অপরাধের শিকার নারীর পরিচয় ও ছবি প্রকাশে আইনগত বাধা থাকলেও তা মানছে না বাংলাদেশের অনেক সংবাদমাধ্যম৷ সম্প্রতি ঢাকার একটি ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলের ও-লেভেলের একজন শিক্ষার্থীর ধর্ষণের অভিযোগের ঘটনায়ও এমনটা ঘটেছে৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
বিজ্ঞাপন
অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মেয়েটির মৃত্যু হয় বলে জানিয়েছেন ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক৷ এই ঘটনায় দায়ে মেয়েটির এক বন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়৷ পুলিশ জানায়, আটক ছেলেটি ‘দোষ স্বীকার’ করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন৷ বাংলাদেশের অধিকাংশ সংবাদমাধ্যম অভিযুক্ত ছেলেটিরও ছবিসহ পরিচয় প্রকাশ করেছে৷ অথচ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে যে আদালত কর্তৃক কেউ অভিযুক্ত প্রমান হওয়ার আগে তার ছবি সংবাদপত্রে প্রচার করা যাবে না৷ শুধু সংবাদপত্র বা অনলাইন নয়, টেলিভিশনগুলোতেও এক্ষেত্রে আইনের ব্যত্যয় দেখা গেছে৷
বাংলাদেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ এর ১৪ (১) ধারায় সংবাদমাধ্যমে নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুর পরিচয় প্রকাশের ব্যাপারে বাধা-নিষেধ সম্পর্কে বিস্তারিত বলা হয়েছে৷ সেখানে বলা হয়েছে, ‘‘এই আইনে অপরাধের শিকার হয়েছেন এইরূপ নারী বা শিশুর ব্যাপারে সংঘটিত অপরাধ বা তৎসম্পর্কিত আইনগত কার্যধারার সংবাদ বা তথ্য বা নাম-ঠিকানা বা অন্যবিধ তথ্য কোন সংবাদপত্রে বা অন্য কোন সংবাদমাধ্যমে এমনভাবে প্রকাশ বা পরিবেশন করা যাইবে যাহাতে উক্ত নারী বা শিশুর পরিচয় প্রকাশ না পায়৷ (২) উপ-ধারা (১) এর বিধান লংঘন করা হইলে উক্ত লংঘনের জন্য দায়ি ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের প্রত্যেকে অনধিক দুই বছর কারাদণ্ড বা অনুর্ধ্ব এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন৷’’
শাহদীন মালিক
This browser does not support the audio element.
সুপ্রীম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, ‘‘এটাকে আমি দায়িত্বহীন সাংবাদিকতা বলব৷ শুধু দায়িত্বহীন নয়, হলুদ সাংবাদিকতাও বলা যায়৷ অনেকেই তো এটা মানছে না৷ কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাতো নেওেয়া হচ্ছে না৷ মেয়েটি মারা গেলেও তার পরিচয় বা ছবি প্রকাশ করা যাবে না৷’’
আদালত কর্তৃক অভিযুক্ত হওয়ার আগে কী প্রাথমিকভাবে অভিযুক্ত ছেলেটির ছবি বা পরিচয় প্রকাশ করা যায়? জবাবে জনাব মালিক বলেন, ‘‘না, এখানেও আদালত কর্তৃক দণ্ডিত না হওয়া পর্যন্ত অভিযুক্ত ছেলেটির পরিচয় বা ছবি প্রকাশ করা যাবে না৷ ছেলেটি যদি নাবালক অর্থাৎ ১৮ বছরের নিচে হয় তাহলেতো প্রকাশ করা যাবেই না৷ তবে ১৮ বছরের বেশি হলেও তার পরিচয় বা ছবি প্রকাশ না করাই ভালো৷ আর এখন তো বিচারকরাও সংবাদ মাধ্যমে রিপোর্ট দেখে প্রভাবিত হন৷ যেটা কোনভাবেই উচিৎ না বলেই আমি মনে করি৷’’
