna
ভিত্তিহীন ধারণা
আঙুলের সাহায্যে নাকি বোঝা যায়, বলপূর্বক যৌন সম্পর্ক হয়েছিল, না সম্মতি নিয়ে৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই পদ্ধতিকে ভিত্তিহীন বলে নিষিদ্ধ করার পক্ষপাতী৷
ছবি: picture-alliance/Photoshot
সর্বোচ্চ রায়
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ২০১৩ সালেই বলেছিল, দুই আঙুল পরীক্ষা ধর্ষিতার পক্ষে শারীরিক ও মানসিকভাবে অবমাননাকর৷ সরকারের বিকল্প পদ্ধতির সন্ধান করা উচিত৷
ছবি: CC-BY-SA-3.0 LegalEagle
আর্মিতে ভর্তি হতে গেলে
ইন্দোনেশিয়ায় মহিলারা আর্মিতে ভর্তি হতে চাইলে, তাঁদের এই পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়৷ দেশটির আর্মি প্রধান জেনারেল মোয়েলদোকোর কথায়, ‘‘দুই আঙুল পরীক্ষা নারীর আচার-আচরণ, চরিত্র নিরীক্ষণের মূল চাবিকাঠি৷’’ বলা বাহুল্য, দক্ষিণ এশিয়া ছাড়াও মধ্য-পূর্ব এবং উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোতেও এটি একটি চালু পরীক্ষা৷
ছবি: AFP/Getty Images/A. Berry
6 ছবি1 | 6
আসলে সমস্যার শুরুটাও এখান থেকেই৷ না হলে ভারতে ধর্ষণের ঘটনা এক বিস্ফোরক স্তরে এসে পৌঁছাত না৷ দু'বছরের শিশু থেকে ৭০ বছরের বৃদ্ধা – প্রতিদিন বিধ্বস্ত হতে হতো না অসংখ্য নারী, কিশোরী এমনকি দুগ্ধপোষ্য কন্যাকে৷ এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, প্রতি পাচ মিনিটে ভারতের কোথাও না কোথাও যৌন হেনস্থার ঘটনা ঘটছে৷
স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, কেন হচ্ছে? এর জন্য দায়ী কে? এরই উত্তরে বিশিষ্ট নারীবাদী বুদ্ধিজীবী শাশ্বতী ঘোষ ডয়চে ভেলেকে যা বললেন, তার প্রথম কথা, মেয়েদের বিরুদ্ধে যৌন অপরাধের ঘটনাকে পুলিশ তেমন আমল দেয় না৷ তাঁদের মতে, ধর্ষণ মিয়ে নিশ্চয় কোনো গণ্ডগোল হয়েছে, তাই পুরুষটিকে ফাঁসাতে মেয়েটি এইসব অভিযোগ আনছে৷ এর সত্যতা যাচাই করতে নির্ভয়া কাণ্ডের পর তেহেলকা সংবাদ সংস্থা ৩০টি থানায় স্টিং অপারেশন চালিয়ে দেখেছে যে, ধর্ষণের ঘটনাকে পুলিশ প্রশাসন তেমন গুরুত্ব দেয় না৷ এর একটা অংশ আইন শৃঙ্খলা হলেও অন্য অংশটা হলো বিচার প্রক্রিয়াকে সক্রিয় করে তুলতে আইন প্রণেতাদের অনীহা৷
প্রশ্ন হলো, দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি কি যৌন হেনস্থার অন্যতম প্রতিষেধক হতে পারে? উত্তরে শাশ্বতী ঘোষ বললেন, ‘‘না, ধর্ষণের শাস্তি কঠোর করার আইনই একমাত্র প্রতিষেধক হতে পারে না৷ নির্ভয়া কাণ্ডে বিচারপতি বার্মা কমিশন ধর্ষণের শাস্তি কঠোর করার সুপারিশ করেছিলেন৷ তাতে কি ধর্ষণের ঘটনা কমেছে? নির্ভয়া কাণ্ডের অপরাধীদের আজও ফাঁসি হয়নি৷ একজন নাবালক বলে বলে তিন বছর পর ছাড়া পেয়ে গেছে৷ আসলে দরকার সামাজিক মানসিকতার পরিবর্তন৷ দরকার একটা ভ্যালু সিস্টেম বা সামাজিক মূল্যবোধ গড়ে তোলার৷ দরকার যৌন হেনস্থার বিহিত করতে একটা স্ট্যান্ডার্ড প্রোসিডিওর, যেটা রুল বুক অনুযায়ী সর্বক্ষেত্রে কার্যকর হবে৷ আর যেটা দরকার সেটা হলো জাস্টিস ডেলিভারি সিস্টেমটাকে সর্বস্তরে সমানভাবে সক্রিয় রাখা৷ তাহলেই একটা সময়সীমার মধ্যে ধর্ষণ মামলার নিষ্পত্তি সম্ভব৷ অন্যরা অবশ্য ধর্ষণের শাস্তি কঠোর করার স্বপক্ষে রায় দিয়েছেন৷ যদিও দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার অভিঘাত অনেক সময় পড়ে বিচার ব্যবস্থার ওপর৷ আইন প্রণয়ন যাঁরা করেন, তাঁরা অনেক সময় রাজনৈতিক লাভ লোকসান দেখে হাত গুটিয়ে থাকেন৷
ছোট পোশাক পরাই কি ধর্ষণের কারণ?