অনেক সংবাদমাধ্যম কেন আইন মানছে না? এটা না মানলে কী ধরনের ব্যবস্থা হতে পারে? জানতে চাইলে দৈনিক আমাদের অর্থনীতির প্রধান সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খান বলেন, ‘‘আমাদের সংবাদমাধ্যমে এখন জানাশোনা লোকের চেয়ে না বোঝা মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে৷ ফলে তাদের অনেকই জানেন না, এই ছবি ও পরিচয় প্রকাশ করে তারা ভুল করেছেন৷ এমনকি এগুলো বিশ্লেষণ করে ভুলটা ধরিয়ে দেওয়ার জন্য কোন সংগঠনও নেই৷ আমি মনে করি, আদালত কর্তৃক কেউ অভিযুক্ত প্রমাণ হওয়ার আগে তারও পরিচয় বা ছবি প্রকাশ করা ঠিক নয়৷ পরিচয় প্রকাশ না করেও অনেক সময় বর্ণনার মধ্যে এমনভাবে লেখা যায় যাতে মানুষ অভিযুক্ত সম্পর্কে বুঝতে পারে৷ শুধু তাই না, সরকারি কোন অফিসের বা কোন অফিসারের দুর্নীতি সম্পর্কে তার নাম প্রকাশ না করেও লেখা যায়৷ এমনভাবে লিখতে হবে যাতে তদন্তকারীরা খুব সহজেই তার কাছে পৌঁছাতে পারে৷ কিন্তু সংবাদমাধ্যমে এগুলো বলা বা দেখার লোক দিন দিন কমে যাচ্ছে৷’’
ধর্ষক কেন, কী ভেবে ধর্ষণ করে?
ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের সময় কীভাবে কাজ করে ধর্ষকের মন ও মস্তিষ্ক? এ সম্পর্কে বিভিন্ন বিজ্ঞানী কী বলেছেন তা বিস্তারিত জানুন ছবিঘরে...
ছবি: Getty Images/China Photos
সব সময় যৌনসুখ মুখ্য নয়
সাইকোলজি অফ ভায়োলেন্স জার্নালের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক শেরি হামবির মতে, ‘‘ধর্ষণ যৌনসুখের উদ্দেশ্যে নয়, বরং অপরপক্ষকে দমিয়ে রাখতে ক্ষমতার প্রদর্শন হিসাবে করা হয়৷’’ কিছু ক্ষেত্রে এই ক্ষমতার প্রকাশ শুধু নারীদের বিরুদ্ধে হয়৷ অন্যদিকে, ধর্ষণ কাজ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ‘জাতে ওঠার’ পন্থা হিসাবে৷ এছাড়া ধর্ষণের পেছনে রয়েছে নানাবিধ মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, যা বুঝতে বিজ্ঞানীরা নানা ধরনের গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন৷
ছবি: Getty Images
কে ধর্ষক?
মার্কিন মনস্তাত্ত্বিক ড. স্যামুয়েল ডি. স্মিথিম্যান একটি গবেষণার জন্য ৫০জন ধর্ষকের সাক্ষাৎকার নেন৷ সেখানে তিনি বুঝতে পারেন যে, কয়েকটি নির্দিষ্ট আর্থসামাজিক বা ভাষা বা ধর্মগোষ্ঠী থেকেই উঠে আসবে ধর্ষকামী চিন্তা, তা নয়৷ ধর্ষক উঠে আসতে পারে যে কোনো সামাজিক বা অর্থনৈতিক শ্রেণি থেকে৷ পাশাপাশি এক ধর্ষক থেকে আরেক ধর্ষকের মধ্যে ব্যক্তিত্বের বৈচিত্র্যও লক্ষ্য করেন তিনি৷ ধর্ষণের উদ্দেশ্যও সেখানে থাকে ভিন্ন৷
ছবি: Gina Sanders - Fotolia.com
উদ্দেশ্য ভিন্ন, কিন্তু চারিত্রিক মিল
ড. স্মিথিম্যানের গবেষণা বলছে, প্রতিটি ধর্ষণের উদ্দেশ্য ভিন্ন হলেও বেশির ভাগ ধর্ষকের মধ্যে কিছু নির্দিষ্ট চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়৷ এর মধ্যে রয়েছে নার্সিসিজম বা আত্মমুগ্ধতা, নারীবিদ্বেষ ও অন্যের প্রতি সার্বিক সহানুভূতির অভাব৷ এছাড়া, গবেষণায় অংশগ্রহণকারী ধর্ষকদের মধ্যে নিজের অপরাধের প্রতি ঔদাসীন্য লক্ষ্য করেন৷
ছবি: Getty Images
ধর্ষণ করে ‘জাতে ওঠা’!
গবেষক শেরি হামবি বলেন, ‘‘তরুণরা যৌন অভিজ্ঞতার সাথে সম্মানকে মেলায়৷ এটিকে এক ধরনের জয় হিসাবে দেখে তারা৷ যাদের বেশি যৌন অভিজ্ঞতা হয়নি, তাদের নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করা হয়৷’’ এই ‘জাতে উঠতে চাওয়ার’ আকাঙ্খা থেকে ধর্ষণ করাকে টক্সিক ম্যাসকুলিনিটি বা ক্ষতিকারক পৌরুষের লক্ষণ হিসাবে দেখেন তিনি৷ ওপরের ছবিতে লেবাননের রাজধানী বৈরুতে ধর্ষণবিরোধী বিক্ষোভে অংশ নেয়া এক নারী৷
ছবি: AFP/Abaad/P. Baz
ধর্ষণ একটি অপরাধ
শেরি হামবি এবং স্মিথিম্যান মনে করেন, ধর্ষণ কোনো বিশেষ মানসিক রোগ নয়, এটি একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ৷ কোনো কোনো ধর্ষকের মধ্যে বিশেষ কিছু মানসিক রোগের লক্ষণ দেখা গেলেও এমন কোনো নির্দিষ্ট মানসিক রোগের সন্ধান পাওয়া যায়নি যা ধর্ষণ করতে বাধ্য করে৷
ছবি: Getty Images/China Photos
নানা ধরনের ধর্ষকামী মানসিকতা
ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ সাইকিয়াট্রিতে প্রকাশিত একটি গবেষণায় জয়দীপ সরকার ধর্ষকামী মানসিকতার মোট ছয়টি রূপকে চিহ্নিত করেছেন৷ এর মধ্যে রয়েছে সুযোগসন্ধানী ধর্ষক, স্যাডিস্টিক ধর্ষক, প্রতিহিংসাকামী ধর্ষক, কল্পনাপ্রবণ ধর্ষক, ক্ষমতালোভী ধর্ষক ও ক্ষুব্ধ ধর্ষক৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে একজন ধর্ষকের মধ্যে একাধিক ধর্ষকামী মানসিকতার ছাপ লক্ষ্য করা যায়, বলে জানাচ্ছে সেই গবেষণা৷
ছবি: picture-alliance/F. May
বিজ্ঞানের দ্বন্দ্ব
ধর্ষকের মনস্তত্ত্বকে বোঝার উপায় কী হবে, এই প্রশ্ন বিভক্ত করেছে বিজ্ঞানের বিভিন্ন ধারার গবেষকদের৷ সমাজতাত্ত্বিক, মনোবিদরা ধর্ষণকে যৌনতা থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে একে নিছক ক্ষমতার প্রকাশ হিসাবে দেখেন৷ অন্যদিকে, বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞান ও নৃতত্ত্বের গবেষক র্যান্ডি থর্নহিল ও ক্রেগ পামারের মতে, ধর্ষণের মূল উদ্দেশ্য যৌনতাই৷ ওপরের ছবিতে ব্রাজিলের সাওপাওলো শহরে ধর্ষণবিরোধী বিক্ষোভে অংশ নেয়া এক নারী৷
ছবি: Imago/ZumaPress
ধর্ষণের যত ‘মিথ’
ধর্ষণ বিষয়ে বেশ কিছু মিথ বা ভুল ধারণা সমাজে প্রচলিত রয়েছে৷ উদাহরণস্বরূপ, অনেক ক্ষেত্রেই একটি মিথ কাজ করে, যেখানে ধর্ষক আশ্বস্ত হয় যে, অপর পক্ষ যতই বারণ করুক বা বাধা দিক না কেন, বাস্তবে তারও এতে সম্মতি রয়েছে৷ মার্কিন মনস্তাত্ত্বিক আন্টোনিয়া অ্যাবের একটি গবেষণায় উঠে এসেছে এমন মিথে বিশ্বাসী এক ধর্ষকের বয়ান৷