ভারতে প্রতিদিন অন্তত ৯২ জন নারী ধর্ষণের শিকার হন৷ যখনই এ ধরনের কোন মামলা আদালতে উঠেছে তখন প্রথম যে প্রশ্নটি সামনে এসেছে তা হলো, ধর্ষণের শিকার ঐ নারী কি ধরনের পোশাক পরেছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
যুগের সাথে পোশাক
যুগে যুগে পোশাকের ধরনে পরিবর্তন এসেছে৷ আদিমকালে ছিল পশুর চামড়া, গাছের ছাল আর এখন রয়েছে নানা ধরনের পোশাক৷ বর্তমানে দেশ, সংস্কৃতি, সমাজ ব্যবস্থা, কাজের ধরন, অনুষ্ঠান, পছন্দ ও ফ্যাশানের ভিত্তিতে বহু ধরনের পোশাক পরে থাকেন নারীরা৷
ছবি: AP
শরীর প্রদর্শন মানেই কি ধর্ষককে আমন্ত্রণ?
ভারতে বেশিরভাগ ধর্ষণ মামলায় দেখা গেছে, ধর্ষিতা সালোয়ার কামিজ বা শাড়ি পরেছিলেন৷ অর্থাৎ যাকে বলা হয় ভারতীয় নারীর আদর্শ পোশাক, সে ধরনের পোশাকই তাঁরা পরেছিলেন৷ অর্থাৎ এ জরিপ থেকেই প্রমাণিত হচ্ছে যে, শরীর প্রদর্শন না করে বা তথাকথিত ‘আধুনিক’ পোশাক না পরেও শ্লীলতাহানির শিকার হচ্ছেন নারীরা৷
ছবি: Reuters
আইনের ভয় নেই
২০১৩ সালে এক জরিপে দেখা গেছে যে, এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোতে প্রতি চারজনের মধ্যে একজন পুরুষ জীবনে অন্তত একবার কোনো নারীকে ধর্ষণ করেছে৷ এর মধ্যে বেশিরভাগ পুরুষকেই কোনো আইনি ঝামেলা পোহাতে হয়নি৷
ছবি: Fotolia/DW
ধর্ষণ যখন বিনোদনের মাধ্যম
ভারতের উত্তর প্রদেশে ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলেছে৷ এর কারণ হিসেবে পুলিশ নারীদের উপর পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব, মেয়েদের মোবাইল ব্যবহার ও ছোট পোশাক পরিধানকে উল্লেখ করেছে৷ নারীদের নিরাপত্তা দিতে পুরোপুরি ব্যর্থ পুলিশ বলেছে, সেখানকার পুরুষরা তাদের বিনোদনের অভাব পূরণ করছে ধর্ষণের মাধ্যমে৷
ছবি: dapd
নারীদের দাবিয়ে রাখার হাতিয়ার
রাস্তা, অফিস বা যে কোনো পাবলিক প্লেসে পুরুষের যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন নারীরা৷ বিশেষ করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ হওয়ায় নারীদের দাবিয়ে রাখতে পুরুষরা ধর্ষণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে৷
ছবি: UNI
পরিচিতদের দ্বারাই বেশি ধর্ষণ
২০১৩ সালে ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরোর রিপোর্ট বলছে, সে বছর ১০০ জন ধর্ষণের শিকার নারীর মধ্যে ৯৮ জন এমন ব্যক্তিদের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছেন, যারা তাঁদের পরিচিত৷ আদালতে যেসব মামলা ওঠে, বা গণমাধ্যমে যেসব ঘটনা প্রকাশ পায় সেগুলো বেশিরভাগই বাইরের লোকের হাতে৷ ফলে পরিচিত ব্যক্তি দ্বারা ধর্ষণের ব্যাপারটি ধামাচাপা পড়ে যায়৷
ছবি: Reuters/Ahmad Masood
যৌন নিগ্রহ সর্বত্র
ভারতে জন্মের আগে ভ্রুণের লিঙ্গ নির্ধারণ বেআইনি হলেও, খুব সাধারণ ঘটনা৷ ফলে পৃথিবীর আলো দেখতে পাওয়া মেয়েদের সংখ্যা এত কম যে, সমাজে নারী-পুরুষের অনুপাতে হেরফের হয়৷ এছাড়া বাল্যবিবাহ, কম বয়সে মা হওয়া, সন্তান জন্ম দিতে গিয়েও মৃত্যুবরণ করছেন নারীরা৷ পরিবারের ভেতরেও চলে যৌন নির্যাতন এবং ধর্ষণ৷ এরপরও কি আপনারা ধর্ষণের জন্য পোশাককে দায়ী করবেন?
ছবি: picture-alliance/dpa
7 ছবি1 | 7
মোদ্দা কথা হলো, সমাজ ও প্রশাসনকে আরও সচেতন ও সংবেদনশীল হতে হবে৷ ধর্ষিতার পাশে দাঁড়াতে হবে তাঁর চরিত্রের দিকে আঙুল না তুলে৷ বিচার প্রক্রিয়াকে দ্রুত শেষ করতে হবে৷ আর তার জন্য পুলিশ প্রশাসনকে তত্পর হতে হবে৷ এছাড়া নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে যা কিছু করণীয়, তা করতে দায়বদ্ধ থাকতে হবে৷ এই যেমন ধর্ষিতাকে সাহায্য, পরিষেবা বং নিরাপত্তা দেবার জন্য থাকা দরকার বিশেষ সেলের ব্যবস্থা৷ বুলন্দশহরের গণধর্ষিতা মা মেয়ে এবং তাঁদের পরিবার পুলিশের হয়রানিতে ক্লান্ত হোয়ে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, অপরাধীদের দ্রুত এবং চরম শাস্তি দেওয়া না হলে মা-মেয়ে দু'জনেই আত্মহত্যা করবে৷
বলা বাহুল্য, বিচার প্রলম্বিত হলে আইনের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে অপরাধীরা গলে বেরিয়ে যায়৷ আর শাস্তি হলে, তা হয় লঘু৷