ছবি: picture-alliance/dpa/C. Klose
গবেষণার প্রাসঙ্গিকতা
মনস্তত্ত্বের আনাচ-কানাচ নিয়ে প্রতিদিন প্রকাশ পাচ্ছে বহু গবেষণা৷ এর একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে ধর্ষণকে বুঝতে চাওয়া চেষ্টা৷ বিভিন্ন চিন্তাধারার বা অ্যাকাডেমিক ডিসিপ্লিন নিজেদের মতো করে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছে৷ এতে করে গভীরে গিয়ে চিহ্নিত করা যাচ্ছে ধর্ষণের নানা দিক৷ ধর্ষণ রুখতে ও ধর্ষকের মনস্তাত্ত্বিক ঝোঁক চিহ্নিত করতে কাজে লাগানো হচ্ছে এমন গবেষণাকে৷
ছবি: Ambrophoto - Fotolia.com
9 ছবি1 | 9
মেয়েটির ছবি ও পরিচয় প্রকাশ করেছে এমন একটি সংবাদমাধ্যমের সম্পাদক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, ‘‘যেখানে মেয়েটি মারা গেছে, তাহলে তার পরিচয় প্রকাশে বাধা কোথায়? বেঁচে থাকলে ভিন্ন কথা ছিল৷ পাশাপাশি মেয়েটি তো কোন অপরাধ করেনি৷ সে অপরাধের শিকার৷ ফলে তার ছবি ছেপে ভুল হয়েছে এমনটি আমি মনে করি না৷’’
এদিকে ঢাকার কলাবাগানে মেয়েটির মৃত্যুর ঘটনায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা হয়েছে৷ মামলায় ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগ করেছেন তার বাবা৷ মেয়েটির মা প্রশ্ন তুলেছেন, পুলিশ ইচ্ছে করে তার মেয়ের বয়স বাড়িয়ে দিয়েছে৷ কুষ্টিয়ায় মেয়ের লাশ দাফনের পর তিনি স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘পুলিশ বৃহস্পতিবার বিকাল চারটার দিকে সুরতহাল প্রতিবেদন করাসহ লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়৷ বিকাল পাঁচটায় ঢাকা মেডিকেলের ফরেনসিক বিভাগ লাশ গ্রহণ করে৷ এসময় সুরতহাল রিপোর্টে উল্লেখ করা বয়স নিয়ে আমরা আপত্তি তুললে পুলিশ ক্ষুব্ধ হয়ে ময়নাতদন্ত ছাড়াই মর্গে লাশ ফেলে রাখে৷ মেয়ের জন্মের পর ইস্যুকৃত টিকা কার্ড, স্কুল কার্ড এবং পাসপোর্টে তার জন্ম তারিখ ২০০৩ সালের ৯ অক্টোবর লেখা আছে৷ সে হিসেবে, মৃত্যুর সময় বয়স হয় ১৭ বছর ৩ মাস৷ তাহলে পুলিশ তার বয়স ১৯ বছর বয়স কোথায় পেল?’’
নাঈমুল ইসলাম খান
This browser does not support the audio element.
মেয়েটির পরিবার অভিযোগ তোলার পর পুলিশের রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার সাজ্জাদুর রহমান বলেন, ‘‘বয়স বাড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ ঠিক নয়৷ হাসপাতালের রেজিস্টারে এবং বিভিন্ন পরীক্ষার সময় হাসপাতালে যে বয়স দেখানো হয়, সেখানে ১৯ বছর বয়স লেখা ছিল৷ হাসপাতালের কাগজপত্রেও ছাত্রীর স্বজনের স্বাক্ষর আছে৷ এটা পুলিশের প্রাথমিক সূত্র৷ এখান থেকে পুলিশ বয়সের তথ্য নিয়েছে৷ এছাড়া তার বয়স নির্ধারণের জন্য নমুনাও নেওয়া হয়েছে৷ এটার রিপোর্ট পাওয়া গেলে তার সঠিক বয়স কত তা জানা যাবে৷’’
মেয়েটির লাশের ময়নাতদন্তকারী ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, ‘‘মেয়েটির শরীরের কোথাও আঘাতের চিহ্ন পাওয়া না গেলেও যৌনাঙ্গ ও পায়ুপথে ক্ষতচিহ্ন পাওয়া গেছে৷ এ থেকে পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে মেয়েটির সঙ্গে বিকৃত যৌনাচার হয়েছে৷ এতে অতিরিক্ত রক্তরণে তার মৃত্যু হয়েছে৷’’
মেয়েটিকে ধর্ষণ, মৃত্যু ও পরবর্তী ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক শিপা হাফিজা বলেন, ‘‘নব্বইয়ের দশকের শুরুতেই আমরা আন্দোলন শুরু করি, নির্যাতিত মেয়ের ছবি ও পরিচয় প্রকাশ করা যাবে না৷ এর ফলশ্রুতিতে কিন্তু নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ পাশ হয়৷ এখানে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে৷ কিন্তু দেশের সংবাদমাধ্যম যদি এটা না মানে তাহলে দেখার দায়িত্ব প্রশাসনের৷ আমি তো মনে করি, সংবাদ মাধ্যমের উচিত দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা করা৷ মেয়েটি মারা গেলেও তার ছবি বা পরিচয় প্রকাশ করা যাবে না৷ কারণ মেয়েটির পরিবার বা তার ভাই বোন তো আছে৷ সমাজে তাদের চলাফেরায় এর প্রভাব পড়ে৷ পাশাপাশি সামাজিক মাধ্যমেও নানা কথা হয়৷’’
গ্রেপ্তারকৃতের সঙ্গে আচরণ: আইন যা বলে, বাস্তবে যা হয়
গ্রেপ্তারকৃতদের সঙ্গে কেমন আচরণ করতে হবে তা বলা রয়েছে বিভিন্ন আইন আর পুলিশের অপরাধ তদন্ত নির্দেশিকাতেও৷ কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীই তা মানছে না৷ আইনের বরখেলাপ ঘটছে গণমাধ্যমের আচরণ ও সংবাদ পরিবেশনেও৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Murat
কখন অপরাধী?
আইন অনুযায়ী আদালতে একজন ব্যক্তি অপরাধী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত তিনি নির্দোষ৷ কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাউকে গ্রেপ্তারের পর তাকে অপরাধী হিসেবে উপস্থাপন করে৷ গ্রেপ্তারকৃতের শরীরে ‘আমি জঙ্গি’, ‘চোর’, ‘মাদক ব্যবসায়ী’, ‘ইয়াবা কারবারি’, ‘ধর্ষক’-এমন পরিচয় ঝুলিয়ে সংবাদ সম্মেলন করতে দেখা যায়৷ গণমাধ্যমেও তাদের সেই ছবি, পরিচয় প্রকাশ ও প্রচার করা হয়৷
ছবি: bdnews24.com
আদালতের আগে গণমাধ্যমে
২০১২ সালের ১১ ডিসেম্বর হাইকোর্ট গ্রেপ্তার বা সন্দেহভাজন হিসেবে আটক হওয়া কোনো ব্যক্তিকে গণমাধ্যমের সামনে হাজির না করার নির্দেশ দেয়৷ বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে মিন্নিকে দেওয়া জামিন সংক্রান্ত রায়ে বলা হয়েছে, অপরাধের তদন্ত চলার সময় গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের আদালতে হাজির করার আগেই গণমাধ্যমের সামনে উপস্থাপন করা হচ্ছে, যা মানবাধিকারের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অমর্যাদাকর এবং অ-অনুমোদনযোগ্য৷
ছবি: bdnews24
মিডিয়া ট্রায়াল
বিচারের আগেই কোন ব্যক্তিকে গণমাধ্যমে অপরাধী হিসেবে উপস্থাপনের প্রবণতা মিডিয়া ট্রায়াল নামে পরিচিত৷ সম্প্রতি এমন মিডিয়া ট্রায়ালের ঘটনা বাড়ছে৷ যাচাই, বাছাই ছাড়া আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্যের ভিত্তিতে কাউকে অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত করা হচ্ছে৷ অভিযানে গ্রেপ্তারকৃতদের নিয়ে সংবাদ পরিবেশনে এমন প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে৷ সংশ্লিষ্ট আইন এবং সাংবাদিকতায় বস্তুনিষ্ঠতার নীতিমালাও অনুসরণ করা হচ্ছে না৷
ছবি: bdnews24.com/A. Al Momin
হাতকড়া ও রশির ব্যবহার
পুলিশের অপরাধ তদন্ত নির্দেশিকায় বলা হয়েছে গ্রেপ্তারকৃত আসামি বা বিচারাধীন বন্দিকে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পাঠানোর সময় পলায়ন বন্ধের জন্য যা প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি কঠোর ব্যবস্থা নেয় উচিত নয়৷ হাতকড়া ও দড়ির ব্যবহার প্রায় ক্ষেত্রেই অপ্রয়োজনীয় ও অমর্যাদাকর৷ অথচ নিখোঁজের ৫৪ দিন পর ২০২০ সালের মে মাসে সাংবাদিক কাজলকে হাতকড়া পরিহিত অবস্থায় আদালতে হাজির করা হয়৷ সেই ছবি সমালোচনার জন্ম দেয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Murat
শিশুদের সঙ্গে আচরণ
শিশু আইনের ৪৪ ধারা অনুযায়ী, শিশুকে কোনোমতেই হাতকড়া বা কোমরে দড়ি বা রশি লাগানো যাবে না৷ কিন্তু বিভিন্ন সময়ে এর ব্যাত্যয় ঘটায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী৷ ২০১৯ সালের আগস্টে চট্টগ্রামে দুই শিশুকে হাতকড়া পরিয়ে হাজির করা হয়৷ ঢাকার আদালতে এমন একাধিক ঘটনার খবর বেরিয়েছে গণমাধ্যমে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Weigel
শিশুর ছবি
শিশু আইন ২০১৩-এর ৮১ ধারায় কোনো মামলায় বা অপরাধ সংক্রান্ত ঘটনায় কোনো শিশুর ছবি বা পরিচয় প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে৷ বলা হয়েছে, বিচারাধীন কোনো মামলায় কার্যক্রম নিয়ে সংবাদ পরিবেশনে কোনো শিশুর স্বার্থের পরিপন্থী কোনো প্রতিবেদন, ছবি বা তথ্য প্রকাশ করা যাবে না, যার দ্বারা শিশুটিকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শনাক্ত করা যায়৷ কিন্তু আদালতে শিশুদের হাজিরার শনাক্তযোগ্য ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে৷
ছবি: bdnews24.com
যেন পরিচয় প্রকাশ না পায়
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১৪ (১) ধারায় সংবাদমাধ্যমে নির্যাতিতা নারী ও শিশুর পরিচয় প্রকাশের ব্যাপারে বাধা-নিষেধ রয়েছে৷ বলা হয়েছে, এ ধরনের অপরাধের শিকার নারী, শিশুর সংবাদ এমনভাবে প্রকাশ করতে হবে যাতে তাদের পরিচয় প্রকাশ না পায়৷ তবে এ ক্ষেত্রেও ব্যাতিক্রম ঘটছে৷ ধর্ষণ কিংবা নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুর ছবি, পরিচয় প্রকাশ করার ঘটনা ঘটেছে অনেক৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Keystone USA Falkenberg
রিমান্ড মানে কি নির্যাতন?
কোনো মামলায় গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ ও তদন্তের প্রয়োজনে পুলিশ আদালতের অনুমতিসাপেক্ষে হেফাজতে নিতে পারে৷ কিন্তু শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করার এখতিয়ার নেই৷ এক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের ১৫ দফা নির্দেশনাও রয়েছে৷ কিন্তু বাংলাদেশে রিমান্ড আর নির্যাতন অনেকটা সমার্থক শব্দে পরিণত হয়েছে৷ অনেক সময়ই রিমান্ডে নিয়ে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায়ের অভিযোগ শোনা যায়৷ পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনাও আছে৷